বিশ্বজনীন জীবনাদর্শ ইসলামের প্রচার, প্রসার ও বিজয় শুধু জাজিরাতুল আবরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং এর ব্যাপ্তী ঘটেছিলো বিশ্বময়। বিশ্বনবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় তার আসহাবগণ বিশ্বের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ইসলামের দাওয়াতের সফল সম্প্রসারণ ঘটিয়েছিলেন। মূলত, মক্কার নির্জন হেরা গুহায় বিশ্বনবী (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ ‘ইকরা’-এর মাধ্যমে যার সূচনা হয়েছিলো। তার ওফাতের পর পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ইসলামের বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন সাহাবায়ে কেরাম।
ব্যাপকভাবে ইসলামের বিকাশ ঘটে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর শাসনকাল থেকে। সাহাবাদের যুগ থেকে বিভিন্ন মুসলিম শাসনামল, দেশ-মহাদেশে, বর্তমান সময়কাল, এখনও বিভিন্ন ভূখণ্ড, জনপদের মানুষ নতুন করে জানছে ইসলামকে। শান্তি খুঁজে নিচ্ছে রবের একমাত্র মনোনীত ধর্মে। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকার ইথিওপিয়ায় ইসলাম পৌঁছে প্রিয় নবী (সা.)-এর যুগে। বিখ্যাত সাহাবী ও তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা.)-এর নেতৃত্বে একটি ক্ষুদ্র দল হাবশায় ইসলাম পৌঁছায়। সিরিয়ার দামেস্ক ও হিমসে ইসলামের আগমন ঘটে দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.)-এর শাসনামলে। সাহাবী আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ এবং খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)-এর নেতৃত্বে বিজয় হওয়ার মাধ্যমে। রাশিয়ার দরবন্দেও ইসলাম পৌঁছে দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.)-এর শাসনামলে। ইরাকেও ইসলাম পৌঁছায় দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.)-এর শাসনামলে সাহাবি সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)-এর নেতৃত্বে বিজিত হওয়ার মাধ্যমে। আজারবাইজানে ইসলাম আগমন করে দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.)-এর শাসনামলে উতবা ইবনে ফারকাদ আস-সালামির নেতৃত্বে। তিনি আজারবাইজানের প্রধান শহর তাবরিজ বিজয় করার মাধ্যমে ইসলামের সূচনা করেন। ইরানের তেহরান ও নিশাপুরে ওমর (রা.)-এর শাসনামলে বিজিত হয়ে ইসলাম পৌঁছে।
চীনে সর্বপ্রথম ইসলামের আগমন ঘটে সাহাবি সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস (রা.) এবং তাঁর সফরসঙ্গীদের মাধ্যমে। তাঁরা সেখানে ব্যবসা করার জন্য প্রথমে গমন করেন। আর সে সময় থেকে ইন্দোচীনের দক্ষিণাঞ্চল তথা থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটতে শুরু করে। বর্তমানে কম্বোডিয়ায় ইসলাম একটি ক্রমবর্ধমান জীবনাদর্শ। সেখানকার মুসলমানরা খুবই শান্তিপ্রিয় ও অসাম্প্রদায়িক।
মূলত, কম্বোডিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোচীন উপদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত একটি দেশ। এর আয়তন ১,৮১,০৩৫ বর্গকিলোমিটার (৬৯,৮৯৮ বর্গমাইল) এবং দেশটির উত্তর-পশ্চিমে থাইল্যান্ড, উত্তরে লাওস, পূর্বে ভিয়েতনাম এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে থাইল্যান্ড উপসাগর অবস্থিত। দেশটির রাজধানী ও বৃহত্তম শহর নমপেন। সার্বভৌম কম্বোডিয়া রাষ্ট্রের জনসংখ্যা ১৭ মিলিয়নেরও বেশি। সংবিধানে বৌদ্ধধর্মকে দাফতরিক রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং জনসংখ্যার ৯৭ শতাংশেরও বেশি এটি অনুশীলন করে। কম্বোডিয়ার সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভিয়েতনামি, চীনা, চাম ও ৩০টি পাহাড়ি উপজাতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। রাজধানী ও বৃহত্তম শহর নমপেন হল কম্বোডিয়ার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। রাজ্যটি হল একটি নির্বাচনী সাংবিধানিক রাজতন্ত্র যার একজন রাজা আছেন। বর্তমানে নরোদম শিহামনি দেশটির রাজা। সরকারপ্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী, বর্তমানে হুন সেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘকালীন অরাজকীয় নেতা, যিনি ১৯৮৫ সাল থেকে শাসন করেছেন।
প্রাচীনকাল থেকেই কম্বোডিয়াতে রাজতন্ত্র বিদ্যমান ছিল। এক হাজার বছর আগেও কম্বোডিয়া খেমার জাতির আংকর সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল। আংকর সাম্রাজ্যটি ৬০০ বছর ধরে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে বিস্তৃত ছিল। ১৮৬৩ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এটি একটি ফরাসি প্রোটেক্টোরেট ছিল। ১৯৭০ সালে রাজতন্ত্রের স্থানে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ১৯৭৫ সালে খেমার রুজ নামের একটি সাম্যবাদী সরকার ক্ষমতা লাভ করে। তারা দেশটিকে গণতন্ত্রী কাম্পুচিয়া নাম দেয়। ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার খেমার রুজ-বিরোধী শক্তি সরকারটির পতন ঘটায় এবং অপেক্ষাকৃত সহিষ্ণু একটি সাম্যবাদী সরকার গঠন করে। ১৯৮৯ সালে দেশটি সমাজতন্ত্র পরিত্যাগ করে এবং ১৯৯৩ সালে একটি নতুন সংবিধান পাস করে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক নাম ‘দ্য কিংডম অব কম্বোডিয়া’। দেশটির উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে থাইল্যান্ড, উত্তরে লাওস, পূর্বে ভিয়েতনাম, দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে থাই উপসাগর। দেশটির মোট আয়তন এক লাখ ৪১ হাজার ৩৫ বর্গকিলোমিটার।
২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে মোট জনসংখ্যা এক কোটি ৬৭ লাখ ১৩ হাজার ১৫ জন। তাদের মধ্যে ৯৭ শতাংশ বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী, ২ শতাংশ মুসলমান। তবে স্থানীয় মুসলিম সূত্রগুলোর দাবি, মুসলমানদের প্রকৃত সংখ্যা ১০ শতাংশের কাছাকাছি। মুসলিমরা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় জনগোষ্ঠী এবং তাদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কম্বোডিয়ায় বসবাসকারী বেশির ভাগ মুসলিম চ্যাম ও মালয় বংশোদ্ভূত এবং তারা সুন্নি মতাদর্শ ও শাফেয়ি মাজহাবের অনুসারী। তবে জাতিগত কম্বোডিয়ানদের ক্ষুদ্র একটি অংশও ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। কম্বোডিয়ায় ইসলামের প্রচার-প্রসারে দাওয়াত ও তাবলিগের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। চ্যাম জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা কম্বোডিয়া ছাড়াও ভিয়েতনাম ও লাওসে বসবাস করে।
খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে চ্যাম জনগোষ্ঠী দক্ষিণ ভিয়েতনামের উপকূলজুড়ে চম্পা রাজ্য গঠন করে। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের দাবি, রাসূল (সা.)-এর শ্বশুর জয়নব বিনতে জাহাশ (রা.)-এর বাবা হযরত জাহাশ (রা.)-এর মাধ্যমে চ্যামরা ইসলামের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। তিনি একদল সাহাবী নিয়ে ৬১৭ খ্রিস্টাব্দে ইন্দো-চীন অঞ্চলে সফর করেন। খ্রিস্টীয় নবম শতকে চ্যাম সমাজে ইসলাম জনপ্রিয় হতে থাকে। ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে একজন চ্যাম রাজা ইসলাম গ্রহণ করলে চ্যাম জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে।
