প্রফেসর আর. কে. শাব্বীর আহমদ

জুলাই বিপ্লব, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বা চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান বলতে বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ২০২৪ ও আপামর জনতার স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনকে বোঝানো হয়।

২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারিকৃত পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পর কোটা সংস্কার আন্দোলন নতুন করে শুরু হয়। এ আন্দোলনে তৎকালীন শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার দমন-পীড়ন শুরু করলে পরবর্তীতে তা অসহযোগ আন্দোলনে রূপ নেয়। এ গণঅভ্যুত্থানের তোড়ে ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ ও দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন। ফলে বাংলাদেশ সাংবিধানিক সংকটে পড়ে এবং এর তিন দিন পরে ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের পক্ষে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শিল্পী-সাহিত্যিক, আইনজীবী, সাধারণ জনগণ, প্রবাসী বাংলাদেশী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালন করে। সক্রিয় সমর্থন জোগায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাম গণতান্ত্রিক জোট, গণতন্ত্র মঞ্চবাংলাদেশ, জাসদ, ১২ দলীয় জোট, গণ অধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, এনডিএম, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (পার্থ), জাকের পার্টি বাংলাদেশ, ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, বাংলাদেশ ন্যাপ।

২০১৮ সালে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়, যা ছাত্রদের মধ্যে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। এ আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে চলমান কোটা ব্যবস্থা সংস্কার করা। আন্দোলনের ধারাবাহিকতা এবং শিক্ষার্থীদের চাপে সরকার ৪৬ বছর ধরে চলা এ কোটাব্যবস্থা বাতিলের ঘোষণা দেয়। তবে, ২০২১ সালে এ সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে সাতজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, অহিদুল ইসলাম হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। অবশেষে, ২০২৪ সালের ৫ জুন, হাইকোর্টের বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ কোটাব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে। রায় প্রকাশের পরপরই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে।

জুলাই মাসে আন্দোলন আরও তীব্রতর রূপ নেয়, যেখানে শিক্ষার্থীরা “বাংলা ব্লকেড” সহ অবরোধ কর্মসূচি চালায়। এ সময়ে আন্দোলন দমাতে পুলিশের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের ফলে সংঘর্ষ ঘটে। এমনকি মর্মন্তিকভাবে রংপুরে আবু সাঈদ নামে একজন দেশপ্রেমিক শিক্ষার্থী পুলিশের গুলীতে শহিদ হন। আন্দোলনকারী তৃষ্ণার্ত ছাত্র-জনতাকে পানি পান করানো অবস্থায় মুগ্ধ নামের এক সত্যনিষ্ঠ, মানবিক যুবক গুলীবিদ্ধ হয়ে শহিদী মৃত্যুবরণ করে। এসব মানবতাবিরোধী ঘটনা আন্দোলনকে আরও বেগবান করে এবং দেশজুড়ে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়।

এরপর ঢাকাসহ সারাদেশে আন্দোলন সহিংহ হয়ে উঠে ও বিভিন্ন জায়গায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মতো সংগঠনের হামলায় অনেক হতাহত হয়। এ সময় সারাদেশে কারফিউ জারি ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে আপিল বিভাগের শুনানির তারিখ এগিয়ে নিয়ে আসা হয়।

৪ জুলাই আপিল বিভাগ, ৯ জুন হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের ওপর শুনানি না করে সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় আপাতত বহাল রাখে। রাষ্ট্রপক্ষকে ‘লিভ টু আপিল’ দায়ের করার কথা বলা হয়। এ সময় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, আন্দোলন হচ্ছে, হোক। রাজপথে আন্দোলন করে কি হাইকোর্টের রায় পরিবর্তন করা যায়?

পরবর্তীতে ১০ জুলাই আপিল বিভাগ রাষ্ট্রপক্ষ ও দু শিক্ষার্থীর করা আবেদনের প্রেক্ষিতে হাই কোর্টের রায়ের ওপর চার সপ্তাহ স্থিতাবস্থা জারির আদেশের পাশাপাশি কিছু পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা জারি করে। এদিন ৭ আগস্ট পরবর্তী শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়। ১৪ জুলাই হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুই শিক্ষার্থীর পক্ষ থেকে লিভ টু আপিল দায়ের করা হয়। ১৮ জুলাই এটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার কোর্ট বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম মামলার শুনানির তারিখ ২১ জুলাই রোববার নির্ধারণ করেন।

