বহুল প্রত্যাশিত প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফর সম্প্রতি সম্পন্ন হয়েছে। এটাই ছিলো তার কোনো দেশে প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর। এ সফর নিয়ে যেমন প্রত্যাশা ছিলো, ঠিক তেমনিভাবে শঙ্কাও নেহাত কম ছিলো না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ড. ইউনূসের এ শীর্ষ সফর সুসম্পন্ন হয়েছে। প্রত্যাশা অনুযায়ী শতভাগ প্রাপ্তি না মিললেও সদ্য সমাপ্ত সফরকে ইতিবাচক ও সফল বলেই মনে করছেন কূটনৈতিক বোদ্ধামহল। যা উভয় দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসাবেই বিবেচনা করা হচ্ছে।

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার যুগপৎ বিপ্লবে একটি অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী ও দখলদার আওয়ামী সরকারের পতন হয়। ফলে পতিতদের ঘনিষ্ঠ মিত্র বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্কের বড় ধরনের অবনতি ঘটে। দেশটি বাংলাদেশীদের জন্য ভিসা সুবিধা সীমিত করে দেয়। এমনকি ভ্রমণ ভিসা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা তীব্রতা পায়। সর্বোপরি দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কল্পকাহিনী ভারতীয় প্রচার মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়। কিন্তু চুলচেরা বিশ্লেষণে এসব প্রচারণা কোনভাবেই প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ ও নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে ভারতের এমন বৈরী আচরণের পর বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশটির সরকারের সাথে সম্পর্ক জোরালো করার চেষ্টা করলেও দেশটির নেতিবাচক মনোভাবের কারণেই তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদির সাথে বারবার বৈঠকের প্রস্তাব দিলেও দেশটি ছিলো বরাবরই নেতিবাচক।

নিকট ও বৃহৎ প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্কের এমন টানাপোড়েনের মধ্যেই প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনূসের বহুল প্রত্যাশিত চীন সফর সম্প্রতি সম্পন্ন হয়েছে। যদিও তা নয়াদিল্লির সাউথ ব্লকের কাছে প্রত্যাশিত ছিলো না। কারণ এ সফরের উচ্চাশা ছিলো সকল মহলের কাছে আলোচ্য বিষয়। এ সফরে বিশাল বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ফিরছেন প্রধান উপদেষ্টা। তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং ২০২৮ সাল পর্যন্ত কোটা ও শুল্ক সুবিধারও প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন। সফরে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন এবং বাংলাদেশ চীনের ‘এক চীন নীতি’তে তার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে। এরমধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ২১০ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি। সর্বোপরি ৩০টি চীনা কোম্পানী বাংলাদেশের চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। মোংলা বন্দর আধুনিকীকরণে ৪০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ, অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার এবং প্রযুক্তিগত সহায়তায় ১৫০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দের পরিকল্পনা রয়েছে। বাকি অর্থ অনুদান ও অন্যান্য ঋণ সহায়তা হিসেবে আসবে।

চীন বাংলাদেশের জন্য বিদ্যমান শুল্ক ও কোটামুক্ত রপ্তানি সুবিধা ২০২৬ সাল থেকে বাড়িয়ে ২০২৮ সাল পর্যন্ত বহাল রাখার ঘোষণা দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের পর চীনা উপপ্রধানমন্ত্রী ডিং জুয়েশিয়াং এ ঘোষণা দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার এ সফরে তিস্তা নদী প্রকল্পে সহায়তার আশ্বাস পেয়েছেন। সফরে সে দেশের পানিসম্পদমন্ত্রী লি গোইয়িংয়ের সঙ্গে বৈঠকে তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা ও ঢাকার চারপাশের দূষিত পানি পরিষ্কারের বিষয়ে সহায়তার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন ইউনূস।

বাংলাদেশ সবসময় এক চীন নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। একইসঙ্গে চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার ব্যাপারে নিজেদের অঙ্গীকারের কথা স্পষ্ট করেছে। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের পথচলায় সমর্থনের কথাও বলেছে চীন।

