ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন সবসময়ই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এ নির্বাচনকে অনেকেই জাতীয় রাজনীতির ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবি বলে অভিহিত করেন। কারণ, ডাকসু কেবল একটি ছাত্র সংসদ নয়Ñএটি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গড়ে ওঠা নেতৃত্ব অতীতে জাতীয় নেতৃত্বের ধারায় অবদান রেখেছে। এবারের বহুল আলোচিত ডাকসুর নির্বাচনে সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট ঐতিহাসিক বিজয় লাভ করেছে। ভিপি, জিএস, এজিএসসহ অধিকাংশ সম্পাদক পদে জয়ী হয়ে ছাত্রশিবির জুলাই বিপ্লব পরবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। একইভাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন জাকসুতেও ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল বিপুল জয় পেয়েছে। জিএস, এজিএসসহ ২৫টিা মধ্যে ২০টি পদে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্রার্থীরাই জয় পেয়েছেন।
এবারের ডাকসু নির্বাচনে সাদিক কায়েম ১৪ হাজার ৪২ ভোট পেয়েছেন, যেখানে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান মাত্র ৫ হাজার ৭০৮ ভোট পান। একইভাবে জিএস পদেও ছাত্রশিবিরের এস এম ফরহাদ ১০ হাজারের বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। এজিএস পদে ছাত্র সমাজের প্রিয় মেধাবি মুখ মোহাম্মাদ মহিউদ্দিন খান ১১ হাজার ৭শ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। মাত্র তিনটি ছাড়া অধিকাংশ সম্পাদক পদেও ছাত্রশিবিরের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। একইভাবে, জাকসু নির্বাচনেও ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী, ভিপি পদে জয় পেয়েছেন আবদুর রশীদ জিতু। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ছিলেন। জিএস পদে জয় পেয়েছেন মাজহারুল ইসলাম। শিবির সমর্থিত প্যানেল সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের দফতর ও প্রকাশনা সম্পাদক। এছাড়া, এজিএস (পুরুষ) নির্বাচিত হয়েছেন ফেরদৌস আল হাসান ও এজিএস (নারী) আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা।
উভয় বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের এ প্যানেলের সাথে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা কানেক্ট করতে পেরেছিল কেননা এ প্যানেলের প্রার্থীরা ছিল তাদেরই নিকটজন। এখানে কোনো আদুভাইকে প্রার্থী করা হয়নি। প্রতিটি প্রার্থী জুলাই বিপ্লবে সক্রিয় ছিলেন। জুলাই বিপ্লব পরবর্তী এক বছরে তারা নিরন্তর ছাত্রদের পাশে ছিলেন। গঠনমূলক ও ছাত্রবান্ধব সব প্রোগ্রাম করেছেন। নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। প্রতিপক্ষের নির্লজ্জ মিথ্যাচারের মুখেও সংযত ছিলেন, কটু কথা বলেননি। সস্তা কথা বলে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টা করেননি। এ কারণে তারা ছাত্রজনতার বিপুল সমর্থন পেয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকেই ছাত্রশিবিরের জন্ম ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়াফর। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ছাত্রশিবিরকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে দেয়া হয়নি। ছাত্রশিবির এর আগেও ১৯৮২ সালে ডাকসু নির্বাচনে প্যানেল দিয়েছিল। সে প্যানেলের প্রচার প্রচারণার শেষদিনে বোমা হামলা চালিয়ে বামপন্থী সংগঠনগুলো শিবিরের অসংখ্য নেতাকর্মীকে আহত করে। অনেকের হাত পা উড়ে যায়। শিবির ডাকসুতে প্যানেল দিয়েছিল ’৯০ এর দশকেও। স্বৈরাচার আন্দোলনের পর যখন মুক্ত গণতান্ত্রিক আবহ তৈরি হওয়ার কথা ছিল, তখনই শিবিরের বিরুদ্ধে শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র। তথাকথিত