বিশ্বের ঐতিহাসিক যুদ্ধগুলোর অন্যতম একটি অবিস্মরণীয় যুদ্ধ হচ্ছে পলাশীর যুদ্ধ। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আমবাগানে সংঘটিত এ যুদ্ধকে অনেকেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। অনেকে মনে করেন এতদঞ্চলের কোনো একটি ধর্মীয় সংখ্যা গরিষ্ঠ ভূ-খন্ডের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশে তাদের রাজত্ব ও আধিপত্যবাদ কায়েম করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ইতিহাসের কলঙ্কময় ঐ দিন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা ঘটে। বাংলার স্বাধীন নবাবের এ অমানবিক পতনের মাধ্যমে শুধু একটি শাসকের পতন ঘটেনি, বরং এটি ছিল একটি জাতির রাজনৈতিক ঐক্য, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পতন। অস্ত্রের প্রাচুর্যের পরিবর্তে সেদিন বেশি শক্তিশালী ছিল ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার। নবাবের সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে থাকা বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর, নবাবের আপন খালা ঘোসেটি বেগম ও তার অনুগত সেনানায়কদের ষড়যন্ত্রেই নবাব সিরাজ-উদ্দৌলা পলাশীর প্রান্তরে পরাজিত হয়। যার ফলে সত্যিকার পদ্ধতিগত সমরযুদ্ধ না করেও ব্রিটিশরা অতি সহজে বিজয় অর্জন করে। পরবর্তীতে তারা ব্যবসায়ী ও নীল চাষ থেকে শুরু করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়। উপমহাদেশে বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের ওপর এক ঘন কালো মেঘ নেমে আসে। এখনো পলাশীর ষড়যন্ত্রের রাজনৈতিক কালো মেঘ আরো ঘন ও প্রবলরূপে দেখা যাচ্ছে। যা আত্মঘাতী যুদ্ধের নামান্তর।

এমনিভাবে ২০২৪ সালের জুলাই-আগষ্ট বিপ্লব উত্তর নতুনভাবে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট পলাশী যুদ্ধের চেতনা খুবই কার্যকর হিসেবে বিবেচিত। পলাশীর প্রান্তরে যেসব কুশীলব ষড়যন্ত্রের লাঠি ঘুরিয়েছিল, তাদের অনুকরণে বর্তমান রাজনৈতিক গঠনপ্রণালীতে নেতৃত্বের বিবেচনায় এবং জনগণের সতর্কতার শূন্যতার মধ্যে পলাশীর ইতিহাসকে চেতনা মনে করার যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে। পলাশী যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে-এখানে ব্রিটিশরা যেমন জয়লাভ করেছিল, তেমনি এদেশের স্বার্থপর বিশ্বাসঘাতক লোভাতুর লোকগুলো জয়লাভ করেছিল। আজও যখন বিদেশি প্রভাব বা কূটনৈতিক চাপে আমাদের অভ্যন্তরীণ নীতি নির্ধারিত হয়, উন্নয়ন প্রকল্প ও নিরাপত্তা ইস্যুতে বৈদেশিক শক্তির স্বার্থ অগ্রাধিকার পায় তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে, পলাশীর প্রেতাত্মারা এখনো আমাদের রাজনীতির অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে এ ডাল থেকে ও ডালে শকুনের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। এছাড়া রাজনৈতিক বিভেদ, দলীয় স্বার্থ ঠিক রেখে জাতীয় স্বার্থ ধ্বংস করা, ক্ষমতার অন্ধ মোহে আচ্ছন্ন হয়ে এক দল অপর দলকে ঘায়েল করার চেষ্টা এবং পুরাতন ঘিঁতে নতুন করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার অশুভ প্রবণতা আজও আমাদের রাজনৈতিক আকাশে মেঘের পরিধি বৃদ্ধি করা হচ্ছে। নবাবের পতনের সময় অভ্যন্তরীণ অনৈক্য ও আত্মঘাতী বিভেদই ছিল আসল শক্তি। পলাশীর ঐতিহাসিক শিক্ষা বাঙালি জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, জাতীয় ঐক্য ব্যতীত কোনো জাতি শক্তিশালী অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। নেতৃত্বের নৈতিকতা আজ ধ্বংস প্রায়।

১৮৫৭ সালের অশুভ পরিণতি বাঙালি জাতিকে নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়াতে শিক্ষা দেয়। নেতৃত্বের মধ্যে যখন সততা, আদর্শ, নীতি- নৈতিকতা ও কৌশল যখন বিপদগামি হয়ে যায়, তখন পুরো জাতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত খাদে নিক্ষিপ্ত হয়। পলাশীর নবাব নির্ভিক ও সাহসী থাকা সত্ত্বেও, তার চারিপাশে থাকা আপনজনদের ষড়যন্ত্র বুঝতে না পেরে তিনি পরাজিত হন। তেমনি যদি আজও রাজনৈতিক নেতৃত্বে লোভাতুর, দখলবাজ, চাটুকার পরিবেষ্টিত ও আদর্শহীন হয়ে পড়ে, তাহলে বর্তমান জাতি নতুনভাবে ভুল পথে পরিচালিত হতে বাধ্য। তাই জনগণকে সবসময় সচেতন থাকতে হবে, যাতে নতুন কোনো পলাশী আমাদেরকে গ্রাস করতে না পারে। আমাদেরকে উপলব্ধি করতে হবে জনগণের অংশ গ্রহণ ছাড়া কখনো কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন ও টিকে থাকতে পারে না। ১৭৫৭ সালের নির্মম পরিণতি আমাদের জাতীয় জীবনে আর ফিরে না আসুক-এটিই আমাদের প্রত্যাশা।

এজন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। আমরা যদি জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আবারও ব্যর্থ হই, তাহলে ভবিষ্যতে দেশ এক কন্টকময় গর্তে নিক্ষিপ্ত হবে। তাই আর কোনো ষড়যন্ত্রের পলাশী নয়, মতাদর্শের পার্থক্য ভুলে গিয়ে দেশ গড়ার অঙ্গীকারে সকলকে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। সকল অশুভ শক্তির তৎপরতা মোকাবেলা করে নৈতিকতা ও জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে একটি মব জাস্টিস বিরোধী ইনসাফ ভিত্তিক জনকল্যাণমুখী গণতান্ত্রিক নতুন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে। এটিই হোক জাতির প্রত্যাশা।

লেখক : শিক্ষাবিদ গবেষক ও কলামিস্ট।