DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

কলাম

রোজার গুরুত্ব ও পুরস্কার

চাকর সাধারণত মালিকের কাছে কী চায়? একটা গাড়ি, একটা বাড়ি, একটা প্রমোশন, একদিনের ছুটি, ছেলের চাকরি ইত্যাদি। কোন চাকরই কখনও মালিকের সবকিছু চাইতে পারে না। মালিক চাকরকে বলতে পারেন এ কাজটা করলে তুমি এটা পাবে, সেটা পাবে, অমুক পাবে, তমুক পাবে।

Printed Edition

॥ প্রফেসর ড. মো. আব্দুল্লাহেল বাকী ॥

চাকর সাধারণত মালিকের কাছে কী চায়? একটা গাড়ি, একটা বাড়ি, একটা প্রমোশন, একদিনের ছুটি, ছেলের চাকরি ইত্যাদি। কোন চাকরই কখনও মালিকের সবকিছু চাইতে পারে না। মালিক চাকরকে বলতে পারেন এ কাজটা করলে তুমি এটা পাবে, সেটা পাবে, অমুক পাবে, তমুক পাবে। চাকর-মালিকের এ অবস্থাটা আমাদের কম-বেশী জানা আছে। এটাই সাধারণ এটাই স্বাভাবিক। কোন মালিক সাধারনত তাঁর চাকরকে এরকম বলেন না যে, ‘এ কাজটা করলে তুমি আমাকেই পেয়ে যাবে। বা আমিই তোমার হয়ে যাবো।’ যদি কখনও কোনভাবে বলেন, তখন চাকরের প্রাপ্তিটা হবে একেবারেই অসাধারণ-অস্বাভাবিক। মালিক যদি চাকরের হয়ে যান তাহলে মালিকের যা আছে সবই চাকরের!! মালিকই চাকরের হয়ে গেলে পাওয়ার আর বাকি থাকবে কি? সুবহানাল্লাহ!

আধুনিক পৃথিবীতে এরকম চাকর পাওয়া খুব দুষ্কর, যে মালিককে খুশি করার জন্যে কাজ করে। সর্বত্র সবাই কেবলই নিজেকে খুশি করতে চায়। মালিকের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা পায় জন্য চাকরি করে, সামনা-সামনি তোষামোদ করে, কিন্তু আসলে মালিকের হতে চায় না। সে তারই হতে চায়। মালিকের চাকরি করে নিজের জমি কিনে, বাড়ি করে, গাড়ি কিনে, ব্যাংক হিসাব বাড়ায়। মালিককে চুষে মালিকের কাছ থেকে পারলে অন্যায়ভাবে নিয়ে নিজে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এমনকি এক পর্যায়ে সে মালিক হওয়ারও স্বপ্ন দেখে। উদাহরণÑফেরাউন, নমরূদ; যারা আমাদের মত মানুষই ছিল। বুদ্ধিমান চাকর মালিকের কাছে কিছু চেয়ে না নিয়ে বরং মালিককে বলবে, আপনি যা দেন তাতেই খুশি। আপনি শুধু আমার উপর খুশি থাকেন, মালিক। মালিক তার হয়ে যান-সবসময় সে সে চেষ্টাই করে।

মালিক তার হওয়া আর সে মালিক হওয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্যটা মনে রাখা প্রয়োজন।

আমি এক চাকর। সাধারণভাবে মালিককে না পাওয়ার কারণ কি? কারণ, আমি আছি, আমি একটা আলাদা সত্তা। আমার এটা দরকার, আমার ওটা দরকার। এটা না হলে হবে না, ওটা না হলে চলবে না। তখনতো মালিকের কী দরকার তার খবর থাকে না। কী বলেছেন তার গুরুত্ব থাকে না। আমার দিকে তাকাতে গিয়েই তো আমি মালিকের দিকে তাকাতে পারি না।

আমি মালিকের হতে পারি না, আমার কারণে। আমিও আছি, মালিকও আছেন। আজকে আমারটা করি, কালকে মালিকেরটা। মালিক খুব জরুরী কাজে আসতে বলেছেন-ছেলের অসুখ, মেয়ের পরীক্ষা অফিসে গেলামই না, ফোন করলাম না, দরখাস্ত দিলাম না, মালিকের কথা রাখলাম না। আমি আমার হয়ে থাকলাম, মালিকের হলাম না। আমার প্রয়োজন আমি সেরেছি, ফলে মালিক আমার হননি। এভাবে দিন-সপ্তাহ-মাস-বছর-যুগ ধরে মালিকের কথা অমান্য করি। আমি মালিকের থাকি না, ফলে মালিক আমার থাকেন না। চাকরের চাওয়া থাকলেই তো সমস্যা। চাওয়া মত না পাওয়াতেই যত ঝামেলা।

