DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

কলাম

সামাজিক অস্থিরতার দায়

মানুষের চেহারা দেখে যেমন তার রাগ, ক্ষোভ, অভিমান বুঝা যায় তেমনিভাবে একটি রাষ্ট্রের আইনের শাসন ভালো নাকি মন্দ তা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি কিংবা অবনতি দেখে একটা ধারণা পাওয়া যায়। পতিত ফ্যাসিস্ট ৫ আগস্টের

Printed Edition
Default Image - DS

মানুষের চেহারা দেখে যেমন তার রাগ, ক্ষোভ, অভিমান বুঝা যায় তেমনিভাবে একটি রাষ্ট্রের আইনের শাসন ভালো নাকি মন্দ তা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি কিংবা অবনতি দেখে একটা ধারণা পাওয়া যায়। পতিত ফ্যাসিস্ট ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়ার কয়েক দিন পর দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করার পর জনমনে স্বস্তি ফিরে আসে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হয়নি; বরং দিন দিন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যখন স্বৈরশাসকের বিদায় হয় তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়। এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু মাসের পর মাস অবনতি হওয়া মোটেও সুখকর নয়! এভাবে সামাজিক অস্থিরতা চলতে থাকলে জনমনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা বাড়বে, দেশ সংকটে পড়বে। সুতরাং জরুরি ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন করা প্রয়োজন।

পৃথিবীর প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তার বিধান নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। দেশের নাগরিকদের বাধাহীন স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করার জন্যে রাষ্ট্রের বিশাল নিরাপত্তাবাহিনী রয়েছে। রাষ্ট্রীয় এ বাহিনী কোন দল বা গোষ্ঠীর একক সম্পদ নয়; এ বাহিনী দেশের সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে বদ্ধপরিকর। যে কোন দুর্যোগ কিংবা বিপদমুর্হূতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যবৃন্দ জীবন বাজি রেখে জনগণের পাশে থেকেছেন তা করোনার সময় দেশবাসী লক্ষ্য করেছে। কিন্তু এ বাহিনীর সুনাম গুটিকয়েক দুষ্ট মানুষের জন্য কলঙ্কিত হচ্ছে, যা সত্যিই বেদনাদায়ক। রাষ্ট্রীয় এ বাহিনীর দুর্বলতার কারণে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে। নৃশংস ঘটনা এখন নিত্যদিনের সঙ্গী। কখনো শত্রুতাবশত, কখনো স্বার্থের দ্বন্দ্বে, কখনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে, কখনো অর্থের লোভে মানুষ মানুষকে খুন করতে কুন্ঠাবোধ করছে না। এমনকি নিজের আত্মীয়স্বজন ও নিজের পরিবারের সদস্যদের ভেতর হত্যার ঘটনা বাড়ছে। গত ২ মার্চ গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার বারিষাব ইউনিয়নের কুশদী গ্রামে পারিবারিক বিরোধের জেরে দেবরের ছুরিকাঘাতে বৃষ্টি আক্তার নামে একজন নিহত হয়েছেন।

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আমরা নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম। এমন নৈরাজ্য পরিস্থিতি দেখার জন্য আমাদের সন্তানেরা জীবন দেয়নি। খুনি হাসিনার শাসনামল আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শাসনামলের ভেতর আমরা পার্থক্য দেখতে চায়। পতিত আওয়ামী সরকারের দোসরদের কঠোর হস্তে দমন করতে না পারলে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব আবার বিপন্ন হবে। সুতরাং সময় থাকতেই সরকারকে সাবধান হতে হবে। কারণ সাবধানের মার নেই। পতিত ফ্যাসিস্ট পালিয়ে যাওয়ার পর দেশজুড়ে চাঁদাবাজি, দখল বাণিজ্য, মব জাস্টিস ও ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছে। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও সাধারণ মানুষ ছিনতাইকারীদের শিকার হচ্ছে। প্রকাশ্যে দিনের বেলায় বিভিন্ন যানবাহনে ছিনতাই হচ্ছে। দেশের বিভিন্নস্থানে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও খুনাখুনির ঘটনা গণমাধ্যমে মুদ্রিত হচ্ছে। সম্প্রতি উত্তরায় প্রকাশ্যে রিকশা আরোহীকে রামদা দিয়ে কোপানোর ঘটনার রেশ না কাটতেই ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে বাসের মধ্যে ডাকাতির ঘটনা এবং রাজধানীর বনশ্রীতে বাসার সামনে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি ও ছুরিকাঘাতের ঘটনা জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কোনভাবেই অপরাধের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসররা এখনো বহাল তবিয়তে চলাফেরা করছে। তাদের এক নেতার বক্তব্য তো রীতিমত ভাইরাল। তিনি বলেছেন- ‘‘যে শহরে দিনের বেলায় আমরা চলতে ফিরতে পারিনা সে রাজধানীতে রাতের বেলা কেউ ঘুমাতে পারবে না।’’ হাসিনা সরকারের শাসনামলে এমন বক্তব্য কেউ দিলে সাথে সাথে তাকে গ্রেফতার করা হতো। তুচ্ছ ঘটনার অপরাধে মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা কিংবা গণপিটুনির ঘটনা বেড়েছে। গত আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ৭ মাসে গণপিটুনিতে প্রায় ১২৭ জন মারা গেছে এবং আহত হয়েছে বেশুমার। সব ঘটনা লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না। শুধুমাত্র চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ৭টি। এতে ৬ জনের মৃত্যু ঘটেছে। (সূত্র : ৩ মার্চ সংগ্রাম)

