প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী
‘তোমাদের যা কিছু দেয়া হয়েছে তা দুনিয়ার জীবনের কয়েক দিনের সামগ্রী মাত্র; আল্লাহর কাছে যা রয়েছে তা যেমন উত্তম-উৎকৃষ্ট তেমনি স্থায়ী, তাদের জন্য যারা ঈমান আনে ও তাদের রবের ওপর নির্ভর করে। যারা বড়ো বড়ো গুনাহ ও অশ্লীল কার্য থেকে বিরত থাকে এবং ক্রোধান্বিত হলে ক্ষমা করে। যারা তাদের রবের আহবানে সাড়া দেয়, নামাজ কায়েম করে, পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে কার্য সম্পাদন করে এবং আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে। যারা অত্যাচারিত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে। অন্যায়ের প্রতিবিধান সমপরিমাণ অন্যায়। অতঃপর যে ক্ষমা করে দেয় ও সংশোধন করে নেয় তার পুরস্কার আল্লাহর জিম্মায়। আল্লাহ জালেমদের পছন্দ করেন না।’- সুরা আশ শূরা ৩৬-৪০।
নামকরণ : সুরার ৩৮ নং আয়াত ‘ওয়া আমরুহুম শূরা বায়নাহুম’ থেকে এর নাম গৃহীত হয়েছে। এটি কোনো শিরোনাম নয়, পরিচিতি মাত্র।
নাজিল হওয়ার সময়কাল : রসুল সা.-এর মক্কি জীবনের শেষের দিকে হামীম আস সাজদার পরপরই এই সূরাটি অবতীর্ণ হয়। ঈমান আনার ফলে সে সময়ে অনেক ঈমানদারের জীবন সংকীর্ণ হয়ে পড়েছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য ও চলাফেরায় তারা নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছিলো। দুনিয়ার প্রতি মোহ অর্থাৎ অর্থবিত্ত ও প্রভাব-প্রতিপত্তির নেশায় মানুষ পাগল হয়ে পড়ে। ফলে সে বৈধ-অবৈধের বাছ-বিচার ভুলে যায়; এমনকি প্রতিপক্ষকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া বা অর্থের লোভে চরম জুলুম-নির্যাতনেও পরোয়া করে না। এসবই সম্ভব পরকালে বিশ্বাস না থাকার কারণে। এমতাবস্থায় মুমিনদের আখিরাতে অনন্তকাল সুখ-স্বাচ্ছন্দের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে এবং তা লাভের জন্য একজন ব্যক্তির মধ্যে কী কী গুণ থাকার প্রয়োজন সেটাও উল্লেখ করা হয়েছে।
ব্যাখ্যা : ৩৬. আখিরাতের জীবনের সাথে দুনিয়ার জীবনের কোনো তুলনা সম্ভব নয়। আখিরাতের জীবন অনন্তকালের যার কোনো সমাপ্তি নেই। পক্ষান্তরে দুনিয়ার জীবন খুবই ক্ষণস্থায়ী। আমাদের গড় আয়ুষ্কাল ৬০-৭০ বছর এবং এর বেশি যে জীবন তা রোগ-শোকে জরাজীর্ণ, বিড়ম্বনাপূর্ণ। সাগরে আঙ্গুল ডুবিয়ে তুললে যতটুকু পানি ওঠে তা সাগরের পানির তুলনায় সহস্র কোটি কোটি ভাগের একটি অংশ হতে পারে, কিন্তু আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন কোনভাবেই তুলনীয় নয়। তাই এ পৃথিবীতে একজন মানুষ যত সম্পদই অর্জন করুক না কেন তা ভোগ করার জন্য দীর্ঘ হায়াত তার নেই। তারপরও হায়াতটা কতটুকু তা তার জানা নেই। তাই সবসময় তাকে এক অজানা আশঙ্কায় ভুগতে হয়। এ ছাড়া নানাবিধ রোগ-ব্যাধি ও স্বাস্থহানির আশঙ্কায় তার মন যা চায় তা সে ভোগ করতে পারে না। পক্ষান্তরে আখিরাতের জীবন হলো স্থায়ী এবং সেটা উপভোগের জায়গা। ভোগের জন্য রয়েছে অফুরন্ত সামগ্রী-আল্লাহর ভাষায় তা যেমন উত্তম উৎকৃষ্ট, তেমনি স্থায়ী। জান্নাতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ভোগ ও বিচরণের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা দেবেন। তাঁর ভাষায়-যা চাবে তাই পাবে এবং যা ইচ্ছা করবে সেটাই হবে।