২১ জুলাই আপিল বিভাগ কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বাতিল করে। একইসাথে সরকারের নীতি নির্ধারণী বিষয় হলেও সংবিধান অনুযায়ী সম্পূর্ণ ন্যায় বিচারের স্বার্থে আদালত সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ মেধা-ভিত্তিক নিয়োগ দেয়ার নির্দেশ দেয়। এইদিন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কারফিউর মধ্যেও সর্বোচ্চ আদালতের কার্যক্রম সচল ছিলো।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে সরকার কর্তৃক ব্যাপক দমন-পীড়ন, গণগ্রেফতার এবং বহু হতাহতের ঘটনার পর, তা পরবর্তীতে জুলাই গণহত্যা নামে পরিচিতি লাভ করে, আন্দোলনকারীরা আরও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। সরকারের পক্ষ থেকে নয় দফা দাবি মেনে না নেয়ায়, ৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সকল দাবি একত্রিত করে একটি চূড়ান্ত দাবি উত্থাপন করেন। এটি এক দফা দাবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে, যার মূল লক্ষ্য ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভার নিঃশর্ত পদত্যাগ। এ ঘোষণার মাধ্যমে কোটা সংস্কারের আন্দোলন দেশব্যাপী সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয় এবং সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচির সূচনা হয়। সমন্বয়কদের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথ ছাড়বেন না, যা ছাত্র-জনতাকে চূড়ান্ত পর্যায়ের আন্দোলনের জন্য ঐক্যবদ্ধ করে।

এক দফা দাবি আদায়ের চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ প্রথমে ৬ আগস্ট মঙ্গলবার, সারা দেশ থেকে ছাত্র-জনতাকে নিয়ে মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির ঘোষণা দেন। এর উদ্দেশ্য ছিল সারাদেশ থেকে মানুষকে রাজধানীতে একত্রিত করে সরকারের ওপর চূড়ান্ত চাপ সৃষ্টি করা। তবে দেশজুড়ে পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকায় এবং আন্দোলন তীব্রতর হওয়ায়, ৪ আগস্ট রাতে এক জরুরি সিদ্ধান্তে এই কর্মসূচি এগিয়ে এনে সোমবার, ৫ আগস্ট পালনের আহ্বান জানানো হয়। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবং ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে লাখো মানুষ সকল বাধা উপেক্ষা করে রাজধানীর কেন্দ্রস্থল, বিশেষ করে গণভবন অভিমুখে রওনা দেয়। এ গণজোয়ারই শেখ হাসিনা সরকারের পতনকে ত্বরান্বিত করে এবং ঐ দিনই তার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের প্রেক্ষাপট তৈরি করে।

জুলাই গণহত্যা বলতে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক পরিচালিত দমনপীড়ন ও ব্যাপক হত্যাকাণ্ডকে বোঝানো হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে দমনের উদ্দেশ্যে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনগুলো সম্মিলিতভাবে এ অভিযান পরিচালনা করে।

আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার দেশব্যাপী ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে এবং গুলি করে হত্যার নির্দেশ দিয়ে কারফিউ জারি করে। এ দমন অভিযানে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সময়ে ১৪০০-এর বেশি মানুষ নিহত হন এবং অসংখ্য মানুষ হতাহত হয়, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন ছাত্র আন্দোলনকারী এবং সাধারণ বেসামরিক নাগরিক। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিও এবং গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা সংঘটিত সহিংসতার ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে। পরবর্তীকালে, বিবিসির একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে একটি যাচাইকৃত অডিও রেকর্ডের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি গুলি করার নির্দেশের প্রমাণ প্রকাশিত হয়। সরকারের পতনের পর, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই হত্যাকাণ্ডের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার ঘোষণা দেয় এবং এ মামলায় সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হন।

ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ দাবির মুখে গত ৫ আগস্ট ‘২৫ প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জাতীয় নেতৃবৃন্দ, শহীদ পরিবারের সদস্য, জুলাই আহত যোদ্ধা, রাজনীতিবিদ ও কূটনৈতিক নেতৃবৃন্দ, মিডিয়া কর্মীদের উপস্থিতিতে ঐতিহাসিক জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এ ঘোষণাকে একটি খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণ বিবৃতি বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন এতে পিলখানায় জঘন্যতম বি. ডি. আর হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বরে গণহত্যা, ২৮শে অক্টোবরে পল্টনে লগি বৈঠা দিয়ে অমানবিকভাবে মানুষ হত্যা এবং বিচারিক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে অন্যায়ভাবে বাংলাদেশের জাতীয় নেতৃবৃন্দকে ফাঁসি দেওয়ার মতো অনেক মানবতাবিরোধী ঘটনাকে উল্লেখ করা হয়নি। এদেশের আলেম-ওলামাদের প্রতি জুলুম নির্যাতনের কথাও এখানে উল্লেখ করা হয়নি।

আমরা আশা করবো, স্বৈরাচারের প্রায় ১৭ বছরের পৈশাচিক ঘটনাবলি প্রকাশ ও দৃষ্টান্তমূলক বিচারের মাধ্যমে জুলাই ঘোষণা ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা অনুযায়ী, দেশ ও জাতিসত্তার স্বকীয় মূল্যবোধ, অবাধ, নিরপেক্ষ গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ হিসেবে বাস্তবায়িত হবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কবি।