DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

কলাম

স্বাগত মাহে রমযান

রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির মাস পবিত্র রমযানুল করিম সমাগত। আহলান্ সাহলান্ মাহে রমযান। মুসলিমদের কাছে এই

Default Image - DS

ড. আবদুল আলীম তালুকদার

রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির মাস পবিত্র রমযানুল করিম সমাগত। আহলান্ সাহলান্ মাহে রমযান। মুসলিমদের কাছে এই মাসটি হলো সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে সম্মানিত মাস। ফারসি শব্দ রোজার আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে সিয়াম বা সাওম যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা। ইসলামি ধর্মতত্ত্ববিদ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, ‘শাব্দিক অর্থে রোজাঅর্থ বিরত থাকা হলেও শরিয়তে রোজামানে নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত কিছু কাজ থেকে নিবৃত থাকার পদ্ধতি অনুসারে বিশেষ কয়েকটি বিষয় থেকে বিরত থাকা ও নির্দিষ্ট শর্ত মেনে চলা।’ (ফাতহুল বারি, কিতাবুস সাওম, বাবু উজুবিস সাউমি রামাদান, পৃ. ১২৩)

ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়- সুবহি সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সবধরনের পানাহার এবং সে সাথে যাবতীয় ভোগ-বিলাস থেকেও বিরত থাকার নাম রোজা। ইসলামিক রীতি অনুযায়ী প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ-সবল মুসলমানের জন্য রমযান মাসে রোজাপালন করা ফরয বা অবশ্যপালনীয় ইবাদত। পবিত্র কুরআনুল কারিমের সূরা বাক্বারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমাদের জন্য রোজাপালন ফরয করা হলো, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে তোমরা পরহেজগারিতা অর্জন করতে পারো।’ এছাড়াও সূরা বাক্বারার ১৮৫নং আয়াতে আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এই মাসকে পায় সে যেন রোজা রাখে।’

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যখন তোমরা (রমযানের) চাঁদ দেখবে, তখন থেকে রোজা রাখবে আর যখন (শাওয়ালের) চাঁদ দেখবে, তখন থেকে রোজা বন্ধ করবে। আকাশ যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে তবে ত্রিশ দিন রোজা রাখবে। (সহিহ বুখারি: ১৯০৯) ও (সহিহ মুসলিম: ১০৮০)

পবিত্র রমযানুল মুবারকের ফযিলত সম্পর্কে অসংখ্য হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যেমন- হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, তিনি যখন একদিন নবি (স.) কে বলেছিলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ্! আমাকে অতিউত্তম কোনো নেক আমলের নির্দেশ দিন। রাসূলুল্লাহ্ (স.) তখন বললেন, ‘তুমি রোজাপালন করো। কারণ এর সমমর্যাদার আর কোনো আমল নেই। (সুনানে নাসায়ী: ২৫৩৪)

হযরত সাহল ইবনে সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবি করিম (স.) ইরশাদ করেন, বেহেশতের ৮টি দরজা রয়েছে। এর মধ্যে একটি দরজার নাম রাইয়ান। রোজাদার ব্যতীত আর কেউ ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (সহীহ্ বুখারী ও সহীহ্ মুসলিম)

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়্যতে রমযান মাসের রোজাপালন করবে তার পূর্বের সব গুণাহ্ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়্যতে রমযান মাসের রাতে ইবাদত-বন্দেগি করে তার পূর্বের সব গুণাহ্ মাফ করে দেওয়া হবে। (সহিহ্ বুখারি ও সহিহ্ মুসলিম)

হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (স.) ইরশাদ করেছেন, রোজাও কুরআন (কিয়ামতের দিন) আল্লাহর দরবারে বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে আল্লাহ্ তা’আলা! আমি তাকে (রমযানের) দিনে পানাহার ও প্রবৃত্তি থেকে বাঁধা দিয়েছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতের বেলায় নিদ্রা হতে বাঁধা দিয়েছি। সুতরাং আমার সুপারিশ তার ব্যাপারে কবুল করুন। অতএব, উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে (এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে।) (বায়হাকি)

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবি করিম (স.) বলেছেন, যখন রমযান মাস আগমন ঘটে আকাশের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং নরকের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় আর বিতাড়িত শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। (সহিহ্ বুখারি ও সহিহ্ মুসলিম)

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবি (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে শরিয়তসম্মত কোনো কারণ ছাড়া রমযানের একটি রোজাও ভাঙে সে রমযানের বাইরে সারা জীবন রোজারাখলেও এর বদলা হবে না। (জামে তিরমিযি, সুনানে আবু দাউদ)

