জাফর আহমাদ

একটি গুল্প দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির অবতারণা করি। “কোন এক স্কুলের শিক্ষক তার এক ছাত্রকে এক ডালা ফুল দিয়ে বললেন, তুমি বাহিরে গিয়ে যাদেরকে হাসিমুখে পাবে তাদের প্রত্যেককে একটি করে ফুল দেবে। ছেলেটি বেরিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর সে ফিরে এলো কিন্তু একটি ফুলও সে বিতরণ করতে পারেনি। সে জানালো, হাসিমুখের একজন লোকও সে পায়নি। শিক্ষক দ্বিতীয় একটি ছেলেকে পাঠালেন। কিছুক্ষণ পর সে ফিরে এলো এবং ডালাতে একটি ফুলও নেই। শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এতগুলো হাসিমুখ কিভাবে পেলে? সে বললো, আমি বাইরে গিয়ে যাকেই পেয়েছি, তাকে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করেছি, ফলে তিনিও হেসেছেন। আমি তাকে একটি ফুল উপহার দিয়েছি। এভাবে সবগুলো ফুল বিতরণ করেছি।” আপনি হাসবেন, আপনার মস্তিস্ক, স্নায়ু ও চিন্তাশক্তি সমৃদ্ধ হবে। পৃথিবীটা আপনার সামনে সুন্দরভাবে আবর্তিত হবে। আপনার মন-মস্তিস্ক, স্বভাব-চরিত্র ও আচার-আচরণ সুন্দর হবে। পৃথিবীর সকলকেই আপনি ভালো জানবেন, ভালবাসবেন। মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, হাসলে হৃদযন্ত্র ও শ্বাসযন্ত্রের ব্যায়াম হয়। ফলে শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ভালো থাকে। কেউ কেউ বলেছেন, হাসির একটা চেহারা আছে। হাসি-খুশি মানুষের কাছে থাকলে, অন্যদের হাসতে দেখে সে হাসি অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে প্রত্যেকের মনের অবস্থা ভালো হয়। মানসিক অবস্থা তাজা হয়।

হাসিমুখ আল্লাহর এক বিশেষ দান। হাসিমুখে কথা বলা রাসুলসহ (সা:) সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের সুন্নাহ। হাসির দ্বারা পৃথিবীকে জয় করা যায়। হাসি-খুশি লোকের মস্তিস্ক সাধারণত ঠাণ্ডা থাকে। তারা সদায় ইতিবাচক চিন্তা লালন করেন। আল্লাহর নবী (সা:) তাঁর মিশন পরিপূর্ণতা লাভ করার পেছনে দাওয়াত ও তাবলীগের অবদান যতটুকু তার চেয়েও বেশী তাঁর চারত্রিক মাধুর্যতার অবদান। মুচকি হাসি তাঁর চরিত্র মাধুর্যকে অনন্য উচ্চতায় সমাসীন করেছিল। হাসিমাখা লোককে আল্লাহ ভালবাসেন। পৃথিবীর মানুষেরা ভালবাসে। সার্বিকভাবে তিনি মানুষের ভালবাসার পাত্রে পরিণত হন। বাংলা পাঁচের মতো মুখকে মানুষ ভালবাসে না। মানুষ সাধারণত তাকে এড়িয়ে চলে। কেউ তার দ্বারে কাছে ভীড়তে চায় না। বাংরা পাঁচ বা রাশভারী লোক কখনো বন্ধু বৎসল হয় না, সদালাপী হয় না। সে সহজভাবে কাউকে গ্রহণ করতে পারে না। মানুষ প্রাণখুলে কথা বলার জন্য এ ধরণের মানুষ পছন্দ করে না।

