মুহাম্মদ আবুল হুসাইন

বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা কী? এই প্রশ্নের উত্তরে সবাই একবাক্যে বলবেন দুর্নীতি। টিআই’র প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল টানা পাঁচ বছর এবং ২০০৯ সালে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ছিল। এর মধ্যে ২০০১ সাল ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ বছর। আর ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিন সরকার। অপর দিকে ২০০২ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত ছিল বিএনপির শাসনামল।

৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। কমিটি গত ২ ডিসেম্বর ২০২৪ আনুষ্ঠানিকভাবে শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। ৪০০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্রে বিগত স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাটসহ অর্থনীতির নানা বিষয়ের তথ্যচিত্র উঠে আসে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে এক অনুষ্ঠানে এ শ্বেতপত্র প্রকাশ করেন কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি জানান, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে ২৮ উপায়ে দুর্নীতির মাধ্যমে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, দেশে গত পনের বছরে ‘চামচা পুঁজিবাদ থেকেই চোরতন্ত্র’ তৈরি হয়েছিলো, যাতে রাজনীতিক, সামরিক ও বেসামরিক আমলা, বিচার বিভাগসহ সবাই অংশ নিয়েছে। এসময় তিনি দুর্নীতিকে বাংলাদেশের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেন।

এর আগে গত বছরের ১৭ জানুয়ারি (শেখ হাসিনা সরকারের আমলে) বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)’র এক জরিপ প্রতিবেদনেও ব্যবসা-বাণিজ্যে দুর্নীতিকে বাংলাদেশের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ৬৮ শতাংশ ব্যবসায়ী উচ্চমাত্রার দুর্নীতির এ সমস্যাকে এক নম্বর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দ্বিতীয় স্থানে আছে অদক্ষ আমলাতন্ত্র। প্রায় ৫৫ শতাংশ ব্যবসায়ী এটি মনে করেন। আর ব্যবসা-বাণিজ্যে তৃতীয় বড় সমস্যা হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতার (রিজার্ভ ঘাটতি) বিষয়টিকে মনে করেন ৪৬ শতাংশ ব্যবসায়ী। এ উপলক্ষে ধানমণ্ডির সিপিডির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবসা- বাণিজ্যের পরিবেশে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ তলানিতে আছে। ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডসহ এশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায়ও বেশ পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।

সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, একজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, তিনি একটি পরিষেবা সংযোগ নিতে আবেদন করলে তাঁর কাছে যে পরিমাণ ঘুস চাওয়া হয়েছিল, তা তাঁর পরিকল্পিত বিনিয়োগের সমপরিমাণ। বড় ব্যবসায়ীরা কোনো না কোনোভাবে ঘুস-দুর্নীতি সামলে নিতে পারলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের কাছে এটি বড় সমস্যা। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের মতে, ঘুস-দুর্নীতি বন্ধসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের সমস্যা সমাধানে (তৎকালীন সরকারের) রাজনৈতিক শীর্ষ পর্যায়ে ‘সদিচ্ছার প্রতিফলন আছে। নির্বাচনী ইশতেহারেও অঙ্গীকার করা হয়েছে।’ তবে এর বাস্তবায়ন দরকার।

প্রতিবেদনে মোটাদাগে ব্যবসা-বাণিজ্যে ১৭টি সমস্যা চিহ্নিত করেছে সিপিডি। শীর্ষ তিনটি ছাড়া অন্য সমস্যাগুলো হলো-অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা, জটিল কর নীতি, বারবার নীতি পরিবর্তন, দক্ষ শ্রমশক্তির অভাব, উদ্ভাবনের সক্ষমতায় ঘাটতি, শ্রমশক্তিতে দুর্বল নৈতিকতা, উচ্চ করহার, জলবায়ু পরিবর্তন, সরকারের অস্থিতিশীলতা, অপরাধ ও চুরি, বিধিনিষেধমূলক শ্রম আইন ও দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা। বলা বাহুল্য এসব সমস্যাও সুশাসনের অভাব এবং অপশাসন থেকে উদ্ভূত।

ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশের উন্নতি করতে সিপিডি ১০টি সুপারিশ করেছে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করার জন্য দেশের সুশাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। সুপারিশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-ব্যবসায় বাণিজ্যের পরিবেশের উন্নতিতে বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়ের ১০০ দিন, ১ বছর, ৩ বছর ও ৫ বছরের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন; ন্যায়পাল কার্যালয় স্থাপন; সীমিত সময়ের জন্য খাতভিত্তিক কিছু কমিশন গঠন, যেমন ব্যাংক, শেয়ারবাজার, নিয়ন্ত্রক সংস্থার সংস্কার; একটি সমন্বিত আর্থিক লেনদেন খাত প্রতিষ্ঠা; সরকারি কেনাকাটা ব্যবস্থা আধুনিক করা ইত্যাদি। ব্যবসায়ীদের মতামতের ভিত্তিতে জরিপটি করেছে সিপিডি। মূলত ২০২৩ সালে ব্যবসায় পরিবেশ কেমন ছিল, সেটা বিশ্লেষণ করার জন্য এ জরিপ করা হয়। গত বছরের মে-জুলাই সময়ে ঢাকা, গাজীপুর ও সাভারের বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ৭১ শীর্ষ কর্মকর্তার মতামত নেওয়া হয়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সহায়তায় এ জরিপ করা হয়।

সর্বশেষ গত ২৫ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশের ‘সবচাইতে বড় সমস্যা’ সীমাহীন দুর্নীতি। তিনি বলেন, দুর্নীতির ফলে শুধু যে সবকিছুতে ‘অবিশ্বাস্য রকম ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে’ তা নয়, এর ফলে সরকার ও জনগণের সকল আয়োজন ‘বিকৃত’ হয়ে যায়। সরকারের লক্ষ্য, নীতিমালা, প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন, সরকারি কর্মকর্তাদের দায়দায়িত্ব যা কিছু কাগজে লেখা থাকে তার সবকিছু অর্থহীন হয়ে যায়। দেশ চলে অলিখিত আয়োজনে। সরকারকে চলতে হয়, ব্যবসায়ীকে চলতে হয়, শিল্পপতিকে চলতে হয়, বিনিয়োগকারীকে চলতে হয়, দেশের সকল নাগরিককে এই অলিখিত নিয়মে চলতে হয়।”

শ্বেতপত্র প্রকাশের পর বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতির এক ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে, যা সমস্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

শ্বেতপত্র যা বলছে :

১. শ্বেতপত্রে যে তথ্য দেয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছে শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার অর্থ তছরূপ ও অবৈধভাবে পাচার হয়েছে।

২. বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে মেগা প্রকল্পগুলোতে। ১৫ বছরে প্রকল্পের খরচ গড়ে ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রকল্পগুলো শেষ করতে গড়ে পাঁচ বছরের বেশি সময় লেগেছে।

৩. বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)-এর মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা ৬০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে প্রায় ১৪ থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলার (১.৬১ থেকে ২.৮০ লাখ কোটি টাকা) রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুস এবং বাজেট বাড়ানোর মতো বিভিন্ন দুর্নীতির কারণে নষ্ট হয়েছে।

৪. রাজনৈতিক প্রভাব ব্যাংকিং খাতের সংকটকে গভীর করেছে। বিগত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাতে যে মন্দ ঋণ তৈরি হয়েছে, তা দিয়ে ১৪টি মেট্রোরেল বা ২৪টি পদ্মা সেতু করা যেত।

৫. ধারাবাহিক ঋণ খেলাপীর ঘটনা এবং বড় ধরনের কেলেঙ্কারিগুলো আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করেছে এবং উৎপাদনশীল খাত থেকে পুঁজি অন্য দিকে সরিয়ে নিয়ে গেছে বলেও শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে।

৬. অভিবাসন খাতে গত এক দশকে প্রায় সাড়ে তের লাখ কোটি টাকা সরানো হয়েছে হুন্ডিতে লেনদেনের মাধ্যমে। মূলত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে ভিসা ক্রয়ের নামে এ টাকা বিদেশে গেছে। শ্বেতপত্রে বলা হয়, এ টাকা মতিঝিল-উত্তরা রুটের মেট্রোরেল নির্মাণ খরচের চারগুণ।