পরিবেশ পরিষদের সিদ্ধান্তের নামে বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট, সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলকে পাশ কাটিয়ে অবৈধ একটি ফোরাম দিয়ে সামাজিক চুক্তির আওতায় শিবিরের প্রকাশ্য কাজ ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ করা হয়। যদিও এরপর থেকেও ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসে ছিল, ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষকেরা শিবিরের নেতাকর্মীদের চিনতেন কিন্তু সেভাবে তারা আর প্রকাশ্যে কাজ করতে কিংবা ডাকসুতে প্যানেল দিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রশিবিরের কর্মীরা জীবন দিয়েছেন; অনেককে নাম পাল্টে ভিন্ন নামে ক্যাম্পাসে থাকতে হয়েছে, অনেকের মাথা ইট দিয়ে থেতলে দেয়া হয়েছে, শিবির কানেকশন প্রকাশ্যে আসায় অসংখ্য ছাত্রকে টিসি দিয়ে বহিষ্কার করা হয়েছে, অনেককে দীর্ঘদিন জেলে থাকতে হয়েছে, টাখনুর ওপর প্যান্ট পরার কারণে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীকে রাতভর পেটানো হয়েছে।
ঐতিহাসিক বাস্তবতা হলো, জুলাই বিপ্লবের নেপথ্যে তৃণমূলে কার্যক্রম পরিচালনা, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সমন্বয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবির ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। বিপ্লবের পরপর শিবিরের এ ভূমিকা যখন প্রকাশ্যে আসে তখনই লাইমলাইটে চলে আসেন শিবিরের তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতি আবু সাদিক কায়েম ও বর্তমান সভাপতি এস এম ফরহাদের মতো প্রতিশ্রুতিশীল ছাত্রনেতারা। ছাত্রশিবিরের এবারের প্যানেলটি ছিল মেধাবীদের মিলনমেলা। এজিএস পদে যে মহিউদ্দিন খানকে মনোনয়ন দেয়া হয় তিনি তার বিভাগের সবচেয়ে ভালো ফলাফল করা ছাত্র। একইভাবে ক্যারিয়ার ও ডেভেলপমেন্ট বিষয়ক সম্পাদক মাজহারুল ইসলামের ফলাফলও চমক লাগানো। এর বাইরে ছাত্রশিবিরের প্যানেলে উপজাতি কোটা থেকে ছাত্র মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। হিজাবী ও নন-হিজাবী মেয়েদের মনোনয়ন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। জুলাই বিপ্লবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র আহত ছাত্র খান জসিমকেও মনোনয়ন দিয়েছে ছাত্রশিবির। বৈচিত্র্যময় এবং ছাত্র সমাজের সকল প্রতিনিধিকে প্যানেলে নেয়ার এ বিষয়টি সাধারণ ছাত্ররা ইতিবাচকভাবে নিয়েছে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন। সবচেয়ে বড়ো কথা, বিভিন্ন ধরনের ছাত্র প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করায় শিবিরের এ প্যানেলটির নামকরণ হয়েছে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট। আর এভাবে একীভূত একটি এপ্রোচ নিয়ে অগ্রসর হওয়ার কারণে তারা দলের বাইরে বিপুল সংখ্যক ছাত্রের সমর্থন নিশ্চিত করতে পেরেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের ভূমিধস বিজয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা সামনে এনেছেÑআর তাহলো আদর্শবাদী দলকে কখনোই নির্যাতন, প্রোপাগান্ডা বা মার্জিনালাইজড করে পরাজিত করা যায় না। আওয়ামী লীগ আমলে ছাত্রশিবিরই ছিল সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ও দমন-পীড়নের শিকার ছাত্র সংগঠন। ক্যাম্পাসে তাদের কর্মকাণ্ড দমন করা হয়েছে, নেতাকর্মীদের ওপর চালানো হয়েছে হামলা ও মামলা, এমনকি সংগঠনটিকে জনমনে হেয় করার জন্য লাগাতার প্রচারণা চালানো হয়েছে। ডাকসু নির্বাচনেও প্রায় সব প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন একজোট হয়ে শিবিরবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছে। বিভিন্ন প্রার্থীর ভাষণে, পোস্টারে, এমনকি অনলাইনেও প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয়।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ গত সাড়ে ১৫ বছর যে ধরনের কথাবার্তা বলে শিবিরকে কোণঠাঁসা করার চেষ্টা করেছে সেই একই বয়ানগুলো পুনরায় ছাত্রশিবিরের প্রতিপক্ষরা ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের এই প্যানেলের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছে। রাজাকার, স্বাধীনতা বিরোধী, পাকিস্তানী- এসব নামে ছাত্রশিবিরের তরুণ প্রার্থীদের নিরবচ্ছিন্নভাবে সম্বোধন করে গেছে।