১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েতনাম চম্পা রাজ্য দখল করলে মুসলিম চ্যামরা কম্বোডিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে। চ্যাম জনগোষ্ঠীর আরেক ধারা, যাদের চেভিয়া বলা হয় তারাও মুসলিম ও সুন্নি মতাদর্শের অনুসারী। তারা খেমার ভাষায় কথা বলেন এবং ইন্দোনেশিয়ার জাভা থেকে তাদের উৎপত্তি। চ্যামদের একটি বিশেষ ধারা ‘জাহিদ’। যারা চম্পা রাজ্যের শাসক ও অভিজাতদের উত্তরসূরি বলে দাবি করে। রাজ্যছাড়া হওয়ার পর তাদের পূর্বসূরিরা উদংয়ের আশপাশে বসতি স্থাপন করে। তবে অন্যদের তুলনায় তারা ধর্ম পালনে খানিকটা পিছিয়ে।
চ্যামরা সাধারণত নিজস্ব গ্রামে বসবাস করেন। চ্যাম মুসলিমরা সাধারণত ইসলামী পোশাক পরিধান করে। নারীরা লম্বা চুল রাখেন এবং স্কার্ফ পরে এবং ছেলেরা টুপি পরেন ও দাড়ি রাখেন। চ্যামদের ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দেন সে দেশের ইমামরা, যাদের হাকিম বলা হয় এবং দেশটির মুয়াজ্জিনদের বিলাল বলে সম্বোধন করা হয়। কম্বোডিয়ার কুরআনি মক্তবগুলো মসজিদভিত্তিক। কম্বোডিয়ায় চ্যাম মুসলিমরা ধর্মপালনে মোটামুটি স্বাধীনতা ভোগ করে আসছেন। তবে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত খেমাররুজ শাসনের সময় ব্যাপক নির্যাতন ও গণহত্যার শিকার হন। এ সময় কম্বোডিয়ার ৩৬ শতাংশ চ্যাম মুসলিম নিহত হয়েছেন বলে জানা যায়।
‘দ্য হাইয়েস্ট কাউন্সিল ফর ইসলামিক রিলিজিয়াস অ্যাফিয়ারস কম্বোডিয়া’ (এইসিআইআরএসি) কম্বোডিয়ান মুসলিমদের সর্বোচ্চ সংস্থা, যা দেশটির ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। একজন ইমাম, একজন সহকারী ও কয়েকজন সহকারীর মাধ্যমে সংস্থাটি গঠন করা হয়। সংস্থাটি চ্যাম সমাজের ইমাম নিয়োগ, মুসলমানদের সামাজিক সমস্যার সমাধান ও রাষ্ট্রীয় কাজে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। এ ছাড়া দ্য সেন্ট্রাল ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশন অব কম্বোডিয়া’ এবং ‘কম্বোডিয়া ইসলামিক ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশন’ নামে আরো দু’টি সামাজিক সংগঠন কম্বোডিয়ান মুসলমানদের উন্নয়নে কাজ করছে। রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবনে মুসলমানদের কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে।
মূলত, বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ কম্বোডিয়ায় ইসলাম একটি সংখ্যালঘু ধর্ম। তবে ক্রমবর্ধিষ্ণু ও উদীয়মান। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৯৭৫ সালের শেষের দিকে কম্বোডিয়ায় ১৫০,০০০ থেকে ২০০,০০০ জন মুসলমান ছিল। পরে খেমাররুজদের নিপীড়নের ফলে তাদের সংখ্যা হ্রাস পায় এবং ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে তারা তাদের আগেকার জনবল ও শক্তি হারিয়ে ফেলে। ২০১৬ সালে দেশটির ধর্ম ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তথ্য দেয় যে, কম্বোডিয়ায় মোট ৩৬১,৪৮৩ জন মুসলিম বসবাস করেন, যারা মোট জনসংখ্যার ২.%। অন্যান্য চ্যাম ও মালয় মুসলিমদের মত কম্বোডিয়ার চ্যাম ও মালয় মুসলিমরা সাধারণত সুন্নি ইসলামের শাফেয়ী মাজহাব ও ধর্মীয় দার্শনিক ব্যাখ্যায় মাতুরিদি মতবাদ অনুসরণ করেন। ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত জাতিগত কম্বোডীয়দের একটি ছোট সংখ্যাও রয়েছে। চ্যামদের মাঝে তাবলিগ জামাতের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়েছে।