৩৭. আখিরাতে অনন্তকালের সুখ ভোগের জন্য বান্দার মধ্যে সর্বপ্রথম যে গুণটি প্রয়োজন তা হলো আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তাঁর ওপর নির্ভরতা। আখিরাতে কাফেরের জন্য রয়েছে অনন্তকালের জাহান্নামের শাস্তি। পক্ষান্তরে জান্নাতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ রয়েছে কেবল মুমিনদের জন্য, যে মুমিনের গুণাবলি এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। ঈমান আনার সাথে সাথে একজন মুমিনের জীবনে কিছু গুণগত পরিবর্তন শুরু হয়ে যায়-তা তার আয়-উপার্জনে, সম্পদের ব্যয়-ব্যবহারে, আচার-আচরণে, লেন-দেনে, দায়িত্ব পালনে (তাদের রবের আহবানে সাড়া দেয়, এই কথার মধ্যে তাই প্রকাশ পায়), সর্বোপরি ইসলামের দুশমনদের নিপীড়ন-নির্যাতনে। কেবল আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতাই পারে তাকে ঈমানের পথে টিকে থাকতে। তাদের রবের আহবানে সাড়া দেয়-এ কথার মধ্যে সবকিছু চলে আসলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বড়ো বড়ো গুনাহ (অর্থাৎ কারো অধিকার হরণ- তা আল্লাহর হোক বা বান্দার হোক। খুন-ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই, ওজনে কম-বেশি বা ভেজাল প্রদান, গীবত, কারো সম্মানহানি, মিথ্যা সাক্ষ্যপ্রদান সবই কবিরা গুণাহ) ও অশ্লীল কার্য থেকে বিরত থাকা। সব ধরনের অশ্লীল কার্যই কবিরা গুনাহ। তারপরও এটাকে আলাদাভাবে উল্লেখ করে আল্লাহ বোঝাতে চেয়েছেন যে তাঁর মুমিন বান্দারা সবধরনের অশ্লীলতা থেকে মুক্ত থাকে। সমাজে অশ্লীলতা ছড়িয়ে দেয়া শয়তানের কাজ। শয়তানের অনুচররা ফেসবুক, বই-পত্র, পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশন-সিনেমা সবখানেই অশ্লীলতা ছড়িয়ে দেয় বা সহযোগিতা করে, শয়তানের দোসর হিসেবে এ কাজে তারা প্রচুর আনন্দ পায়।
মানুষ তার মনের মতো করে কিছু না পেলে ক্রোধান্বিত হয়ে পড়ে। এ রাগ-অভিমান জীবনের সকল ক্ষেত্রে। শিক্ষক পাঠদানে তার শিক্ষার্থীকে তাঁর মতো করে না পেলে, স্বামী-স্ত্রী বা পিতা/মাতা-সন্তান, অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী, বাসায় গৃহিনী-কাজের বুয়ার আচরণ বা দায়িত্ব পালনে ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটলে মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় আল্লাহ তাঁর মুমিন বান্দাদের উদার ও ক্ষমাশীল হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। ক্রোধ উদ্রেগ হলে মানুষ তার স্বাভাবিক জ্ঞানবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে এবং এমন আচরণ করে বসে যা একজন ঈমানদারের কাছ থেকে কাম্য নয়। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, মল্লযুদ্ধে যে বীর সে বীর নয় বরং সেই বীর যে ক্রোধের সময় নিজেকে সংবরণ করে। ক্রোধ সংবরণে ব্যর্থ হয়ে মানুষের জীবনে অনেক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে- স্বামী/স্ত্রীর বিচ্ছেদ, সন্তান ও পিতামাতার মাঝে সম্পর্কে ফাটল, এমনকি আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটে যায়। জান্নাতি লোকদের গুণের মধ্যে আল্লাহপাক বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, কোনো কারণে তাদের মাঝে ক্রোধ উদ্রেগ হলে ক্ষমা করে দেয়। ক্ষমা মুমিন জীবনের খুব বড়ো গুণ। যার মধ্যে ক্ষমাশীলতা রয়েছে সে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত। আর যে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত সে জান্নাতি।
৩৮. রবের আহবানে সাড়া দেয় ব্যাপক অর্থপূর্ণ। আল্লাহপাক অন্যত্র মুমিনদের পেশ করেছেন এভাবে, ‘আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম’। আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা.-এর প্রতিটি নির্দেশ কোনো প্রশ্ন ছাড়াই মুমিনের মেনে চলা অবশ্য কর্তব্য। এর মধ্যে নামাজ-রোজাসহ সব ইবাদত চলে আসলেও আলাদাভাবে নামাজের কথা উল্লেখ করায় এর বিশেষ গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। সাথে সাথে এটাও বোঝা যায় এ নামাজই মানুষকে স্মরণ করে দেয়, সে আল্লাহর গোলাম এবং গোলামির মধ্যেই রয়েছে তার কল্যাণ এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সাফল্য। আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণার সাথে নামাজের দিকে এসো, কল্যাণের দিকে এসো-এ আহবানে মুমিন দৈনিক পাঁচবার মসজিদে হাজিরা দিয়ে প্রমাণ করে, সে আল্লাহর গোলাম এবং কিবলামুখী হয়ে হাত বেঁধে প্রতিশ্রুতি প্রদান করে, ‘আমরা তোমরাই গোলামী করি, তোমারই কাছে সাহায্য চাই; আমাদের সরল সঠিক পথে পরিচালিত করো’।
