আসিফ আরসালান

গত ১৭ অক্টোবর ২৪টি রাজনৈতিক দল জুলাই সনদ স্বাক্ষর করেছে। আরো স্বাক্ষর করেছেন স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সকল সদস্য। স্বাক্ষর অনুষ্ঠান সমাপ্ত হওয়ার পর বিএনপি বেজায় উল্লসিত। তাদের কথা বার্তা এবং ভাবসাবে মনে হয়েছিলো যে তারা বিশ্ব জয় করেছে। এখন আর ইলেকশনের পথে কোনো বাধা নেই। মাত্র ৪ মাস পরেই তারা বাংলাদেশের তখতে তাউসে আরোহণ করছেন। ভাবতে অবাক লাগে যে বিএনপি নিজেকে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বলে জাহির করলেও ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার বিপ্লবের থেকে তারা কোনো দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারেনি। আপনারা কি ভাবতে পারেন যে, ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেন, আর মাত্র ১ দিন পর ৭ অগাস্ট বিএনপি নয়াপল্টনে জনসভা করে পরবর্তী ৩ মাসের মধ্যে ইলেকশন দাবি করে বসে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, মাত্র ১ দিন পর ৭ অগাস্ট ইলেকশনের দাবি তোলার মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থান বিপ্লব ইত্যাদি সম্পর্কে বিএনপির জ্ঞানের দৈন্যই প্রকাশ পায়। ৭ অগাস্ট কিন্তু দেশ সরকার শূন্য ছিলো। তাহলে সেদিন বিএনপি কার কাছে ইলেকশন দাবি করেছিলো? অন্তর্বর্তী সরকার তো গঠন হয় পরের দিন, অর্থাৎ ৮ অগাস্ট রাত ৮ ঘটিকায়।

একই ভাব প্রকাশ করছে তারা ১৭ অক্টোবর জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পর। জুলাই সনদ স্বাক্ষরের আগে তো চলতি বছরের ৫ অগাস্ট জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় তথা মানিক মিয়া এভিনিউতে একটি বড় জনসভায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। কি অবাক ব্যাপার, কোনো কোনো পলিটিশিয়ান এবং রাজনৈতিক পণ্ডিত ঐ জুলাই ঘোষণাপত্রের ২২ অনুচ্ছেদ মোতাবেক জুলাই সনদের বাস্তবায়ন দাবি করছেন। প্রিয় পাঠক, আমি দেখেছি যে, অনেক ব্যক্তিই জুলাই ঘোষণাপত্র এবং জুলাই সনদ গুলিয়ে ফেলেন। তারা দুটোকে একই জিনিস মনে করেন। আসলে দুটি সম্পূর্ণ আলাদা ডকুমেন্ট।

যা বলছিলাম। ১৭ অক্টোবর জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পরেও আরো অনেক পথ পাড়ি দেওয়া বাকি আছে। এটি সম্ভবত বিএনপি নেতারা বুঝতে পারেননি। জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপি শুরু থেকেই বলে আসছে যে, জুলাই ঘোষণাপত্রই বলুন আর জুলাই সনদ বলুন, দুটোকেই আইনি ভিত্তি বা সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। অন্যথায় এ দুটি ঘোষণা বা সনদই স্রেফ কাগজের টুকরা হয়ে থাকবে। জুলাই ঘোষণাপত্র পঠিত হয়েছে। কিন্তু সেটিকে আইনি ভিত্তি না দেওয়া পর্যন্ত তার ২৮টি অনুচ্ছেদের একটিরও কোনো আইনি জোর নেই। অনুরূপভাবে জুলাই সনদে ৩৩টি দল মিলে ৮৪টি প্রস্তাব বা সুপারিশ করলেও আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে এখন পর্যন্ত সেগুলির এক পয়সাও মূল্য নেই।

অপ্রিয় হলেও একথা সত্য যে, জুলাই সনদ অনেক স্ববিরোধিতায় ভরা। আমি জুলাই সনদ ঘেঁটে হিসাব করে বের করেছি যে, ৪৭টি নয়, সনদের ৫৮টি অনুচ্ছেদে নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি রয়েছে। কোনো কোনোটিতে আপত্তি ৬ থেকে ৯টি দলের। আবার কোনোটিতে আপত্তি ১টি মাত্র দলের। আবার ২/৩টি প্রস্তাবে ২/১টি দল কোনো মন্তব্য করেনি। এসব মিলে ৮৪টি প্রস্তাবের মধ্যে ৫৮টি প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি দেওয়া হয়েছে। ৫৮টি নোট অব ডিসেন্ট সম্বলিত কোনো দলিল কি দেশের সংবিধানের অংশ হতে পারে? অথচ বিএনপি এ জটিল বিষয়ের সমাধান না করেই নির্বাচন চাচ্ছে।

আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যেই ইলেকশন হোক, তাতে অন্য কোনো দলের যেমন আপত্তি নেই, তেমনি জামায়াতে ইসলামীরও কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু জামায়াত চায়, ইলেকশনের আগেই আইনের সঠিক ব্যাখার মাধ্যমে জুলাই সনদ একটি আইনি ভিত্তি পাক। জামায়াতের তরফ থেকে এ্যাডভোকেট শিশির মনির বিষয়টি প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন।

একটি টকশোতে এ্যাডভোকেট শিশির মনির জানিয়েছেন যে, স্বাক্ষর শেষে ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ সবকটি রাজনৈতিক দলকে কথা দিয়েছিলেন যে, এখন তারা ইমপ্লিমেন্টেশনের বা সনদ বাস্তবায়নের মেকানিজম ঠিক করবেন। এ মেকানিজম বা পদ্ধতি কী হবে? তিনি মৌখিকভাবে যে আউটলাইন দিয়েছিলেন, সেটি মোতাবেক, প্রথমে জারি করা হবে একটি বিশেষ আদেশ বা ফরমান। অতঃপর ঐ ফরমানের ভিত্তিতে একটি গণভোট হবে। এর পর হবে নতুন পার্লামেন্টের নির্বাচন। নতুন পার্লামেন্টের থাকবে Constitution Power অর্থাৎ সংবিধান সংশোধন অথবা নতুন নতুন অনুচ্ছেদ অন্তর্ভূক্ত করার ক্ষমতা। এটিকে বলা হয়, পার্লামেন্টের Dual Role বা দ্বৈত ভূমিকা। যেদিন পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন বসবে সেদিন থেকে পরবর্তী ১৮০ দিন বা ৬ মাস, অথবা ২৭০ দিন বা ৯ মাস সময় এককভাবে সংবিধান সংশোধন বা নতুন অনুচ্ছেদ অন্তর্ভূক্ত করার কাজে ব্যায়িত হবে। এ সময় পার্লামেন্টকে বলা যেতে পারে গণপরিষদ। অবশ্য ইদানিং গণপরিষদকে অনেকে নতুন নামে ডাকছেন। সে নতুন নাম হলো সংবিধান সভা। যে নামেই ডাকুন, ৬ মাস বা ৯ মাস পর অর্থাৎ সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনের পর পার্লামেন্টের Constitution Power অর্থাৎ সংবিধান সংশোধন করার ভূমিকা শেষ হয়ে যাবে এবং গণপরিষদ বা সংবিধান সভা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই স্বাভাবিক পার্লামেন্ট বা জাতীয় সংসদ হিসাবে কাজ করবে।

তবে এ সংবিধান সভা বা পার্লামেন্ট গঠন অর্থাৎ সাধারণ নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকার একটি বিশেষ আদেশ দেবে। এখন যদিও বলা হচ্ছে বিশেষ আদেশ, আসলে এটি এতদিন ধরে চলে আসছিলো ‘ফরমান’, এ নামে। যাহোক এ ফরমান জারিই হবে Provisional Constitution Order বা অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান ফরমান। এ ফরমানের অধীনেই হবে গণভোট। এ ফরমানেই পরিস্কারভাবে ব্যাখা করা হবে যে কিভাবে, কোন পদ্ধতিতে, কোন কোন প্রশ্নে অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। প্রফেসর আলী রিয়াজ ১৭ অক্টোবরের আগে যেমন ৬ জন সংবিধান বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়েছিলেন, তেমনি ১৭ অক্টোবরের পরেও তিনি তাদের মূল্যবান পরামর্শ নিচ্ছেন। এখনকার পরামর্শ প্রধানত এ বিষয়টিকে ঘিরে যে কিভাবে জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়া হবে বা সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হবে।

এবার বিশেষজ্ঞরা আইনের সঠিক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একেবারে নাড়ি ধরে টান দিয়েছেন। তারা বলছেন যে, সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার ভিত্তি হবে জুলাই অভ্যুত্থান বা জুলাই বিপ্লব। গত ৪/৫ দিনের প্রধান দৈনিক গুলোতে প্রকাশিত খবর মোতাবেক, বিশেষজ্ঞরা পরিস্কার বলেছেন যে, ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই বিপ্লব থেকে জন্ম নিয়েছে। অর্থাৎ বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানই হলো দেশের সর্বোচ্চ আইন। এ আইনের উৎস হলো জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছা।