২০০৯ সালে পিউ রিসার্চ সেন্টার তথ্য দেয় যে, কম্বোডিয়ায় মোট ২৩,৬০০০ জন মুসলিম বাস করেন, যা মোট জনসংখ্যার ১.৬%। কম্বোডিয়ার সংস্কৃতি ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত দেশে প্রায় ৩৬১,৪৮৩ জন মুসলমান ও ৮৮৪টি মসজিদ গোটা কম্বোডিয়া জুড়ে ছড়িয়ে ছিল। ২০১৭ সালে প্রকাশিত পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য মতে, কম্বোডিয়ায় প্রায় ৩১১,০৪৪ জন মুসলিম বাস করেন।
মূলত, ৯ম শতাব্দীতে চ্যাম সমাজে ইসলাম প্রবেশ করতে থাকে। ১৬০৭ সালের পর একজন চ্যাম রাজা ইসলাম গ্রহণ করলে ইসলাম চ্যাম সমাজে রাজকীয় ধর্ম হয়ে ওঠে এবং প্রায় অধিকাংশ চ্যামই ইসলাম গ্রহণ করেন। ১৮৩২ সালের ভিয়েতনাম চম্পা রাজ্য আক্রমণ করে জবর দখল করার ফলে ভিয়েতনাম থেকে পালিয়ে আসা চাম মুসলমানরা কম্বোডিয়ায় আশ্রয় নেয়।
১৬৪২ সালে রাজা প্রথম রামাথিপাদি কম্বোডিয়ার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং কম্বোডিয়ার একমাত্র মুসলিম শাসক হন। এরপর দখলদার ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধিদের হত্যা ও কম্বোডিয়া থেকে কোম্পানিকে বহিষ্কারের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগণ ১৬৫৪ সালে নগুয়েন প্রভুদের সহায়তায় তাকে পদচ্যুত করে। এরা তার শাসনের পরের বছরগুলিতে কম্বোডিয়ায় অনেক অস্থিরতা সৃষ্টি করে রেখেছিল।
চামদের নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত মসজিদ রয়েছে। ১৯৬২ সালে সারাদেশে প্রায় ১০টি মসজিদ ছিল। ১৯ শতাব্দীর শেষের দিকে কম্বোডিয়ার মুসলমানরা চার জন বিশিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তি; তথা: মুফতি, টুক কালিহ, রাজা কালিক ও ত্বান পাকের নেতৃত্বাধীন একটি ঐক্যবদ্ধ সম্প্রদায় গঠন করে। চ্যাম গ্রামগুলিতে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একটি পরিষদ ও একজন হাকেম (শরিয়া বিচারক) ছিল। কম্বোডিয়া স্বাধীন হলে মুসলিম সম্প্রদায়কে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি কাউন্সিলের নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। এটি সরকারী কার্যক্রম ও অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে চ্যাম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করত।
প্রত্যেক মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন হাকেম থাকেন। তিনি সম্প্রদায় ও ইমাম হিসেবে মসজিদে নেতৃত্ব দেন। নমপেনের কাছে অবস্থিত ক্রোয়েচাংভার উপদ্বীপকে চামদের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং সেখানে বেশ কয়েকজন উচ্চ মুসলিম কর্মকর্তা বাস করেন। প্রায় প্রতিবছর কিছু সংখ্যক চ্যাম ছাত্র মালয়েশিয়ার কেলান্তানে কুরআন ও ইসলামি শিক্ষা অধ্যয়ন করতে যায়। কেউ সৌদি আরবে অধ্যয়ন করতে বা হজ করতে যায়। ১৯৫০-এর দশকের শেষের পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রায় ৭% চাম জীবনে একবার হজ করেছেন এবং তারা এর কৃতিত্বের চিহ্ন হিসাবে ফেজ বা পাগড়ি পরতে পারে।