সফরকালে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে চীনের একটি চুক্তি ও ৮টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক এবং কারিগরি সহযোগিতাসংক্রান্ত একটি চুক্তি সই হয়েছে। এ ছাড়া দু’দেশের চিরায়ত সাহিত্যের অনুবাদ ও প্রকাশনা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিনিময় ও সহযোগিতা, সংবাদ বিনিময়, গণমাধ্যম, ক্রীড়া ও স্বাস্থ্য খাতে সই হয়েছে ৮টি সমঝোতা স্মারক।

ড. মুহম্মদ ইউনূসের চীনে প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে দু’দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে এবং সম্পর্ক ‘নতুন উচ্চতায়’ নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে যৌথ বিবৃতিতে। প্রধান উপদেষ্টার এ সফরে চীনের প্রেসিডেন্টের সাথে তার হৃদ্যতাপূর্ণ বৈঠক হয়ছে। সেখানেই সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে বিবৃতিতে জানানো হয়। একইসাথে শি জিনপিং বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কর্মসূচিরও ভূয়সী প্রশংসা করেছেন বলেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে গত বছরের জুলাই মাসে চীন সফর করেছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা সে সফরকে ব্যর্থ সফর হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন। কারণ, পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের প্রাক্কালে যেসব উচ্চ আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিলো সে সফরে সে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি বলেই পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা।

এরপরই অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের প্রথম চীন সফরে আমাদের প্রাপ্তি বা অর্জন কী সেটি নিয়ে চলছে নানা হিসাবনিকাশ তথা জল্পনা-কল্পনা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ড. ইউনূস যখন চীন সফর করছেন তখন বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যেকার কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পালিত হচ্ছে। বিশ্লেষকেরা এটিকে সফল সফর বলে মনে করছেন। তারা বলছেন, দ্বিপক্ষীয় সফরে দু’দেশ যৌথ বিবৃতি দিয়েছে, চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে-এটি সফরের প্রত্যাশিত দিক। যা উভয় কর্তৃপক্ষ ও দু’দেশের জনগণকে অনেকটাই আশাবাদী করে তুলেছে। অতীতের সফরগুলোর চেয়ে এ সফর ফলপ্রসূ ও ইতিবাচক বলার অনেকগুলো কারণ দৃশ্যমান।

অধ্যাপক ড. ইউনূসের এ সফরে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ, নদী ব্যবস্থাপনা এবং রোহিঙ্গা সঙ্কটের মতো বিষয়গুলো আলোচনায় এসেছে। তবে, বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থাপনায় চীনের পরামর্শ চাওয়া কিংবা অতীতের মতো এক চীন নীতিতে বাংলাদেশের সমর্থনের বিষয়গুলো নিয়ে নানা বিশ্লেষণও চলছে। গণঅভ্যুত্থানের পর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এমন এক সময়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন যখন দেশের অর্থনীতি নানামুখী চাপে রয়েছে। ফলে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দেয়া অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য। সে জায়গা থেকে এ সফর নিয়ে শুরুতেই আলোচনা ছিল। সফরে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতা সংক্রান্ত একটি চুক্তি সই হয়েছে। এছাড়া সাহিত্য ও প্রকাশনা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিনিময় ও সহযোগিতা, সংবাদ বিনিময়, গণমাধ্যম, ক্রীড়া ও স্বাস্থ্য খাতে আটটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে দু’দেশ।

অর্থনৈতিক বিবেচনায় সফরের সময় হওয়া চুক্তিসমূহকে বাংলাদেশের অর্জন হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ চীন অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পলিটিকাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সাহাবুল হক। এ বিষয়ে তিনি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘এ সফরে চীনের কাছ থেকে ২১০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ ও ঋণের যে প্রস্তাব পাওয়া গেছে, যেটি বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিকে আরো ত্বরান্বিত করবে।’ আলোচনায় মোংলা বন্দরের উন্নয়নে কাজ করার কথা বলেছে চীন। যদিও আগে থেকেই চীন ও ভারত আলাদাভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে জড়িত ছিল। নতুন করে পুরো কাজ এখন চীন করতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘এছাড়াও দু’টি স্পেশাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনে কিছু বিনিয়োগ আসবে হয়তো। এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা ভালো ও ইতিবাচক দিক যদি তা বাস্তবায়ন করা যায়।’

