মুসফিকা আন্জুম নাবা
ট্রেন, বাস স্টেশন, পার্ক কিংবা রাস্তাঘাটে চলার সময়; এলোমেলো চুল, নোংড়া কাপড় পরিহিত ছেলেমেয়ে হরমেশায় চোখে পড়ে। অথবা কনকনে শীতের সকালে সবাই যখন উষ্ণ চাদরে আবৃত তখনও কিছু শিশু ছেঁড়া ও ময়লাযুক্ত কাপড় পড়ে খোলা আকাশের নিচে ঘুমাতে দেখা যায়। শীত নিবারণের জন্য প্রয়োজনীয় পোশাকও নেই এসব শিশুর কাছে। এমন করুণ চিত্র আমরা প্রায়ই দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। তাদের নেই কোনো বাড়িঘর, পরিবার, পরিচয়। কারণ, তারা পথশিশু। পথশিশু হল সেসব শিশু যারা, দ্রারিদ্র্যতার কারণে শহর, নগর বা গ্রামের রাস্তায় বসবাস করছে। উন্মুক্ত স্থানে হাজার হাজার শিশু অসহায় ও পিতৃমাতৃহীন হয়ে পড়ে আছে। অনেক পথশিশুতো পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ। অথচ রাস্তাঘাট ও উন্মুক্ত স্থান তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল। রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোই তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানেই তাদের জীবিকা নির্বাহের উৎস হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ পথশিশু রাজধানী ঢাকাতে বসবাস করে। প্রতিনিয়ত আমাদের দেশে এদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
এসব শিশু স্কুলে যায় না বরং এর পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে কিংবা রাস্তাঘাটে বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করে। নিত্যদিনের খাবার জোগাড় করতেই তাদের হিমশিম খেতে হয়। খাবার কিনতে অক্ষম হওয়ায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিনিম্নমানের ও অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করতে হয়। শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে ময়লার ভাগাড় থেকে পচা ও দুর্গন্ধযুক্ত খাবার খেতেও তারা বাধ্য হয়। ঢাকা শহরে ফেলে দেওয়া খাবারে তাদের ক্ষুধা মেটে। ফলে প্রতিবছর পানিবাহিত রোগে লক্ষাধিক পথশিশুর অকাল মৃত্যু হয়। অন্য শিশুরা যেখানে সুন্দর জীবন যাপন করছে, সেখানে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। এসব অধিকার ভোগের কোনো সুযোগ নেই তাদের। তারা পাচ্ছে না অন্ন, পরনের কাপড় স্বাস্থ্য আর শিক্ষার সুবিধা।
প্রশ্ন হচ্ছে, এসব শিশু সমাজের মূল অংশ থেকে বিচ্যুত কেন? এর কারণ খুঁজতে অনেক গবেষণা হয়েছে। এ গবেষণাগুলোতে বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে। মূলত, কোনো পথশিশুদের বাবা-মা দু’জনেই মারা গেছে, বা বাবার মৃত্যুর পর মা অন্যত্র বিয়ে করেছে কিংবা বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়েছে। কেউ আবার পারিবারিক কলহে অভিমানে বাড়ি ছেড়েছে। অনেক পিতামাতা সন্তানকে রাস্তায় ইচ্ছাকৃতভাবে রেখে গিয়েছেন। এজন্য অনেক শিশু পিতামাতার কথা বলতেও পারে না। পাশাপাশি দরিদ্রতা, বাবা-মায়ের অসচেতনতা, বাল্যবিয়ে, বহু-বিয়ে এর অন্যতম কারণ। কোন কোন মাদরাসা বা স্কুলে কঠোর শাসনের কারণে পালিয়ে আসা, নদীভাঙন, হারিয়ে যাওয়া ইত্যাদি অন্যতম কারণ। পিতৃপরিচয় না থাকায় অনেক পথশিশুকে মানসিক নিপীড়ন, হেনস্তা, অশ্লীল ভাষায় গালি, কটূক্তি শোনাসহ সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হতে হয়। কিছু কিছু জরিপে তো পথশিশুদের ওপর আরো পাশবিক সহিংসতার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হতে হয় মেয়ে পথশিশুদের। মেয়ে পথশিশুদের মধ্যে ৪৬% যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। মাত্র ১০ বছর বয়সে অধিকাংশ মেয়ে শিশু বিবাহিত। বাল্য বিয়ের জন্য শারীরিক জটিলতায় ভুগতে হয়। বেশির ভাগ সময়, মেয়ে শিশুদের পাচার ও যৌনকর্মী হতে বাধ্য করা হয়। আবার যারা পাচারের শিকার হয়, তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি হয় কালোবাজারে।