শুধু তাই নয়, দেশের মূলধারার অধিকাংশ গণমাধ্যমও শিবিরের প্রার্থীদের সাফল্যকে আড়াল করার চেষ্টা করেছে। তারা নির্বাচনী প্রচারণায় সংগঠনের ইতিবাচক কার্যক্রম বা শিক্ষার্থীদের সমর্থনের চিত্র খুব কমই তুলে ধরেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ভোটে প্রমাণিত হলোÑমিথ্যা প্রচারণা ও কুৎসা রটনা দিয়ে আদর্শবাদী শক্তিকে দমিয়ে রাখা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ সকল বিভ্রান্তি প্রত্যাখ্যান করে শিবিরকেই বেছে নিয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ যে ভাষায় শিবিরের বিরুদ্ধে বলতো, অন্যান্য দলের নেতাদের মুখে সেই একইভাষা নতুন বাংলাদেশে ছাত্রছাত্রীরা মেনে নেয়নি। বিপুল ব্যবধানে সাদিক কায়েম ও এস এম ফরহাদের বিজয় কিংবা জাহাঙ্গীরনগর ছাত্র সংসদে ২০টি পদসহ জিএস, এজিএস পদে জয়লাভ যেন এ দৃঢ় অবস্থানেরই প্রতিফলন। এ বিজয় কেবল প্রার্থীদের নয়, বরং আদর্শের বিজয়। শিক্ষার্থীরা দেখিয়ে দিয়েছে, যে শক্তি সত্যিকারের বিশ্বাস, ত্যাগ ও সংগ্রামের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তাকে সাময়িকভাবে দুর্বল করা সম্ভব হলেও স্থায়ীভাবে পরাজিত করা যায় না।
ডাকসু নির্বাচনে ভিপি, জিএস বা এজিএস পদে এই প্যানেলের প্রার্থীদের জয় পাওয়ার চেয়ে বড়ো করে যে বিষয়টি চোখে পড়েছে তাহলো এই প্যানেলের তিনজন হিজাব পরিহিতা নারী ও একজন নন-হিজাবী নারী বিপুল ভোটে জয় পেয়েছেন। হিজাব পরিহিতা সাবিকুন নাহার তামান্না সর্বোচ্চ ১০ হাজারের বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। কিন্তু এই বিজয় পাওয়ার আগে এই নারীদেরকে চরম অপমান ও বুলিংয়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু দিন শেষে শেষ হাসি হেসেছেন তারাই। সাধারণ ছাত্রীরা ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী প্যানেলের প্রার্থীদেরকে দ্বিগুণেরও বেশি ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছে। অনেকের মতে, ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের এ বিজয়টি মূলত হিজাবোফোবিয়ার বিরুদ্ধে বিজয়।
১৯৯০-এর দশকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হিজাব বা ওড়না মাথায় দেয়ার বিষয়টিকে অনেকেই পশ্চাৎপদতা হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করে। যদিও তখন সংখ্যায় হিজাব পরা ছাত্রী তুলনামূলক কম ছিলেন, তবুও তাদের বারবার বিদ্রƒপ সহ্য করতে হয়েছে। ২০০২ সালের শামসুন নাহার হল ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ে।
২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত হিজাবকে সংগঠনের পরিচয় হিসেবে টার্গেট করা হতো। এ সময় ছাত্রশিবিরকে প্রকাশ্যে কাজ করার সুযোগ না দেয়া হলেও যে কোনো হিজাব পরা ছাত্রীকে শিবির-সমর্থক হিসেবে গুজব ছড়ানো হতো। ফলে হিজাবি ছাত্রীদের অনেককে হলে সিট পেতে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। এমনকি নামায পড়ার জন্য হলে বা বিভাগে জায়গা চাইলে তাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ সহ্য করতে হয়েছে। টিএসসিতে সংস্কৃতিচর্চার স্থানগুলোতেও হিজাবি ছাত্রীদের অনেক সময় ঢুকলেই চোখ রাঙানি ও ব্যঙ্গ শুনতে হতো। