মো. ইশতিয়াক হোসেন রাতুল
ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় আজ এক গভীর সংকটের মধ্যে জীবনযাপন করছে। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে বৈষম্য, অবহেলা এবং নিপীড়নের মুখে পড়তে হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় নীতি থেকে শুরু করে সামাজিক সম্পর্ক, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে। আর্থ-সামাজিক অবস্থা, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব তাদের জীবনকে প্রতিদিন এক অভিশাপের মতো করে তুলছে। ধর্মীয় সহিংসতা এবং ঘৃণা দিনে দিনে বাড়ছে, যা তাদের নিরাপত্তাহীনতা ও ভয়াবহতার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। মুসলিম যুবকদের সামনে আজ এমন কোন পথ নেই যেখানে তারা নিশ্চিন্তে হাঁটতে পারে। পরিবার, সমাজ এবং জাতির প্রতি তাদের অবিচার আর নিঃসঙ্গতা বেড়েই চলেছে, যেন তারা এক অবহেলিত জাতি, যাদের জীবনে সুখ এবং স্বস্তি এক স্বপ্নের মতো হয়ে গেছে।
ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় আজ এক চরম দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ধর্মীয় অধিকার, সাংস্কৃতিক পরিচয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব-এমন সবকিছুই হুমকির মুখে। ২০২৫ সালের ওয়াকফ (সংশোধনী) বিলের পাস হওয়ার পর, এ পরিস্থিতি আরও তীব্র হয়েছে। বিলটি মুসলিমদের ধর্মীয় সম্পত্তি, সমাজ এবং সংস্কৃতির উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে, যা তাদের অস্তিত্বের এক নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের ওয়াকফ সম্পত্তি ইসলামী আইন অনুযায়ী মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক ও শিক্ষামূলক প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। ওয়াকফ বোর্ড এসব সম্পত্তি পরিচালনা করে এবং তা মুসলিম সম্প্রদায়ের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়। ওয়াকফ সম্পত্তির সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ একর, যার বাজারমূল্য লক্ষাধিক কোটি রুপি। তবে এর সঠিক ব্যবহারের অভাব, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং সরকারি হস্তক্ষেপের ফলে এসব সম্পত্তি মুসলিমদের উন্নয়নের জন্য কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। এখন, নতুন ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল ২০২৫ পাস হওয়ায়, এমন সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। বিলটির অন্যতম প্রধান শর্ত হলো, কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিল এবং রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি। এতে ওয়াকফ সম্পত্তির পরিচালনায় সরকার ও অন্য সম্প্রদায়ের আরো বেশি হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সরকারের হাতে থাকবে বিতর্কিত ওয়াকফ সম্পত্তির মালিকানা নির্ধারণের ক্ষমতা, যা মুসলিমদের ধর্মীয় সম্পত্তির উপর অত্যধিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব নানা চ্যালেঞ্জের মুখে। চ্যালেঞ্জগুলো ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু বর্তমানে সেগুলো আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে ভারতের মুসলমানদের এক বড় অংশ পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল, কিন্তু যারা রয়ে গিয়েছিল, তারা সমাজে প্রান্তিক হয়ে পড়েছিল। তাদের প্রতি অবিশ্বাস এবং বৈষম্য এখনো বিদ্যমান। মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা হুমকির মুখে, তাদের জীবনযাত্রার মান এখনো খুবই সংকীর্ণ। ভারতের মুসলমানরা বহু বছর ধরেই ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা, ২০১৩ সালের মুজাফফরনগর দাঙ্গা এবং ২০২০ সালের দিল্লি দাঙ্গা এদের মধ্যে কিছু বড় সহিংসতার ঘটনা। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, হত্যাকাণ্ড এবং তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে হস্তক্ষেপ- এসব এখনো চলমান। ২০১৪ সালে বিজেপির ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুসলিমদের প্রতি গোরক্ষার নামে গণপিটুনির (Mob Lynching)) ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গোমাংস খাওয়া ও রাখার অভিযোগে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ১০০টির বেশি হামলা হয়েছে, যার মধ্যে অনেকেই প্রাণ হারিয়েছে।