যে বয়সে তাদের পরিবার পরিজনের কাছে থাকার কথা সেখানে তারা অনিরাপদ জীবন যাপন করছে। রাস্তায় থাকা পথশিশুরা মাদকাসক্তির নেতিবাচক প্রভাবে ধ্বংসের মুখে পড়েছে। মূলত, দেশের পথশিশুদের বিরাট অংশ মাদকাসক্ত। তারা মাদকের ব্যবসা ও মাদক পাচারের সাথে জড়িত। এ মাদকের মরণছোবল তাদের গ্রাস করছে। মাদকাসক্ত হয়ে রাস্তাতেই মারা যাওয়ার ঘটনাও নেহায়েত কম নয়।
ক্ষুধার জ্বালা, ছন্নছাড়া জীবন, একাকিত্ব বা সঙ্গদোষের কারণে মাদক সেবনের প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে ছিন্নমূল ও পথশিশুদের মধ্যে। এমন কুকর্ম নগরীর অলি-গলিতে চলছে অবলীলায়। সহজলভ্যতা ও দামের স্বল্পতার কারণে পথশিশুদের মধ্যে ড্যান্ডি ও গাঁজা সেবনের হার বেশি। মাদকাসক্তির ফলে তাঁদের বোধ, বিচার-বুদ্ধি, সুস্থ চিন্তা করবার মানসিকতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাদক ক্রয় করার জন্য চুরি, ছিনতাইয়ের মতো কাজও করে থাকে এসব পথশিশুরা। নিজের খরচ চালানোর জন্য কমলমতি শিশুরা জীবিকার তাগিদে নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লিপ্ত হয়। অনেকের পিতামাতা কর্মহীন বা তাদের আয় অতি নগণ্য, যা তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য যথেষ্ট নয়। এজন্য পুরুষ শিশুদের পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। এসব কাজ করতে গিয়ে তারা হোটেল, রেস্তোরঁাঁ, কারখানা, পত্রিকা বিক্রি, ফুল বিক্রি, বর্জ্য সংগ্রহসহ বহুমাত্রিক কাজ করে। কম টাকায় এ শিশুদের পাওয়া যায় বলে মালিক শ্রেণী তাদের দিয়ে অনেক পরিশ্রম করায়। এসব শিশু কাজ শেষে নায্য মজুরিও পায় না বরং ক্ষেত্রবিশেষে মালিক কর্র্তৃক অমানবিক নির্যাতন ও প্রহারের শিকার হয়ে মৃত্যু হয়েছে অনেক শিশুর। প্রতিনিয়ত এসব খবর গণ্যমাধ্যমে আসে। আবার অতিরিক্ত কাজ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজের কারণে নানান রোগ তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। অসুস্থ হলে তাদেরকে সেবা করার মতো কেউ নেই, চিকিৎসা করারও সুযোগ হয় না।
পথশিশুদের ঘুমানোর বিছানা নেই, গোসল করতে পারে না, খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করে। পথশিশুরা অবহেলা, শোষণের শিকার হয় চরমভাবে। অনেক পথশিশু মোড়ে মোড়ে ভিক্ষা করে, রাতের বেলা পরিত্যক্ত জায়গা, ফুটপাত ও শহরে থাকার অযোগ্য স্থানই তাদের আশ্রয় সেখানেই।
অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে অনেক শিশু বিভিন্ন অপরাধচক্রের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে, যারা তাদেরকে দিয়ে ভিক্ষা করার পাশাপাশি অপরাধমূলক কার্যক্রম করিয়ে নেয়। ফলে এসবে প্রভাবিত শিশুরা হিংস্র ও অমানবিক হয়ে ওঠে। অন্যদিকে নির্ধারিত টাকার কম ভিক্ষা করে আনলে শিশুদের মারধর করা হয়, খাবার দেয়া হয় না, এছাড়াও শিশুদের উপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। বর্তমানে দেশে লাখেরও বেশি অনাথ পথশিশু রয়েছে, যারা অবহেলা ও অনাদরে দিনযাপন করছে। সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরির জন্য রাজনৈতিক অথবা অন্য স¦ার্থান্বেষী মহল এদেরকে ব্যবহার করে। যেখানে একজন শিশু পরিবার থেকে আদর, স্নেহে ও নিয়মতান্ত্রিক শাসনে বড়ো হয়। পাশাপাশি সামাজিক রীতি নীতি, মানবীয় গুণের চর্চা করে। একজন আদর্শবান মানুষ হিসেবে গড়ে উঠে। অন্যদিকে একজন পথশিশু দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তি দ্বারা সুরক্ষিত বা পরিচালিত নয়। পরিবার থেকে বিচ্ছিনতার কারণে পারিবারিক, সামাজিক, নৈতিকতাসহ কোনো প্রকার মূল্যবোধ শেখা হয় না।