৭. সিন্ডিকেট ও অনৈতিক রিক্রুটমেন্ট চর্চার কারণে সত্যিকার অভিবাসী কর্মীরা ক্ষতির শিকার হয়েছে এবং দেশ রেমিট্যান্স থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

৮. শ্বেতপত্রে আরও বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ভুয়া বরাদ্দগুলোর কারণে লাখ লাখ মানুষ ঝুঁকিতে পড়েছে। জলবায়ু তহবিলে দুর্নীতির অভিযোগও আনা হয়েছে শ্বেতপত্রে।

৯. ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান জানান, তারা ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে সাতটি বড় প্রকল্প পরীক্ষা করে দেখেছেন প্রতিটিতে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। ২৯টি বড় প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ৮৭ বিলিয়ন ডলার বা ৭ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।”

১০. পরীক্ষা করা সাতটি প্রকল্পের আনুমানিক প্রাথমিক ব্যয় ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। অতিরিক্ত উপাদান যোগ করে, জমির দাম বেশি দেখিয়ে এবং ক্রয়ের ক্ষেত্রে হেরফের করে প্রকল্পের ব্যয় সংশোধিত করে ১ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়। ব্যয়ের সুবিধা বিশ্লেষণ না করেই প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।

কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক এ কে এনামুল হক বলেন, গত ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ৭ লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে এবং এর ৪০ শতাংশ অর্থ আমলারা লুটপাট করেছে।

কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আবু ইউসুফ জানান, বিগত শাসনামলে কর অব্যাহতির পরিমাণ ছিল দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ। এটি অর্ধেকে নামিয়ে আনা গেলে শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ এবং স্বাস্থ্য বাজেট তিনগুণ করা যেতে পারত বলে জানান তিনি।

কমিটির আরেক সদস্য ম. তামিম বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে, এবং ১০ শতাংশ যদি অবৈধ লেনদেন ধরা হয়, তাহলে পরিমাণ হবে কমপক্ষে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বলা বাহুল্য, দুর্নীতিকে আড়াল ও নির্বিঘ্ন করার জন্যই নন ইস্যুকে ইস্যু বানিয়ে দেশে একটি ধুম্রজাল তৈরি করা হয়েছিল। দেশের মূল সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে সরানোর জন্য এবং দেশে একটি অহেতুক অস্থিরতা তৈরি করার জন্য জামায়াতকে টার্গেট করা হয়। চার দশকেরও বেশি সময় পর একটি বেসামরিক রাজনৈতিক দল জামায়াতের নামে মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘যুদ্ধাপরধাদের’ কল্পিত ও হাস্যকর অভিযোগ আনা হয় এবং সাক্ষ্য আইন পরিবর্তন করে বিচারের নামে প্রহসন করে দলটিকে নেতৃত্বশূন্য করার লক্ষ্যে প্রথম সারির নেতৃবৃন্দকে ফাঁসি ও আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়াও হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার ও নির্যাতন করা হয়, হত্যা করা হয়, গুম করা হয়। এরপর বিএনপিকে টার্গেট করা হয়। এ দলটিরও হাজার হাজার নেতা কর্মীর উপর নির্যাতন করা হয়। মূলত এই সবকিছু উদ্দেশ্য ছিল দেশকে বিরোধী দলশূন্য করা বা দুর্বল করে রাখা যাতে সরকারের স্বৈরাচারী শাসন ও দুর্নীতিকে নির্বিঘ্ন করা যায়।

সুতরাং শুধু ক্ষমতার পালাবদল নয়, রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন প্রয়োজন। যাতে ভবিষ্যতে আর কোন ফ্যাসিবাদ- মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে এবং দুর্নীতির হাত থেকে এদেশের মানুষ রক্ষা পায়। এজন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করা প্রয়োজন যাতে রাজনীতির ময়দান থেকে ক্ষমতার লোভী দুর্নীতিবাজ অসৎ লোকগুলো বিদায় নিতে বাধ্য হয় এবং দেশে সুস্থ ধারার রাজনীতি ফিরে আসে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।