তাদের মতে এ সরকারের ক্ষমতার ভিত্তি যদি হয় সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সুপ্রীমকোর্টের মতামত, তাহলে অনেক জটিল সমস্যার উদ্ভব ঘটবে। উল্লেখ করা যেতে পারে, বিএনপি বলছে, উDoctrine of necessity অনুযায়ী অনুচ্ছেদ ১০৬ মোতাবেক সুপ্রীমকোর্টের মতামতের ভিত্তিতে এ সরকার গঠিত হয়েছে। বিএনপির মতে তাই এটি একটি সাংবিধানকি সরকার, বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান উদ্ভূত সরকার নয়। ৬ জন সংবিধান বিশেষজ্ঞ তাই প্রশ্ন তুলেছেন যে, যদি এটি বর্তমান সংবিধানের অন্তর্গত একটি সরকার হয় তাহলে সে সংবিধান মোতাবেক জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা। সেটি কি হয়েছে? এখন তো দেখা যাচ্ছে গত বছরের ৬ অগাস্ট জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর আগামী বছরের মধ্য ফেব্রয়ারি, অর্থাৎ ১৮ মাস পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ৩ মাসের জায়গায় ১৮ মাস পর নির্বাচন অনুষ্ঠানের কৈফিয়ত কে দেবে?

আরো অনেক কথাই আছে। সংবিধানে কি ইন্টারিম সরকার বলে কোনো ব্যবস্থা আছে? উপদেষ্টা পরিষদ বলে কোনো সরকার আছে? কিন্তু এগুলো তো এখন বাস্তব। সেজন্য প্রথমে ঠিক করতে হবে যে ইন্টারিম সরকারের ক্ষমতার উৎস কি? ক্ষমতার উৎস হলো জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছা, যে ইচ্ছা প্রকাশিত হয়েছে জুলাই বিপ্লব বা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে।

এ্যাডভোকেট শিশির মনিরের মতে, জনগণের সে সার্বভৌম ইচ্ছা মোতাবেক বিশেষ আদেশ জারি হবে। সে বিশেষ আদেশের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। সে গণভোটে নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি বলে কিছু থাকবে না। কারণ পৃথিবীর কোথাও নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তির ওপর গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার নজির নেই। এজন্য জুলাই সনদকে আবার পরিমার্জন করতে হবে। এই পরিমার্জিত সনদের ওপর গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। গণভোটের ওপর জনগণ যে রায় দেবেন সেটি উপেক্ষা করার কোনো ক্ষমতা আগামী পালার্মেন্টের থাকবে না, সেটি যে দলই পার্লামেন্টে মেজরিটি পাক না কেনো ।

এনসিপি কেনো ১৭ অক্টোবর জুলাই সনদে সই দেয়নি, সেটিও তারা ব্যাখ্যা করেছে। তারা বলেছেন যে, সরকার কথা দিয়েছিলো যে, জুলাই ঘোষণাপত্র পঠিত হওয়ার পূর্বে সরকার তাদেরকে সে ঘোষণাপত্রের ড্রাফট বা খসড়া দেখাবে। কিন্তু তাদেরকে যে খসড়া দেখানো হয়েছিলো, বাস্তবে ঘটলো তার বিপরীত। যে ঘোষণাপত্রটি ৫ অগাস্ট মানিক মিয়া এভিনিউতে পাঠ করা হলো তার সাথে ঐ খসড়ার কোনো মিল নেই। একারণেই এনসিপির তরফ থেকে বলা হচ্ছে যে, জুলাই সনদ নিয়ে তাদের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে।

ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। তাই এবার জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপি উভয়েই দেখতে চায়। ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া ওয়াদা মোতাবেক বিশেষ আদেশ যদি প্রণয়ন করা হয় এবং সে মোতাবেক যদি গণভোট করা হয় তাহলে বিএনপির কোনো আপত্তি নেই। গণভোটে যে রায় হবে, পরবর্তীতে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পার্লামেন্ট সে রায় মোতাবেক সংবিধানের সংশোধন, পরিমার্জন বা বিয়োজন করবে। ঠিক এ কারণেই জামায়াত চায়, আগে গণভোট, তারপর জাতীয় নির্বাচন। পক্ষান্তরে বিএনপি চায় একই দিনে গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচন। বিএনপির কথা মতো একই দিন নির্বাচন এবং গণভোট দুটোই যদি হয় তাহলে গণভোটের স্পিরিটই নস্যাৎ হয়ে যাবে।

একটি কথা মনে রাখা দরকার যে, জুলাই ঘোষণাপত্র বলি আর জুলাই সনদ বলি, যেটাই বলি না কেনো, সে সব ডকুমেন্টে সুস্পষ্টভাবে সংবিধানে এই গ্যারান্টি থাকতে হবে ইচ্ছা করলেও কেউ আর শেখ হাসিনার মতো ফ্যাসিবাদি স্বৈরাচার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। কেউ আর ইচ্ছা করলেই ভারত যেভাবে সরকারের ওপর আধিপত্য নয়, রীতিমতো প্রভূত্ব করেছে, ভবিষ্যতে যেনো কেউ আর বাংলাদেশের ওপর ছড়ি ঘোরাতে না পারে। সে গ্যারান্টি সংবিধানে থাকতে হবে।

Email:[email protected]