সার্বক্ষণিক হাসিমুখ বা হাসিখুশি ভঙ্গি মানুষের অসাধারণ একটি গুণ এবং সম্মানিত ব্যক্তিত্বের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। রাসুলুল্লাহ (সা:) এ গুণের অধিকারী ছিলেন। বিশেষ করে তিনি মুচকি হাসতেন। আরবীতে এটিকে ‘তাবাসসুম’ বলা হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে হারিস (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা:) এর চেয়ে অধিক মুচকি হাস্যকারী ব্যক্তি কাউকে দেখিনি।”(শামায়েলে তিরমিযি:১৬৮, বাবু মা জায়া ফি দাহকি রাসুলিল্লাহ (সা:), হাদীসটি সহীহ, আহমাদ:১৭৭৫০, শারহুস সুন্নাহ:৩৩৫০) উল্লেখিত রাবী একই ধরনের আরেকটি হাদীসে বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ (সা:) সবসময় মুচকি হাসতেন। (শামায়েলে তিরমিযি:১৬৯) জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ইসলাম গ্রহণ করার পর রাসুলুল্লাহ (সা:) তাঁ গৃহে প্রবেশ করতে কোনদিন আমাকে বাধা প্রদান করেননি এবং যখনই আমাকে দেখেছেন, মুচকি হাসি দিয়েছেন।” (বুখারী : ৩৮২২, কিতাবু ফাযায়িলি সাহাবী, বাবু যিকরু জারীর.. .., ইফা : ৩৫৪৬) সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরামের মুখে মুছকি হাসি থাকতো।

হাসি চারিত্রিক সৌন্দর্যকে বিকশিত করে। শারীরিকভাবে একটি লোক যতই কুৎসিত বা কদাকার হোক, হাসি তার কুৎসিতকে চাপিয়ে দেয়। কোন প্রকার প্রসাধনী ছাড়াই হাসি মানুষের আভ্যন্তরীন সৌন্দর্যকে প্রকাশ করে। মানুষ তার হাসি মাখা মুখখানি দেখে বুঝতে পারে যে, লোকটি সৌহার্দপূর্ণ, বন্ধু বৎসল, আন্তরিক, দরদী, মার্জিত ও পরিশীলিত মোট কথা একজন ভালো মানুষ। ফলে যেকোন ব্যক্তি দ্বিধাহীন চিত্তে ও নি:সঙ্কুচে তার কাছে মনের কথা বলতে পারে। হাসির ভুবনজয়ী ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বৈশিষ্ট্য। হাসির দ্বারা যে কোন কঠিণ সমস্যার সমাধান করা যায়। আপরি যদি ব্যবসায়ী হোন, আপনার হাসি আপনার ব্যবসায় উন্নয়নের বিশেষ পূঁজি। আপনি যদি কোন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের মালিক হোন, আপনার সে প্রতিষ্ঠানের মৌলিক উন্নতির জন্য এক ঝাঁক হাসিমাখা কর্মীর প্রয়োজন। এমনিভাবে ব্যাংক, বীমা, হাসপাতালসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য হাসিমাখা এক দল কর্মীবাহিনীর উপস্থিতি প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য উপাদানের মতো একান্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আর ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গকে অত্যাবশ্যক এ গুণের অধিকারী হতে হবে। রাশভারী লোকদের মাধ্যমে অন্য কোনকিছু হলেও ইসলামী মিশন হতে পারে না।

ইসলামে হাসির গুরুত্ব অত্যধিক। পূর্বেই বলা হয়েছে ইসলামের নবী (সা:) তাঁর মিশনের সফলতার পেছনে তাঁর চারিত্রিক সৌন্দর্যের অবদান সমানে সমান। অনেক ইসলামী স্কলারগণ তাঁর চারিত্রিক সৌন্দর্যকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। হাসি ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইসলাম শুধুমাত্র কতগুলো গুরুগম্ভীর আইনগত হুকুম আরোপ করে না বরং এটি মানুষের আভ্যন্তরীণ হাজারো জিজ্ঞাসার জবাব। ছোটবড় অনেকগুলো ভালোকাজের মতাদর্শ ইসলাম। আবু যার (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সা:) আমাকে বলেছেন: ভালো কোন কিছু দান করাকে হীন মনে করো না, এমনকি হোক সেটা ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ দেয়া।” (মুসলিম : ৬৫৮৪, কিতাবুল বিররি ওয়া.. ..বাবু ইসতিহবাবে তালাকাতেল....., ইফা : ৬৪৫১, ই,সে : ৬৫০২) অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, প্রতিটি ভালো কাজ সদকা স্বরূপ। তোমার ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করা নেক আমলের অন্তর্ভূক্ত।” (তিরমিযি : ১৯৭০) অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, “তোমার ভাইয়ের (সাক্ষাতে) মুচকি হাসাও একটি সদকা।” (তিরমিযি : ১৯৫৬)

