হাসনা হেনা

বর্তমানে আমাদের দেশ চলছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দিয়ে। এসময়ের সবচেয়ে আলোচিত এবং বহুল চর্চিত বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কার। কারণ সংস্কার হচ্ছে বহুমাত্রিক লক্ষ্যবস্তুর ধারালো হাতিয়ার। এর ব্যাপকতা বিন্দু থেকে সিন্ধু পর্যন্ত। সংস্কারের মধ্যমনি হচ্ছে বিপ্লব। বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব হচ্ছে এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কারণ জুলাই বিপ্লবের পরে ৮ আগস্ট ২৪-এ যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতার মসনদে বসেছেন তারা সংস্কারের মাধ্যমে অতীতের ভুলত্রুটি শুধরে নেয়ার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। কারণ সংস্কার মানেই হচ্ছে সংশোধন করা, ভালোভাবে সম্পন্ন করা, নিখুঁত করা।

অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায় পরিবর্তন বা পরিমার্জনের মাধ্যমে কোনকিছুকে গ্রহণযোগ্য করার নামই সংস্কার। কান টানলে মাথা আসে। সংস্কারের অবস্থাও তাই। রাষ্ট্র সংস্কারের কথা চিন্তা করতে গেলেই চলে আসে ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সব। যুগে যুগে মানুষ সংস্কারের খোলসের মধ্যেই অবস্থান করে। আর এর মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত করতে চায় সামাজিক সাম্য, শান্তি-শৃঙ্খলা আর দূর করতে চায় সার্বিক বৈষম্য। ‘ছোট ছোট বালু কণা বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তুলে মহাদেশ সাগর অতল” সংস্কারের অবস্থান একেবারে তাই। একটা জীর্ণ জামা যেমন ছোট ছোট সেলাই করে পূর্ণাঙ্গ রূপ দান সম্ভব, একটা ভাঙা নৌকা মেরামত করে সাগর পাড়ি দেয়া সম্ভব ঠিক তেমনি সংস্কারের মাধ্যমে একটা রাষ্ট্রকে পরিপূর্ণ কল্যাণকামী রাষ্ট্রে পরিণত করা সম্ভব।

স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে রাজনৈতিক মুক্তি সম্ভব হলেও অর্থনৈতিক উন্নতি ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তি আসে না। মানুষ অভাবের কাছে নিরূপায় হয়ে পড়ে। ধ্বংস হয়ে যায় মানুষের সার্বিক উন্নয়ন। কাজেই অতি স্বাভাবিকভাবেই বলা যায় “Man can not enjoy the peace of liberty, if he cannot

be free from want, ignorance and discrimination.”

কাজেই সংস্কারের সাথে আত্মিক দিকও ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। যেকোন সংস্কারের মূল শক্তি নিহিত থাকে আত্মশুদ্ধির উপর। লোভী, স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রীক মানুষ কখনো পরিপূর্ণ না। আমাদের দেশে লোভী ব্যবসায়ী ও জনগণ অর্থ আত্মসাতের অতি নিকৃষ্ট পথ বেছে নেন। লোভী রাজনীতিবিদ ক্ষমতাসীনরা লাখ লাখ টাকা বিদেশে পাচার করেন। আর ব্যবসায়ীরা সবকিছুতে ভেজাল দেন। যার সুদূরপ্রসারী প্রভাবে পারিবারিক এবং সামাজিক শান্তি নষ্ট হয়। মানুষ নানান রোগে আক্রান্ত হয় এবং অকালে মৃত্যুবরণ করেন। এমনভাবে সংস্কার হোক যাতে এ কাজ করার সুযোগ না থাকে আর থাকলেও দ্রুত বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়।

কাজেই দেশের তিনটি বিভাগ আইন, বিচার ও শাসন বিভাগে আনতে হবে আমূল পরিবর্তন। সংস্কারকে করতে হবে অর্থবহ। এক্ষেত্রে জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে। ঘটাতে হবে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। যাতে দূর হয় আস্থাহীনতা। কাজেই সংস্কারে জনগণের অংশগ্রহণ অতীব জরুরি। এক্ষেত্রে আমাদের বুঝতে হবে যে কুসংস্কার এবং সংস্কার এক জিনিস না। কুসংস্কারকে একবাক্যে অস্বীকার করা সম্ভব হয়। অতিদ্রুত জনগণের মতামত অর্জন সম্ভব। সুষ্ঠু রাজনীতির অভাব, পরমত সহিষ্ণুতা না থাকা, চাঁদাবাজিসহ বহু বিষয় আছে যা সমাজকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।