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের মানিকের ধর্ষণের সেঞ্চুরি উৎসব পালনের দৃষ্টান্ত স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এ ছাত্র সংগঠনগুলো নারীদের নিরাপত্তা ও সম্মান নিশ্চিত করা তো দূরের কথা বরং নারীদের হেনস্তা করাকেই নিজস্ব কর্মসূচি বানিয়ে নিয়েছিল। প্রগতিশীলদের আঁতুড়ঘর দাবি করে এ ক্যাম্পাসে হিজাব পরিহিতা নারীদের জঘন্যভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। অথচ এবারের নির্বাচনে ছাত্রছাত্রীরা এজিএস পদে আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা, সহ ক্রীড়া সম্পাদক ফারহানা আক্তার লুবনা, নিগার সুলতানা ও কার্যনির্বাহী পরিষদ সদস্যা হিসেবে নাবিলা বিনতে হারুন ও নুসরাত জাহান ইমাকে জয়যুক্ত করে হিজাবের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
প্রগতিশীলতার নামে আরেকটি ভয়ংকর কৌশল ছিল হিজাবকে সরাসরি রাজনৈতিক ট্যাগ দেওয়া। এ ধারণা শুধু হিজাবি ছাত্রীদের রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে না, বরং তাদের প্রতি প্রশাসন ও সাধারণ শিক্ষার্থীর দৃষ্টিভঙ্গিও নেতিবাচক করে তোলে। ঢাবির প্রগতিশীল অংশ নারীর পোশাকের স্বাধীনতার দাবি তোলে, কিন্তু হিজাবের ক্ষেত্রে উল্টো সুর তোলে অর্থাৎ, কেউ যদি ছোট পোশাক পরে, সেটিকে স্বাধীনতা হিসেবে দেখা হয়; কিন্তু হিজাব পরলে সেটিকে রক্ষণশীলতা বলা হয়। এই দ্বিমুখী মানসিকতাই আসলে হিজাবোফোবিয়ার মূল উৎস।
এবারের ডাকসু নির্বাচনের সময় ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের নারী প্রার্থীরা বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক ফাতিমা তাসনীম জুমা, কমনরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক উম্মে সালমা এবং কার্যনির্বাহী সদস্য পদপ্রার্থী সাবিকুন্নাহার তামান্না অনেকরকম নোংরা প্রচারণা ও কুৎসাচারের শিকার হন। বিশেষ করে সাইবার স্পেসে শিবির-সমর্থক শিক্ষা বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের পক্ষ থেকে তাঁরা লক্ষ্যবস্তুর মতো লক্ষ্যবিদ্ধ হন। প্রকাশ্যভাবে তাঁদের পোস্টে অপমানজনক ও অশ্লীল মন্তব্য করা হয়। সাবিকুন্নাহার তামান্না নিয়েও অনলাইনে এমন ক্যাম্পেইন চালানো হয় যা তাঁকে মানহানিকরভাবে দাগিয়ে, মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলার চেষ্টা করে। তার হিজাব পরিহিতা ছবির ওপরে রাক্ষুসের অবয়ব আঁকা হয়, যাতে করে বোঝানো হয় যে, হিজাবী নারী মানেই রাক্ষুসী, ভয়ংকর কিছু।
কিন্তু ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থীরা এত সব বুলিংয়ের পরও বিন্দুমাত্র টলে যাননি। বরং তারা লড়াই করে গেছেন। এ লড়াইয়ে তাদের মজলুম অবস্থানের পাশে এসে দাঁড়ান সর্বস্তরের নারীরা। শিবির সম্বন্ধে তাদের মনে নানা ধরনের নেতিবাচক ধারণা দেয়ার চেষ্টা করে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া ও দেশে-বিদেশে অবস্থানরত নানা এ্যাক্টিভিস্টরা। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা বিশেষ করে ছাত্রীরা আওয়ামী বয়ানের ট্যাবলেট ও হিজাববিরোধী বয়ানকে মোটেও গ্রহণ করেনি। বরং তারা অতীতের যে কোনো নির্বাচনের চেয়ে বেশি হারে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে অংশ নেয় এবং ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটকে বিপুল ভোটে জয়ী করে। জোটের নারী প্রার্থীদের তারা বিজয়ী করে এবং অন্য প্রার্থীদেরকেও নিজেদের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বেশি ভরসা করে। এ কারণে অনেকেই মনে করেন, ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট কার্যত দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্রয় দেয়া হিজাবোফোবিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করেই এবারের ভূমিধস বিজয় অর্জন করেছে।