আমাদের অনেকেই কর্মক্ষেত্রে বা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সদালাপী ও সদাহাস্যজ¦ল কিন্তু নিজের পরিবারের সদস্যদের সাথে সম্পুর্ণ উল্টো। কারো সাথে হাসোজ্জল আবার কারো সাথে রাশভারি এ ধরণের চারিত্রিক দ্বিমুখীতা অনুচিত। পরিবারের লোকজন সদাচারের বেশী হকদার। সুতরাং পরিবারের সাথে হাসিমুখে থাকুন। তারা আমাদের কাছে হাসিমুখ বেশী প্রত্যাশা করেন। পরিবারের পর হাসিমুখ বা সদাচার পাওয়ার দ্বিতীয় হকদার হচ্ছে আমাদের যারা প্রতিবেশী। সহাবস্থান, সহনশীলতা অধিকারের পাশাপাশি সদাচার, কল্যাণ কামনা ও হাসিমুখে কথা বলাও তাদের হক। একটি হাদীসের ভাবার্থ এই যে, এক ব্যক্তি রাসুল (সা:) এর কাছে এসে বললো, হে আল্লাহর রাসুল (সা:)! আমাদের মধ্যে একজন মহিলা ফরয সালাত, ফরয সাওম ও ফরয যাকাতের পাশাপশি প্রচুর পরিমাণ নফল সালাত, নফল সাওম, নফল যাকাত আদায় করেন। কিন্তু তিনি প্রতিবেশীদের সাথে দুর্ব্যবহার করেন। তার মুখের কারণে মানুষ তটস্থ থাকেন। রাসুল (সা:) বললেন, সে জাহান্নামী। পক্ষান্তরে অন্য এক মহিলা ফরযের বাইরে তার কোন নফল আমল নাই কিন্তু তিনি মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করেন। ফলে মানুষ তাকে ভালোবাসে। রাসুলুল্লাহ (সা:) বললেন, সে জান্নাতী।” অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি নিজের কোনো মুসলিম ভাইকে খুশি করার জন্য এমন ভাবে সাক্ষাৎ করে, যেমনটি সে পছন্দ করে; কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তাকে খুশি করবেন। (আল মুজমাউস সগির, তাবরানী : ১১৭৮)

মানুষ সামাজিক জীব। কোন মানুষ একাকী কখনো জীবন যাপন করতে পারে না। জীবনের তাগিদেই তাকে দলবদ্ধভাবে বসবাস করতে হয়। তাই তাকে যোগাযোগ করতে হয়। এ যোগাযোগকে সুন্দর ও সাবলীল করার জন্য হাসিমুখ অত্যন্ত প্রয়োজন। তাই রাসুলুল্লাহ (সা:) আমাদেরকে যোগাযোগের প্রক্রিয়া শিক্ষা দিয়েছেন। উপড়ে উল্লেখিত হাদীসগুলোতে সে প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি যে কোন সাক্ষাতে হাস্যেজ্জল থাকতেন। তাই কারো সাথে সাক্ষাতে হাসিমুখ থাকা রাসুলুল্লাহ (সা:) এর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ। মানুষের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাত করলে সাদাকাহ এর সাওয়াব পাওয়া যায়। এ ধরণের সাক্ষাতে ভাষা সাধারণত নম্র হয়, যা কুরআনের নির্দেশ। যেমন: আল্লাহদ্রোহী ফেরাউনের কাছে যখন মুসা আ: ও হারুন আ: কে প্রেরণ করা হয়, তখন বলে দেয়া হয়, “তোমরা তার সাথে নম্র ভাষায় কথা বলবে। (এতে) হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভীত হবে।” (সুরা ত্বহা : ৪৪) হাসিমুখ নম্রতার পরিচায়ক। তাই হাসিমুখ নামক গুণটি নিজের মধ্যে ধারণ করুন। আপনার চারপাশটা আলোকিত হবে।

লেখক : ব্যাংকার।