গত আগস্টে পট পরিবর্তনের আগে অনেক বাংলাদেশী স্বাস্থ্য সেবার জন্য ভারতে যাতায়াত করতেন। কিন্তু এরপর থেকে বাংলাদেশী নাগরিকদের ভারতের চিকিৎসাসহ সব ধরনের ভিসা পেতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সম্প্রতি চীনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক বিবৃতিতে জানায়, চীন এরই মধ্যে কুনমিংয়ের চারটি হাসপাতাল বাংলাদেশী রোগীদের জন্য বিশেষভাবে বরাদ্দ করেছে। চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স বাংলাদেশের বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে চীনের কুনমিং পর্যন্ত ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা করছে। এর ফলে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের মানুষ সহজে চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কুনমিংয়ের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে পারবেন বলে বিবৃতিতে বলা হয়। ফলে বাংলাদেশী চিকিৎসা প্রত্যাশীদের ভারত নির্ভরতা কমাবে এবং স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ পাওয়া যাবে।

এর বাইরে বিশ্লেষকরা বলছেন, অধ্যাপক ইউনূসের এ সফরে নতুন যা হয়েছে তার মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা খাতে বেশ কিছু বিষয় এসেছে, যা আগে কখনো এত বিস্তারিতভাবে আলোচনায় আসেনি। সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, ঢাকায় কিছু হাসপাতাল গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। চীন রোবটিক ফিজিও থেরাপির কথা বলেছে। কার্ডিও ভাস্কুলার সার্জারি এবং ভেহিকেল সাপ্লাই দেয়ার কথা বলেছে। যেটা হয়তো বিশাল কিছু না, তবে স্বাস্থ্যখাতে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনেক সাহায্য করবে। তারা বলছেন, এখন থেকে চীনের কুনমিংকে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এটা নতুন মাত্রা তৈরি হচ্ছে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসসের খবরে বলা হয়েছে, শত শত বিস্তৃত নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্য চীন থেকে ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান চেয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার সফরের পর বাংলাদেশ ও চীনের পক্ষ থেকে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তিস্তা নদীর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনঃসংস্কার প্রকল্পে চীনা কোম্পানিগুলোর অংশগ্রহণকে বাংলাদেশ স্বাগত জানিয়েছে। সফরে পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় নদী শাসন ড্রেজিংসহ বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এটিকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে ২০২১ সালে চীন তিস্তা নদীর ওপর এক সমীক্ষা চালিয়েছিল। সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, তখন ভারতের আপত্তিতে সেটা থেমে গিয়েছিল। পরে এখন অধ্যাপক ইউনূস তাদেরকে (চীনকে) অনুরোধ করেছেন আবার কাজ শুরুর জন্য। এদিকে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ বলছেন, তিস্তা ইস্যুতে চীনের সাথে একটা এমওইউ আগে থেকেই ছিল। সেটা নবায়নের বিষয়ও ছিল। এবারের সফরে খুব সুনির্দিষ্টভাবে চীনকে তেমন কোনো সুযোগ করে দেয়া হয়নি। দিলে হয়তো চীন খুশি হতো, তবে সেটি কৌশলগত কারণেই সম্ভবত দেয়া হয়নি। যেটি আমার দৃষ্টিতে ইতিবাচক মনে হয়েছে। এ বছরই বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর অর্থাৎ সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হতে যাচ্ছে।