একমাত্র সংস্কার পারে আমাদের এহেন অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে। রাজনৈতিক সংস্কার এ কারণে প্রয়োজন যে ক্ষমতাসীন দল মনে করে দেশ তার একার। সবাইকে নিয়ে চলার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সংস্কার ও রাজনীতি ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। সংস্কারের মাধ্যমে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দেখানো সম্ভব। সংস্কারকে করতে হবে অতি বাস্তবমুখী যেখানে সব চিন্তা চেতনার প্রসার ঘটানো সম্ভব হয়।

A stich in time, saves nine. অর্থাৎ সময়ের একফোঁড় অসময়ের দশফোঁড়। প্রতিটা সংস্কারক এবং সংস্কারবাদী মানুষকে এ চিন্তাটা মাথায় রাখতে হবে। যেহেতু সংস্কার মানে নবায়ন, সংস্কার মানে নিখুঁত করা। জুলাইয়ের বিপ্লবের পর আমাদের দেশ গড়া, কিংবা নবায়নের যে উদ্যম ও হিড়িক দেখা যাচ্ছে তার একমাত্র সফল ভিত্তি হচ্ছে সুস্থ সংস্কার। না হয় সারাবছর রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির মত সংস্কারের অবাস্তব ও কঠিন শিকলে আটকে যাবে আমাদের জীবন। বর্তমানে আমাদের সংস্কারের একটা বড় দাবি হচ্ছে দু’মেয়াদের অধিক কেউ সরকার প্রধান থাকতে পারবেন না। এটা খুবই বাস্তবসম্মত ও ইতিবাচক। ক্ষমতায় বসলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চিন্তা মাথায় ঢুকে যা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছাকে ত্বরান্বিত করে। কবি উলিয়াম তার ইনভিকটাস কবিতায় যথার্থই উপলব্ধি করেছেন, যেখানে শাসকের আত্মকেন্দ্রিকতা ও ঔদ্ধত্যের যথার্থ প্রতিফলন ঘটেছে। I am the master of my fate, I am the captain of my soul. আমাদের দেশে ছয় সংস্কার কমিশন যেমন নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার এর প্রতিবেদন জমা হয়েছে। এখন বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে একে যৌক্তিক করা তোলা দরকার। মানুষের মনোবাসনার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন কখনো সম্ভব না হলেও সার্বজনীনতা ধরে রাখার চেষ্টা থাকতে হবে। প্রতিবছর বাজেট পাস হওয়ার পর একদল বলে জনবান্ধব বাজেট, আরেকদল বলে, না। এজন্য মনে রাখতে হবে নিখুঁতেরও খুঁত থাকে। না হয় এ কথার জন্ম কখনো হত না নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।

বিচারিক ক্ষেত্রে সংস্কারের অবস্থান এমন হওয়া উচিত হাকিম নড়বে তবুও হুকুম নড়বে না। তবেই সেক্ষেত্রে যথার্থ হবে কবি ও কবিতার লাইন -Man may come and man may go, but i goon forever.

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার করা না গেলে সবকিছুই অসার হতে পারে। স্বৈরাচার ও তাদের দোসর ছাড়া সবদলের যে ঐকমত্য আগস্টে দেখা গিয়েছিল সেখান থেকেই নির্বাচন সংস্কারটা হতে পারে। তাহলে আর কারো কোন প্রশ্ন থাকবে না। কারো কারো দ্বিমত বা ভিন্নমত থাকবেই। সেটাকে বড় করে না দেখে মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য হলে এগিয়ে যাওয়া যেতে পারে। সেই ক্ষেত্রে কল্যাণ আসতে পারে।

লেখিকা : অধ্যাপিকা, ইংরেজি বিভাগ, মোহাম্মদপুর মহিলা কলেজ।