গণপিটুনি দিয়ে কাউকে হত্যা করা মোটেও দেশের জন্য কল্যাণকর নয়। কেউ যদি কোনো অপরাধ করে থাকে তাকে পিটিয়ে কিংবা গুলি করে হত্যা করার লাইসেন্স রাষ্ট্র কাউকে দেয়নি। কাউকে পিটিয়ে হত্যা করাও অপরাধ। এটি মেনে নেয়া যায় না।

আইন-আদালত থাকতে এ ধরনের ঘটনা বেড়ে যাওয়া মানে রাষ্ট্রের আইনের প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থা ও অনিহার বহিঃপ্রকাশ। যারা এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন, তারা সকলেই সমান অপরাধী। গণপিটুনি একটি বেআইনী কর্মকাণ্ড। অথচ দিন দিন গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা বাড়ছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রে (আসক) এর ভাষ্য অনুসারে ২০২০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে দেশে গণপিটুনিতে সর্বোচ্চ নিহত হওয়ার ঘটনা ২০২৪ সালে ঘটেছে। ২০২৪ সালে গণপিটুনিতে নিহত হন ১৪৬ জন, যা আগের বছরের প্রায় তিন গুণ। ২০২৩ সালে নিহত হয়েছিল ৫১ জন। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৬, ২০২১ সালে ২৮, ২০২০ সালে ৩৫ এবং ২০১৯ সালে ৬৫। গণপিটুনিতে হত্যার বড় নজির রেনু হত্যাকাণ্ড। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় ছেলেধরা সন্দেহে তসলিমা বেগম রেনু নামের এক নারীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। তখন শহরে ছেলেধরা গুজব চলছিল। গণপিটুনিতে নির্বিচারে মানুষ হত্যা আইন-আদালত ও বিচারব্যবস্থার প্রতি একধরনের গণ-অনাস্থা। সম্পদশালী ও ক্ষমতাবান একশ্রেণীর মানুষের অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার ঘটনায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি জেঁকে বসেছে। আইন-আদালতের প্রতি সাধারণ নাগরিকদের আস্থায় সংকট বাড়ছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আইনের চোখে সবাই সমান নীতি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। জাতিকে নৃশংসতার হাত থেকে বাঁচতে হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা ও অপরাধীর বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন।

আমাদের সমাজের চেহারাটা দিন দিন কেন জানি কুৎসিত হয়ে যাচ্ছে। আজকের মতো এত ডিজিটাল ছিল না। কিন্তু মায়া, মমতা, স্নেহ ভালোবাসায় ভরপুর ছিল। মারামারি ও খুনাখুনি এতটা ছিল না। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেশুমার। অথচ মনের ভেতর ভয় তাড়িয়ে বেড়ায়, কখন জানি ছিনতাই ও ডাকাতের কবলে পড়ি। দেশে কোন রাজনৈতিক সংঘাত সহিংসতা নেই। তারপরও প্রতিনিয়ত দেশের কোথাও না কোথাও হত্যা, খুন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। এক কথায় এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। বাড়ছে অপরাধপ্রবণতার হার। ফলে এ অস্থিরতা বিভিন্ন অপরাধকে উসকে দিচ্ছে। তুচ্ছ কারণে খুন এখন সংবাদের শিরোনাম। প্রতিনিয়ত পত্রিকায় পাতায় এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার সংবাদ মুদ্রিত হচ্ছে। আমাদের জাতীয় জীবনে ভয়াবহ বিকৃতির ঘটনা পান্তাভাতে পরিণত হয়েছে। কিছু মানুষ অমানবিক ও নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে। তাদের হৃদয়ে ভালোবাসার পরির্বতে নিষ্ঠুরতা বাসা বেঁধেছে। যার কিছু প্রতিচ্ছবি মাঝে মধ্যে ভেসে উঠছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যাপারে সরকার দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

লেখক: প্রাবন্ধিক