এ সফরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় চীনকে আরো জোরালো ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে প্রায় আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পরে বিভিন্ন সময় আরো অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে এর আগে শেখ হাসিনার সরকার উদ্যোগ নিলেও তা সফলতার মুখ দেখেনি। কূটনীতিকরা বলছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুও গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়েছে এ সফরে। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে নতুন উদ্যোগের লক্ষণ আপাতত দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে এর মধ্যে দিয়ে নিশ্চয়ই আরও আলাপ আলোচনা হবে। এর ফলে যদি নতুন কিছু হয় সেটা দেখার জন্য আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারের সাথে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক চীনের। মিয়ানমারে চীনের বহু প্রকল্প রয়েছে। সেক্ষেত্রে চীনকে রাজি করানো গেলে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সঙ্কটের একটা সমাধান সম্ভব। কূটনৈতিক বোদ্ধারা মনে করছেন, যেহেতু চীনের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্ক ভালো, ফলে চীন যদি চায় মিয়ানমার সরকারকে রাজি করিয়ে তারা একটা উদ্যোগ নিতে পারে। চীনা প্রেসিডেন্ট বলেছেন, দু’পক্ষকে নিয়েই তারা এ উদ্যোগ নেবে। চীন উদ্যোগ নিলে সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব।

প্রধান উপদেষ্টা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর মধ্যে বৈঠকের পর এক যৌথ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে, দু’দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি সমর্থনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে, ‘এক চীন’ নীতির প্রতি সমর্থনের কথা ব্যক্ত করে তাইওয়ানকে চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন তাইওয়ান মূলত দক্ষিণ চীন সমুদ্রের একটি দ্বীপ।

চীনের পক্ষ থেকে যৌথ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার ব্যাপারে নিজেদের অঙ্গীকারের কথা। অন্তর্বর্তী সরকারের পথচলায় সমর্থনের কথাও ব্যক্ত করা হয় এতে। বাংলাদেশ বরাবরই এক চীন নীতিতে অবস্থান করে আসছে। ফলে বিজ্ঞপ্তিতে এর প্রতিফলন অস্বাভাবিক নয় বলে মনে করেন চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ।

প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করা হলেও এ সফরের সফলতা নিয়ে কোন পক্ষই তেমন কোন প্রশ্ন তোলেনি। কারণ, চীনে প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে দু’দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে এবং সম্পর্ক ‘নতুন উচ্চতায়’ নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে যৌথ বিবৃতিতে। প্রধান উপদেষ্টার এ সফরে চীনের প্রেসিডেন্টের সাথে তার হৃদ্যতাপূর্ণ বৈঠক হয়ছে। একইসাথে শি জিনপিং বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কর্মসূচিরও ভূয়সী প্রশংসা করেছেন বলেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশীদের জন্য চিকিৎসা সেবা দিতে চীন ইতিবাচক মনোভাবে নিয়ে এগিয়ে এসেছে। দিয়েছে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধাও। তাই এ সফরে উভয় দেশের ক্ষেত্রেই প্রত্যাশা অনুযায়ী শতভাগ প্রাপ্তি না আসলেও সফল ও সার্থক বলতে কসুর করছেন না কূটনৈতিক মহল। যদিও বিষয়টি নিয়ে মহল বিশেষের গাত্রদাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

সার্বিক দিক বিবেচনায় প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরকে সফলই বলা হচ্ছে। তবে কোন একটি সফরই দ্বিপাক্ষিক সকল সমস্যার সমাধান দেয় না বরং এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। কারণ, আন্তঃরাষ্ট্রীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক ও পররাষ্ট্রনীতি প্রত্যেক জাতিরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই একটি চলমান প্রক্রিয়া। তাই এটি কোন স্থানে যেমন থেমে যাওয়ার সুযোগ নেই, ঠিক তেমনিভাবে রাতারাতি বিপ্লব ঘটানোর চিন্তাও এক ধরনের বাতুলতা। সঙ্গত কারণেই আমরা বলবো এ সফর সার্বিক দিক বিবেচনায় সফল। তবে উভয় দেশকে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।