২০১৯ সালে ভারত সরকার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) পাস করে, যা মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এ আইন অনুসারে, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে আসা অমুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হলেও মুসলমানদের জন্য এই সুযোগ নেই। ঘজঈ NRC (National Register of Citizens)-এর মাধ্যমে মুসলিমদের রাষ্ট্রহীন করার ভয়ও তৈরি হয়েছে, যার ফলে ভারতের মুসলমানদের অবস্থান আরো জটিল হয়ে উঠেছে। ভারতের মুসলমানরা শিক্ষা ও অর্থনীতির দিক থেকেও পিছিয়ে রয়েছে। শিক্ষার হার, কর্মসংস্থান, সরকারি চাকরি-এসব ক্ষেত্রে মুসলিমদের অংশগ্রহণ অপ্রতুল। ভারতের মুসলিমরা শিক্ষার ক্ষেত্রে অন্য ধর্মের তুলনায় অনেক পিছিয়ে, আর কর্মসংস্থানে তাদের অংশগ্রহণও মাত্র ৪-৫%। সাচার কমিটির রিপোর্টে দেখা গেছে যে, ভারতের মুসলিমরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দলিতদের থেকেও খারাপ অবস্থায় রয়েছে। তাদের একাধিক সমস্যার মধ্যে রয়েছে প্রান্তিকতা, ন্যায়বিচারের অভাব, কর্মসংস্থানের সুযোগের সীমাবদ্ধতা এবং সরকারি সহায়তার অভাব।
ভারতের মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত অধিকার এখন হুমকির মুখে। হিজাব নিষিদ্ধকরণ, আজান নিয়ে বিতর্ক, মুসলিম ধর্মীয় স্থাপনা ভাঙার মতো ঘটনা দেশে নিয়মিত হয়ে উঠেছে। মুসলিম সম্প্রদায়কে সামাজিকভাবে বয়কট করার আহ্বানও ক্রমাগত শোনা যাচ্ছে। মুসলিম ব্যবসায়ীদের হালাল খাদ্য বর্জন করতে বলা হচ্ছে এবং মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোর উন্নয়নেও অবহেলা করা হচ্ছে। ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল ২০২৫ মুসলিমদের ধর্মীয় সম্পত্তি এবং ঐতিহ্যকে আরো সংকুচিত করতে পারে। ওয়াকফ সম্পত্তির মূল্য লক্ষাধিক কোটি রুপি হলেও সঠিক ব্যবস্থাপনা ও প্রয়োগের অভাবে তা মুসলিমদের কল্যাণে যথাযথভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। এ বিলের মাধ্যমে সরকারের হস্তক্ষেপ আরো বেড়ে যাবে, যা মুসলমানদের জন্য একটি বড় সংকট। ভারতের মুসলিমরা বর্তমানে সাংস্কৃতিকভাবে এবং সামাজিকভাবে এক চরম সংকটে রয়েছে। মিডিয়া, শিক্ষা, রাজনীতি এবং সমাজে তাদের চিত্রায়ণ নেতিবাচক। মুসলমানদের নাম, পোশাক, ধর্মীয় চিহ্ন-এই সবই এখন হুমকির মুখে। এদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে এবং তারা সামাজিকভাবে প্রান্তিক হয়ে পড়ছে। আজ ভারতীয় মুসলমানদের সামনে এক অন্ধকার ভবিষ্যৎ। এ বিল, সন্ত্রাস, সহিংসতা এবং সামাজিক বৈষম্যের চাপের মধ্যে তারা ক্রমেই তাদের ধর্মীয় অধিকার এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় হারাতে বসেছে। আর কতোদিন তাদের এ কষ্ট সহ্য করতে হবে? ভারতীয় মুসলমানদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ এবং সমতা প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। ভারতের সংবিধান আমাদের সকল নাগরিকের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে, কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকর হচ্ছে না। এখনো মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্পত্তি ও সমাজে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়নি।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।