সে প্রেক্ষিতে এটা অবশ্যই মেনে নেওয়া যায় যে, পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে আমার কিছুই নেই, তখনতো সব মালিকেরই। মালিক বসে থাকতে বললে বসে থাকবো, দৌড়াতে বললে দৌড়াবো, খেতে বললে খাব, না বললে খাব না, যা বলবেন তাই। এভাবেই যখন আমার কিছুই থাকলো না, তখন আমিই মালিকের হয়ে গেলাম।

রোজা আমিত্ব নষ্ট করে আমাকে শেষ করে দিতে চায়। আমি নেই, আমি মালিকের হয়ে গেছি। আমি যখন মালিকের হয়ে গেছি, তখন মালিকও আমার হয়ে গেছেন। সেজন্যেই রোজা আমাকে পরিপূর্ণরূপে মালিকের বানিয়ে ফেলে। যখন আমি মালিকের হয়ে যাবো, তখন মালিকও আমার হয়ে যাবেন। রোজা এমন ইবাদত যা আমাকে পরিপূর্ণরূপে মালিকের বানিয়ে দিবে, ফলে মালিকও আমার হয়ে যাবেন। মালিক যার হয়ে যান, তার আর কোন আলাদা নিজস্বতা এবং সেটার ভিত্তিতে এটা-ওটা চাহিদা থাকে না।

রোজার মাধ্যমে আমরা মালিকের হয়ে যাবো। মালিক যা দেয় তাতেই খুশি। মালিক যা বলে তাতেই সন্তুষ্ট। আমার কিছু থাকবে না। আমি চাইবো না। আমার এটা পছন্দ না, ওটা পছন্দ না। মালিকের যেটা পছন্দ সেটাই আমার পছন্দ। মালিক বললেন-এটা নিবি? আমি বলব, আপনি নিতে বললে নিব। আপনি যদি না বলেন, নিব না। তাহলে আমি থাকলাম কোথায়? দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা, বছর, যুগ, শতাব্দী সব সময় মালিক যা বলবেন তাই। মালিক যদি কিছু একটা চাইতে বলেন, আমি বলব-চাকর আবার কী চাইবে? আমি কি চাইতে পারি? আমি কি চাইতে জানি? আপনিই তো আমার যা যা দরকার সেটা দিয়েছেন, দিচ্ছেন, দিবেন। সেটাই তো যথেষ্ট। আমার চাওয়া লাগবে না। মালিক আমার হয়ে গেলে আমার আর কোন হতাশা, পেরেশানি, দু:শ্চিন্তা, অভাব, দু:খ, ক্ষোভ, বেদনা কিছু থাকবে না।

ইসলামের অন্যান্য ইবাদত যেমন নামায, হজ¦, যিকর, দান সদকা ইত্যাদি পালন করেও মানুষ বিভিন্ন অপরাধ করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে খারাপ কাজের জন্যে পাপ হয়, ভাল কাজে সওয়াবও হয়। সুতরাং মানুষ একদিকে পাপের কাজ করে, অন্যদিকে পুণ্যের কাজও চালিয়ে যায়। কিন্তু রোজা রেখে কোন খারাপ কাজ করা যায় না। তাহলে রোজা ভেঙ্গে যায়। উদাহরণ-কেউ নামায পড়ছেন, বাইরে এসে মিথ্যাও বলছেন। এ মিথ্যার জন্য তার পাপ হবে, কিন্তু নামায নষ্ট হবে না। কিন্তু কোন রোজাদার মিথ্যা বললে সে কোন সওয়াব পাবে না। সুতরাং কেউ যদি সত্যি রোজা রেখে আল্লাহকে খুশি করতে চায় তাহলে তাকে রোজার হেফাজত করতে গিয়েই খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। রোজাই হল আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের সর্বোত্তম ব্যবহারিক প্রক্রিয়া। সেজন্যেই হাদীসে এসেছে রোজাদারের রোজা পরকালে তাকে জান্নাত প্রদানের জন্য আল্লাহর নিকট সুপারিশ করবে এবং তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।

অন্যান্য ইবাদত পার্থিব সংশ্লিষ্টতা বাদ দিয়ে পালন করতে হয়। কিন্তু রোজা সব ধরনের পার্থিব সংশ্লিষ্টতা নিয়েই পালন করতে হয়। এ থেকে সুস্পস্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, রোজা মানবজীবনের সকল বিষয়াদি সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর বিধি-নিষেধের আওতায় নিয়ে আসে। কোথাও কোন রকম ফাঁক-ফোকর থাকতে দেয় না। কেউ রোজা রেখে তার জীবনের কোন বিষয় তার মত করে করতে পারে না। ফলে কোথাও তার কোন ভুল হয় না। সে জন্যেই হাদীসে কুদসীতে এসেছে, আল্লাহ বলেন, রোজা আমার জন্য; আর আমি নিজেই এর পুরস্কার দিবো। আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদেরকে এবারের রমযানে পরিপূর্ণরূপে মালিকের হয়ে যাওয়ার তওফিক দান করুন-আমীন!

লেখক : সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়।