‘পারস্পরিক পরামর্শের মাধ্যমে কার্য সম্পাদন করে’-এ কথা দ্বারা মুমিনের চরিত্র বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে তারা স্বৈরাচার বা ডিক্টেটর নয়। যেখানেই একাধিক ব্যক্তির স্বার্থসংশ্লিষ্টতা রয়েছে সেখানেই পরামর্শ। পরিবারে, সমাজে, অফিস-আদালতে, রাষ্ট্রে সর্বত্রই পরামর্শের ভিত্তিতে কার্য সম্পাদন করলে সে কাজে সংশ্লিষ্টরা উৎসাহ পান এবং তাতে পরস্পরের সম্পর্ক দৃঢ় হয়। পরিবারে স্বামী-স্ত্রী পরামর্শ করবে এবং সন্তান বড়ো হলে তাকেও পরামর্শে শরীক করবে। এমনটি হলে সে পরিবারে শান্তি-স্বস্তি বজায় থাকে। আল্লাহপাক তাঁর রসুল সা.-কে তাঁর সাথিদের সাথে পরামর্শ করার জন্য বলেছেন এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হলে তাতে দৃঢ় থাকার জন্যও তাগিদ দিয়েছেন। কুরআনের এ আয়াত মানুষকে গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। জোর-জবরদস্তি করে ক্ষমতা দখল এবং টিকে থাকার প্রচেষ্টাকে নাকচ করে দেয়। জীবনের সকল পর্যায়ে জনগণের সম্মতি প্রয়োজন।
আমি যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে। মুমিন হয় উদার ও প্রশস্ততার অধিকারী। কার্পণ্য মুমিনের স্বভাববিরুদ্ধ। তার সম্পদে নিজের ও পরিবারের যেমন অধিকার রয়েছে, সাথে সাথে তার আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম-মিসকিন ও সমাজেরও হক রয়েছে। সর্বোপরি আল্লাহর দীনের প্রয়োজনেও সে হবে উদারহস্ত।
৩৯-৪০. মুমিন ভীরু ও কাপুরুষ নয়। অত্যাচারিত হলে সে বদলা গ্রহণ করে। বদলা গ্রহণের ক্ষেত্রে সে বাড়াবাড়ি করে না। অর্থাৎ গালির জবাবে থাপ্পড় নয় বা লাঠির আঘাতের পরিবর্তে বন্ধুকও নয়। বদলা গ্রহণ হতে হবে সমপর্যায়ের। অবশ্য আল্লাহ বদলা গ্রহণের চেয়ে ক্ষমা করাটাকে বেশি পছন্দ করেছেন। প্রতিশোধ গ্রহণ সমাজে ফিতনা-ফাসাদ বাড়ায়, আর আল্লাহপাক চান, সমাজ থেকে ফিতনা-ফাসাদ লোপ পাক। অত্যাচারিত হওয়ার পর কেউ প্রতিশোধ গ্রহণ না করে ক্ষমা করে দিলে তাকে পুরস্কৃত করার দায়িত্ব আল্লাহ নিজে গ্রহণ করেছেন। তাই একজন মুমিন কোনো ধরনের পেরেশানি ছাড়াই জালেমকে ক্ষমা করতে পারে। কারণ সে জানে, আল্লাহ নিজের থেকে জালেমের প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন এবং তাকে এর বিনিময়ে ক্ষমা করবেন। আবার বান্দার পক্ষ থেকে এই ক্ষমা করাকে আল্লাহ সাহসিকতাপূর্ণ কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যত্র বলেছেন এ গুণ কেবল তারাই অর্জন করতে পারে যারা অতি ভাগ্যবান।
শিক্ষা : দুনিয়ার জীবনটা খুবই ক্ষণস্থায়ী। লোভ-লালসায় মত্ত হয়ে এটিকে পাওয়ার জন্য মানুষ ন্যায়-অন্যায় ভুলে গিয়ে পাগলপ্রাণ হয়ে ছুটে। অথচ এগুলো খুবই স্বল্পস্থায়ী। ৫ই আগস্ট পরবর্তী জীবনে জালেমদের পরিণতি আমরা চাক্ষুস লক্ষ করলাম। আখেরাতে তো ভয়াবহ পরিণতি রয়েছেই। মক্কায় অবতীর্ণ এই সুরায় কাফের-মুশরিকদের স্বল্পকালীন বিলাসী জীবন-যাপনের মোকাবেলায় ঈমানদারদের সুখবর প্রদান করা হয়েছে আখেরাতের উত্তম ও স্থায়ী জীবনের। যে মুমিনদের জন্য আখেরাতে মনভোলানো এতো আয়োজন সেই মুমিনদের কিছু গুণাবলী এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত ঈমানের কারণেই এসব গুণের সমাবেশ ঘটে মুমিনদের মাঝে। আল্লাহপাক আমাদের মাঝে মুমিনসুলভ গুণাবলী দান করুন।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক।