খালিদ হাসান বিন শহীদ
ইসলাম সব ধরনের অন্যায়-অপরাধ যেমনÑ চাঁদাবাজি, হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ নির্যাতন, লুটপাট, আধিপত্য বিস্তার, মব জাস্টিস, রক্তপাত, অরাজকতা ও অপকর্ম প্রত্যাখ্যান করেছে। সেই সঙ্গে সৎকর্মের নির্দেশ এবং জুলুম-নির্যাতন থেকে বিরত থাকার নৈতিক শিক্ষা প্রদান করেছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ, দলমত-নির্বিশেষে মানুষের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের চেতনা এবং অপরাধ দমনের নীতি ইসলামকে দিয়েছে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা। ইসলাম শান্তি, সম্প্রীতি ও মানবজাতির জন্য কল্যাণকামী পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ‘ইসলাম’ মানে আত্মসমর্পণ করা। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার মাধ্যমে তার কাছে আত্মসমর্পণ করে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জন করা। মুসলিমদের পরিচয় তুলে ধরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেনÑ ‘প্রকৃত মুসলমান সে ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।’ (বুখারি : ৬৪৮৪)
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ হত্যা : আজকের সমাজে রক্তপাত ও হত্যাকাণ্ডকে তুচ্ছ জ্ঞান করা হচ্ছে। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করা মহাপাপ। প্রত্যেক মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলে ইসলাম। কোনো নিরপরাধ মানুষ হত্যা করা ইসলাম সমর্থন করে না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেনÑ ‘এ কারণেই আমি বনী ইসরাঈলের প্রতি বিধান দিয়েছিলাম, কেউ যদি কাউকে হত্যা করে এবং তা অন্য কাউকে হত্যা করার কারণে কিংবা পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তারের কারণে না হয়, তবে সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারও প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন সমস্ত মানুষের প্রাণরক্ষা করল। বস্তুত আমার রাসূলগণ তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে এসেছে, কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যে বহুলোক পৃথিবীতে সীমালঙ্ঘনই করে যেতে থাকে।’ (সুরা মায়িদা : ৩২) অর্থাৎ কোনও এক ব্যক্তিকে হত্যা করার অপরাধ দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে হত্যা করলে যে অপরাধ হয় তার সমতুল্য। কেননা কোনো ব্যক্তি অন্যায় নরহত্যায় কেবল তখনই লিপ্ত হয়, যখন তার অন্তর হতে মানুষের মর্যাদা সম্পর্কিত অনুভূতি লোপ পেয়ে যায়। আর এ অবস্থায় নিজ স্বার্থের খাতিরে সে আরেকজনকেও হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করবে না। এভাবে গোটা মানবতা তার অপরাধপ্রবণ মানসিকতার টার্গেট হয়ে থাকবে। তাছাড়া এ জাতীয় মানসিকতা ব্যাপক আকার ধারণ করলে সমস্ত মানুষই নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। সুতরাং অন্যায় হত্যার শিকার যে-ই হোক না কেন, দুনিয়ার সকল মানুষকে মনে করতে হবে, এ অপরাধ আমাদের সকলেরই প্রতি করা হয়েছে। নবীজির এ হাদিস থেকেও মানুষ হত্যার ভয়াবহতা প্রতীয়মান হয়। তিনি বলেন- ‘কোনো মুসলিমকে হত্যা করার চেয়ে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাওয়া আল্লাহ তাআলার কাছে অধিক সহজ।’ (তিরমিজি) পরকালে মানুষ হত্যাকারীর পরিণতি হবে খুবই ভয়াবহ। তাকে জাহান্নামের আগুনে পুড়তে হবে। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেনÑ ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে জেনেশুনে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম, যেখানে সে সব সময় থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি গজব নাজিল করবেন এবং লানত করবেন। আর আল্লাহ তার জন্য কঠিন শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।’ (সুরা নিসা : ৯৩)
চাঁদাবাজি হারাম ও কবিরা গুনাহ : চাঁদাবাজি গর্হিত অপরাধ। প্রভাবশালী চক্র জোরপূর্বক কাউকে নিজ কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য অথবা নির্দিষ্ট স্থান অতিক্রম করা ইত্যাদির জন্য নির্দিষ্ট অথবা অনির্দিষ্ট পরিমাণে চাঁদা দিতে বাধ্য করাকে সাধারণত চাঁদাবাজি বলা হয়। চাঁদাবাজি অত্যন্ত ঘৃণিত ও গর্হিত অপরাধ। এটা একধরনের দস্যুতা। ইসলামের দৃষ্টিতে চাঁদাবাজি হারাম ও কবিরা গুনাহ। চাঁদাবাজির কারণে পরকালে ভীষণ শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত সবাই গুনাহগার। চাঁদা উত্তোলনকারী, চাঁদা লেখক ও চাঁদা গ্রহণকারী সবাই ওই গুনাহর সমান অংশীদার। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেনÑ ‘তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ কোরো না এবং এ উদ্দেশ্যে বিচারকের কাছে এমন কোনো মামলা কোরো না যে মানুষের সম্পদ থেকে কোনো অংশ জেনেশুনে গ্রাস করার গুনাহে লিপ্ত হবে।’ (সুরা বাকারা : ১৮৮)
চাঁদাবাজির কঠিন শাস্তি : মহান আল্লাহ বলেনÑ ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধ কিংবা প্রকাশ্য শত্রুতা পোষণ করে অথবা আল্লাহ ও রাসুলের বিধি-বিধানের ওপর হঠকারিতা দেখায় এবং ভূ-পৃষ্ঠে অশান্তি ও ত্রাস সৃষ্টি করে বেড়ায়, তাদের শাস্তি এটাই যে তাদের হত্যা করা হবে অথবা ফাঁসি দেওয়া হবে অথবা এক দিকের হাত এবং অন্য দিকের পা কেটে ফেলা হবে অথবা অন্য এলাকার জেলে বন্দি করে রাখা হবে যতক্ষণ না তারা খাঁটি তাওবা করে নেয়। এটা তাদের জন্য পার্থিব জীবনের প্রাথমিক ব্যবস্থা আর পরকালেও তাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।’ (সুরা : ৩৩)
যে কারণে চাঁদাবাজি হারাম : চাঁদাবাজি যেহেতু কারো কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায় করা, এটি সরাসরি জুলুম বা অন্যায়। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেনÑ ‘তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করো না এবং বিচারকের কাছে এমন কোনো মামলা করো না, যার মাধ্যমে জেনে-বুঝে কারো সম্পদ আত্মসাৎ করো।’ (সুরা বাকারা : ১৮৮) বিশেষত আমাদের দেশে বাজার, স্টেশন, বন্দরসহ বিভিন্ন জায়গায় জনসেবা, জনসভা, খাবার বিতরণ ইত্যাদি অজুহাতে চাঁদাবাজির নামে যা চলে, কিছু মানুষ সম্পূর্ণ অন্যায্য ও অধিকারবহির্ভুতভাবে পেশিশক্তি ব্যবহার করে মানুষের অর্থ লুট করে। ইসলামের দৃষ্টিতে এটা জুলুম; ডাকাতি, ছিনতাই বা চুরির মতোই গর্হিত অপরাধ এবং গুনাহের কাজ। এ প্রক্রিয়ায় যে সম্পদ অর্জন করা হয়, তা নিঃসন্দেহে অবৈধ ও হারাম।
ধর্ষণের শাস্তি : ইসলামি আইনশাস্ত্র মোতাবেক ধর্ষকের শাস্তি ব্যভিচারকারীর শাস্তির অনুরূপ। যেহেতু বিবাহবহির্ভূত যেকোনো যৌন সম্পর্কই ইসলামে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। ফলে ব্যভিচারী ও ধর্ষক উভয়ের জন্যই কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করেছে ইসলাম। কুরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। (সুরা বানি ইসরাইল : ৩২) ধর্ষণের শাস্তির ব্যাপারে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। শাস্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বিষয়টির স্পর্শকাতরতা নিশ্চিত করা হয়েছে। এক হাদিসে আছেÑ রাসুল (সা.)-এর যুগে এক মহিলাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হলে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে কোনোরূপ শাস্তি দেননি, তবে ধর্ষককে হদের শাস্তি দেন। (ইবনে মাজাহ : ২৫৯৮) (উল্লেখ্য, যেসব শাস্তির পরিমাণ ও পদ্ধতি কুরআন-হাদিসে সুনির্ধারিত রয়েছে সেগুলোকে হদ বলে) অন্য হাদিসে আছে, গণিমতের পঞ্চমাংশে পাওয়া এক দাসির সঙ্গে সরকারি মালিকানাধীন এক গোলাম জবরদস্তিপূর্বক ধর্ষণ করে। এতে তার কুমারিত্ব নষ্ট হয়ে যায়। হজরত উমর (রা.) ওই গোলামকে বেত্রাঘাত করেন এবং নির্বাসন দেন। কিন্তু দাসিটিকে বেত্রাঘাত করেননি। (বুখারি : ৬৯৪৯) এ হাদিসের আলোকে স্পষ্ট হয় যেÑ ধর্ষণের ক্ষেত্রে একপক্ষে ব্যভিচার সংগঠিত হয়। আর অন্যপক্ষ হয় নির্যাতিত। তাই নির্যাতিতের কোনো শাস্তি নেই। কেবল অত্যাচারি ধর্ষকের শাস্তি হবে।
শেষ কথা : প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! আসুন আমরা চাঁদাবাজি-হত্যা-ধর্ষণ-জুলুম-অত্যাচারের সংস্কৃতি পরিত্যাগ করি। যাবতীয় অন্যায় অপরাধ থেকে বিরত থাকি। কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত পথে জীবনযাপন করি এবং উভয় জাহানের সফলতা অর্জন করি।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।