হাদিসে কুদসিতে আছে, রাসূল (স.) বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেন, রোজাব্যতীত আদম সন্তানের প্রত্যেকটি কাজই তার নিজের জন্য। তবে রোজা আমার জন্য; আমি নিজেই এর পুরস্কার দেবো। রোজা ঢাল স্বরূপ। তোমাদের মধ্যে কেউ যেন রোজারেখে অশ্লীল কথাবার্তায় ও ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত না হয়। কেউ তার সঙ্গে গালমন্দ বা ঝগড়া বিবাদ করলে শুধু বলবে, আমি রোজাদার। সেই মহান সত্তার কসম যার করতলে মুহাম্মদের জীবন, আল্লাহ্র কাছে রোজাদারের মুখের গন্ধ মেস্ক-কস্তুরির সুঘ্রাণের চেয়েও উত্তম। রোজাদারের খুশির বিষয় ২টি- যখন সে ইফতার করে তখন একবার খুশির কারণ হয়। আর একবার যখন সে তার রবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রোজার বিনিময় লাভ করবে তখন খুশির কারণ হবে। (সহিহ্ বুখারি)

হযরত সালমান ফারসি (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, একবার রাসূল (স.) আমাদের শা’বান মাসের শেষ তারিখে ভাষণ দান করলেন এবং বললেন, হে মানবমণ্ডলি! তোমাদের প্রতি ছায়া বিস্তার করেছে এক মহান মাস, মুবারক মাস। এটি এমন মাস যাতে একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ্ তায়ালা এ মাসের রোজাগুলোকে করেছেন (তোমাদের ওপর) ফরয আর রাতে নামায আদায়কে তোমাদের জন্য করেছেন নফল।

এ মাসে যে ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশে ১টি নফল আমল করলো সে ওই ব্যক্তির সমান হলো, যে অন্য মাসে ১টি ফরয আদায় করলো। আর যে ব্যক্তি এ মাসে ১টি ফরয আদায় করলো সে ওই ব্যক্তির সমান হলো, যে অন্য মাসে ৭০টি ফরয আদায় করলো। এটা ধৈর্য্যরে মাস। আর ধৈর্য্যরে সওয়াব হলো বেহেশত। এটা সেই মাস যে মাসে মু’মিন বান্দার রিযিক বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

এ মাসে যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে তা তার জন্য গুণাহ্ মাফের এবং দোযখের আগুন থেকে মুক্তির কারণ হবে। এছাড়া তার সওয়াব হবে রোজাদার ব্যক্তির সমান অথচ রোজাদার ব্যক্তির সওয়াব কমবে না। এসব শুনে সাহাবীরা আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (স.)! আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তি তো এমন সামর্থ রাখে না যে রোজাদারকে (তৃপ্তি সহকারে) ইফতার করাবে? রাসূল (স.) বললেন, আল্লাহ্ পাক এ সাওয়াব দান করবেন যে রোজাদারকে ইফতার করায় এক চুমুক দুধ দিয়ে অথবা একটি খেজুর দিয়ে অথবা এক চুমুক পানি দিয়ে। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়ায় আল্লাহ্ তা’আলা তাকে হাউজে কাউসার থেকে পানি পান করাবেন যার পর সে পুনরায় তৃষ্ণার্ত হবে না জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত।

‘শা’বান মাসকে রমযান মাসের প্রস্তুতিমূলক সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর রোজা ফরয হয় দ্বিতীয় হিজরীর শা’বান মাসে। রমযানের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, মহান আল্লাহ্ তা’আলা এ মাসটিকে স্বীয় ওহি সহিফা ও আসমানী কিতাব নাযিল করার জন্য মনোনীত করেছেন। অধিকাংশ আসমানী কিতাব এ মাসেই নাযিল হয়েছে। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, হযরত ইবরাহিম (আ.) এর সহিফা রমযানের ১ তারিখে, তাওরাত রমযানের ৬ তারিখে, যাবুর রমযানের ১২ তারিখে, ইঞ্জিল রমযানের ১৮ তারিখে এবং সর্বশেষ পবিত্র কুরআনুল কারিম রমযানের ২৭ তারিখ ক্বদরের রাত্রিতে নাযিল হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আমি এই কুরআনকে ক্বদরের রাত্রিতে নাযিল করেছি। (সূরা ক্বদর: ১)

রাসূলুল্লাহ্ (স.) রমযান মাসের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতেন এবং রজব মাসের চাঁদ দেখে রমযান প্রাপ্তির আশায় বিভোর থাকতেন। শা’বান মাসকে রমযানের প্রস্তুতি ও সোপান মনে করে তিনি বিশেষ দুআ করতেন এবং অন্যদেরকে তা শিক্ষা দিতেন। শা’বান মাসের চাঁদ দেখার সাথে সাথে সাহাবিগণ অধিক পরিমাণ পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত শুরু করতেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত ব্যক্তিরা হিসাব-নিকাশ চূড়ান্ত করে যাকাত প্রদানের প্রস্তুতি নিতেন। রাসূলুল্লাহ্ (স.) যখন শা’বান মাসে উপনীত হতেন, তখন মাহে রমযানকে স্বাগত জানানোর উদ্দেশ্যে আবেগ ভরে আল্লাহ্র দরবারে এ প্রার্থনা করতেন, ‘হে আল্লাহ্! আপনি আমাদের রজব ও শা’বান মাসের বিশেষ বরকত দান করুন এবং আমাদের রমযান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন।’(মুসনাদে আহমদ)

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক (ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ), শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, শেরপুর।