ফলে বেপরোয়াভাবে চলতে অভ্যস্ত। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন অনেক সময় তাদের অপরাধীতে পরিণত করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের জীবনের এমন নির্মম পরিহাস এসব করতে, অপরাধ জগতে প্রবেশ করতে বাধ্য করায়। যে বয়সে শিশুরা খেলাধুলা, লেখাপড়া করে, সে বয়সে তারা কঠিন জীবনসংগ্রামে টিকে থাকার লড়াই করছে। তাদের শৈশবের মধুর দিনগুলো দুর্বিষহ দিনে অতিবাহিত হয়। কোমলতা ও সহনশীলতা হারিয়ে হিংস্রতায় রূপ নেয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের উদাসীনতা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। কোনো পদক্ষেপ টেকসই ও কার্যকর নয়। তাই দিনের পর দিন এসব সমস্যা বেড়েই চলেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপট এমন হয়েছে যে, ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’ একথা শুনলে মনে হয় কিছু সিলেক্টিভ শিশুদের জন্য প্রযোজ্য; সবার জন্য নয়। পথশিশুরা শারীরিক নিপীড়ন, অশ্লীল কথা ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়। ফলশ্রুতিতে তারা আরও বেশি মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত ও হীনম্মন্যতায় ভোগে। তাদের দুর্দশা থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের সমাজে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন ও মানবিক চেতনা উন্নত করা প্রয়োজন।
আমাদের মনে রাখতে হবে তারা অপরাধী নয়, অপরাধের শিকার। তাই এ সমস্যা সমাধানে সমাজের দায়িত্বশীল মানুষের সম্মিলিত প্রয়াস গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শীতবস্তু বিতরণ করলেই আমাদের দায়িত্ব হয়ে যায় না। পথশিশুরাও আমাদের সমাজের অংশ। পথশিশুদের জীবনমান উন্নয়নে সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসা অপরিহার্য এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেয়া আমাদের কর্তব্য। সুশিক্ষা, নৈতিকতার শিক্ষার মাধ্যমে সৃজনশীল কাজে তারাও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। তারা অগ্রসর না থাকা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নের অন্তরায়। পথশিশু থেকে বিশ্ব জয়ের রেকর্ড রয়েছে। এর দ্বারা বুঝা যায় তারাও সঠিক পরিবেশ পেলে নিজের মেধা, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে সমাজে উল্লেখ্যযোগ্য অবদান রাখতে পারে।
ঢাকাসহ সারা দেশে পথশিশুদের নিয়ে অনেক সরকারি-বেসরকারি সংস্থা কাজ করছে। অনেক পথশিশুর খাবার, পোশাক, ভ্রাম্যমাণ শিক্ষার ব্যবস্থা করছে। কিন্তু দিনশেষে তাদের পথেই ফিরে যেতে হয়। আবার কিছু সংগঠন রাস্তা থেকে উদ্ধার করে পুরোপুরি পুনর্বাসনের চেষ্টা করে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। যাদের পরিবার আছে, তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। যাদের পরিবার নেই, তাদের পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। শিশুরা রাস্তায় থাকলে তাদের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা কোনোদিন সম্ভব নয়। পরিশেষে বলতে হয়, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের সমাজে ছোট্ট শিশুরা যদি এমন মানবেতর জীবনযাপন করে, তাহলে তা দুর্ভাগ্যজনক বলা ছাড়া কোন উপায় নেই। এটা আমাদের সমাজের অনুদারতা, বৈষ্যমের চরম পর্যায়। তাই এসব পথশিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অবশ্যই আমাদের ভাবতে হবে। সমাজের কোন অংশকে অবহেলিত বা অধিকার বঞ্চিত রেখে দেশ ও জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না। একথা সংশ্লিষ্টরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন ততই মঙ্গল।
লেখক : শিক্ষার্থী, জয়পুুরহাট সরকারি মহিলা কলেজ, জয়পুরহাট।