কম্বোডিয়ায় চ্যামদের ওপর নিপীড়ন মূলত ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত খেমাররুজ শাসনামলে ঘটে। ১৯৭৫ সালে খেমার প্রজাতন্ত্রের বাহিনীকে পরাজিত করার পর খেমাররুজ গণতান্ত্রিক কম্পোডিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কমিউনিস্ট পার্টি অফ কাম্পুচিয়া (ঈচক) নামে পরিচিত ছিল। ক্ষমতা গ্রহণ করার পর তারা সমাজতান্ত্রিক নীতির আলোকে গণতান্ত্রিক কম্বোডিয়ার নীতি ও নিয়মকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করে। এর ফলে জনসাধারণ শহরাঞ্চল থেকে গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকভাবে স্থানান্তরিত হয় এবং সেখানে তারা সামান্য খাবার ও বিশ্রাম নিয়ে প্রতিদিন মাঠে কাজ করতে বাধ্য হয়।
সর্বোপরি খেমাররুজ শাসন পদ্ধতিগতভাবে জনগণের আর্থ-সামাজিক কাঠামো ভেঙে ফেলতে শুরু করে এবং তাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও জাতিগত পটভূমির উপর ভিত্তি করে স্ক্রীন করা শুরু করে। তখন ইসলাম তো বটেই, এমনকি কম্বোডিয়ার সমাজে প্রভাবশালী বৌদ্ধধর্মকেও দমন করা হয়। পণ্ডিত ও ইতিহাসবিদরা অনুমান করেন, তখন কম্বোডিয়ার জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ খেমাররুজ শাসনে নিহত হয় বা অনাহার ও রোগের কারণে মারা যায়। যারা সংখ্যায় প্রায় ১.০৫ থেকে ২.২ মিলিয়ন জনগণ। তখন শাসকদের হাতে নিপীড়ন, নির্যাতন ও মৃত্যুর হাত থেকে চামরাও রেহাই পায়নি। ইতিহাসে এটিকে কম্বোডিয়ার গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
মূলত, কম্বোডিয়ায় ইসলাম সরকারীভাবে স্বীকৃত ধর্ম। মুসলমানরা স্বাভাবিক ও খোলামেলাভাবে তাদের ধর্ম পালন করতে পারেন। দেশের অন্যান্য নাগরিকের মত চামরাও গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করে। তাদের ভোট দেওয়া এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার অধিকার আছে। পবিত্র রমজান মাসে সরকার বার্ষিক ইফতার সমাবেশের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ২০১৮ সালে ওআইসি কম্বোডিয়াকে মুসলিম সহাবস্থানের বাতিঘর বলে অভিহিত করেন। মূলত, ইসলাম কম্বোডিয়ায় অতি ঐতিহ্যবাহী ধর্ম। সরকারিভাবে দেশটিতে মুসলমানের সংখ্যা ২ শতাংশ বলা হলেও মুসলিম সূত্রগুলো বলছে, দেশটিতে মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশ। সেখানকার মুসলমানরা বেশ ধর্মপরায়ন এবং নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে গর্বের সাথে সেখানে বসবাস করছেন। দেশটিতে সাম্প্রদায়িক সমস্যা নেই বললেই চলে। তাই তারা ধর্ম পালনে অনেকটাই স্বাধীন।
তবে সেখানে মুসলমানদের প্রতিনিয়ত নানা প্রতিকূলতার মধ্যেই বসবাস করতে হয়। মূলত, কম্বোডিয়া একটি দারিদ্রপীড়িত দেশ। ধর্মীয় সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে সেখানকার মুসলমানরা আরও পশ্চাদপদ। দারিদ্র, অশিক্ষা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে পশ্চাদপদতা মুসলমানদের সমস্যাগুলোর মধ্যে উন্নতম। সর্বোপরি ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত খেমাররুজ বাহিনীর ব্যাপক গণহত্যার কারণে মুসলমানরা বেশ বিপর্যস্ত। তাই কম্বোডিয়ার মুসলমান ধর্মীয় স্বাতন্ত্র রক্ষা এবং পশ্চাদপদতা থেকে মুক্ত করার মুসলিম বিশ্বকে খোলা মন নিয়ে এগিয়ে আসা দরকার। তাহলে কম্বোডিয়ার মুসলমানরা স্বমহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবেন। আর ইসলাম হয়ে উঠবে এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি।