॥ ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন ॥

ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত রোগ। ১৭৭৯ সালে ডেঙ্গুর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। বিংশ শতকের প্রথমভাগে ডেঙ্গুর ভাইরাস উৎস ও সংক্রমণ বিশদভাবে প্রকাশ পায়। বর্তমানে সবচাইতে বেশি যে রোগটি আমাদের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হলো ডেঙ্গু। যার বাহক এডিস ইজিপ্টাই এবং এডিস এলবোপিকটাস। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা বিশটি অবহেলিত গ্রীষ্মম-লীয় রোগের একটি হিসেবে ডেঙ্গু চিহ্নিত করেছে। ডেঙ্গু জ্বর একটি এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত গ্রীষ্মম-লীয় রোগ। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সাধারণত ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। উপসর্গগুলির মাঝে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশিতে ও গাঁটে ব্যথা এবং গাত্রচর্মে ফুসকুড়ি। দুই থেকে সাত দিনের মাঝে সাধারণত ডেঙ্গু রোগী আরোগ্য লাভ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক রক্তক্ষরী রূপ নিতে পারে, যাকে ডেঙ্গু রক্তক্ষরী জ্বর (ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার) বলা হয়। এর ফলে রক্তপাত হয়, রক্ত অনুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং রক্ত প্লাজমার নিঃসরণ ঘটে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কখনোবা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দেখা দেয়। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়।

ডেঙ্গুকে বলা হতো শহুরে রোগ। দু’যুগের বেশি সময় ধরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও রোগী ব্যবস্থাপনার বড় পরিকল্পনা ছিল রাজধানী ঘিরে। তবু রোগটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি। ঠেকানো যায়নি রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ। ডেঙ্গু এখন শহরের সীমানা পেরিয়ে পৌঁছে গেছে গ্রামে-গঞ্জে। প্রতি বছরের মতো এ বছরও মশাবাহিত রোগটি হানা দিয়েছে। জুনের পর থেকে বাড়তে শুরু করেছে শনাক্তের হার। ঢাকার চেয়ে বাইরের জেলাগুলোতেই এ বছর সংক্রমণ বেশি। এরই মধ্যে অন্তত ১০ জেলায় ডেঙ্গুর উচ্চ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। বিশেষ করে বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গুর প্রকোপ এবার আশঙ্কাজনক রূপ নিয়েছে। রাজধানীর দু’সিটি করপোরেশনের চেয়ে এক বরগুনাতেই রোগীর সংখ্যা বেশি। এ বছর শনাক্ত রোগীর অন্তত প্রায় ৮০ শতাংশই ঢাকার বাইরের। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত বেশি বরিশালে, মৃত্যু ঢাকায়। আক্রান্তদের মাঝে বেশিরভাগ-ই পুরুষ। বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সীরা। এ পর্য্যন্ত যারা ডেঙ্গুতে মারা গেছেন, তাদের অর্ধেকই ঢাকার মহানগরের দক্ষিণাঞ্চলের।

কয়েক প্রজাতির এডিস মশকী (স্ত্রী মশা) ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক। যেগুলোর মধ্যে এডিস ইজিপ্টি মশকী প্রধানতম। ভাইরাসটির পাঁচটি সেরোটাইপ পাওয়া যায়। ভাইরাসটির একটি সেরোটাইপ সংক্রমণ করলে সে সেরোটাইপের বিরুদ্ধে রোগী আজীবন প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে। কিন্তু ভিন্ন সেরোটাইপের বিরুদ্ধে সাময়িক প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে। পরবর্তীতে ভিন্ন সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমিত হলে রোগীর মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। কয়েক ধরনের টেস্টের মাধ্যমে, যেমন, ভাইরাসটি বা এর আরএনএ প্রতিরোধী এন্টিবডির উপস্থিতি দেখেও ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয় করা যায়।

ডেঙ্গু জ্বর হলে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে এবং বেশি করে তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে। জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল দেওয়া হয়। প্রায়শ রোগীর শিরায় স্যালাইন দিতে হতে পারে। মারাত্মক রূপ ধারণ করলে রোগীকে রক্ত দিতে হতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে কোন ধরনের এন্টিবায়োটিক ও ননস্টেরয়েডাল প্রদাহপ্রশমী ওষুধ সেবন করা যাবে না, করলে রক্তপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি প্রায় ৮৭টি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলেও রাজধানীর বাইরে ডেঙ্গু মোকাবিলায় জরিপ, পর্যাপ্ত প্রস্তুতি, সক্ষমতা কিংবা জনবল নেই। জেলা ও উপজেলা সরকারি হাসপাতালের সামান্য শয্যা আর স্বল্প বাজেটের সীমিত জনবলেই চলছে ডেঙ্গুর মোকাবিলা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যখাতে বড় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, যদি গ্রামীণ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চঝুঁকির জেলাগুলোকে ঘিরে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা নেওয়া না হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। ঢাকার বাইরে বড় জনগোষ্ঠীকে আরও অন্তত তিন দশক ধরে ভোগান্তি পোহাতে হতে পারে।

সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয় ২০০০ সাল থেকে। গত ২৫ বছরে আমরা ঢাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। আরও যে কত বছর লাগবে সেটাও জানা নেই। ঢাকার বাইরে পাঁচগুণ মানুষের বসবাস। অথচ ঢাকার বাইরে মশা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। অন্তত উচ্চ সংক্রমণের ১০ জেলা ঘিরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের মহাপরিকল্পনা এখনই গ্রহণ না করলে ধারণা করা হয়, ঢাকার বাইরের ডেঙ্গু আগামী ৩০-৪০ বছর আমাদের ভোগান্তিতে ফেলবে। এটা খুব সহজে অনুমান করা যায়।’

ঢাকার বাইরে চার এলাকা ডেঙ্গুর উচ্চঝুঁকিতে। ঢাকার বাইরে চার পৌর এলাকায় এডিস মশার উপস্থিতি বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এ চার পৌরসভা হলো ঝিনাইদহ, মাগুরা, পিরোজপুর ও পটুয়াখালী। এসব এলাকাকে ডেঙ্গুর উচ্চঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) সংশ্লিষ্টরা। জরিপ করতে প্রতিটি এলাকায় ৯ ওয়ার্ডে ২১৪টি বাড়ি পরিদর্শন করা হয়। এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের স্বীকৃত পদ্ধতি হলো ‘ব্রুটো ইনডেক্স (বিআই)’। এ মানদ-ে লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি হওয়া মানে সেখানে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয়। এ ছাড়া হাউস ইনডেক্স ১০-এর বেশি হলে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়। জরিপে দেখা গেছে, ঝিনাইদহ পৌর এলাকায় ব্রুটো ইনডেক্স ৬০ শতাংশ। এরপর মাগুরায় ৫৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ, পিরোজপুরে ২০ শতাংশ ও পটুয়াখালীতে ১৯ দশমিক ২৬ শতাংশ, কুষ্টিয়ায় ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ। তিন সিটি করপোরেশন এলাকার মধ্যে চট্টগ্রামে ৫ দশমিক ৬২ শতাংশ, রাজশাহীতে ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ ও বরিশালে ২ দশমিক ৫ শতাংশ।

তবে ভয় জাগাচ্ছে গ্রামের ডেঙ্গু। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে চলতি বছর ডেঙ্গু শনাক্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১৬ হাজার ৩৯৫ জনের মধ্যে রাজধানীর ৮৭ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে ৩ হাজার ৫৩৯ জন। অন্যদিকে ঢাকার বাইরে ১২ হাজার ৮৫৬ জন রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। এর মধ্যে এক বরগুনাতেই রোগীর সংখ্যা ৩ হাজার ৯৫৭ জন, আর বরিশাল বিভাগে ৬ হাজার ৬৪৪ জন, যা দেশের সব বিভাগের চেয়ে বেশি।

বরগুনায় এত ডেঙ্গু রোগী কেন ? এ বছর ডেঙ্গু সংক্রমণের হার বরিশাল বিভাগের বরগুনা জেলায় সর্বোচ্চ। শুক্রবার অবধি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর বরগুনা সদর হাসপাতা‌লের তত্ত্বাবধায়ক বিবিসিকে জানিয়েছেন। তারা “সক্ষমতার বাইরে গিয়ে রোগীর চাপ সামলাতে প্রাণপণ চেষ্টা” করছেন। তিনি বলেন, হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বরাদ্দ বেডের সংখ্যা কেবল ৫০টি হলেও এই মুহূর্তে সেখানে মোট পাঁচ শতাশিক ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। “এমার্জেন্সিতে অনেকেই আসছেন, ডেঙ্গু পজেটিভ পাচ্ছি। যে বাসায় একজন সদস্য ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, ওই বাসায় প্রায় প্রত্যেক সদস্যরই ডেঙ্গু,” বলেন তিনি। হাসপাতালে যারা আসছেন, তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ‘বাড়ি পাঠানো হচ্ছে’ জানিয়ে তিনি বলেন, “সক্ষমতা তো থাকতে হবে। হাসপাতালের কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নাই।” তাই, যারা তুলনামূলক একটু সুস্থ, তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে না। “এরকম একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডেঙ্গুর এত প্রকোপ কল্পনাও করা যায় না,” বলেন এই চিকিৎসক। তবে, জেলায় এত বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার কারণ হিসেবে বরগুনায় ব্যাপক জলাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেন তিনি। “এ জেলার চারপাশে নদী। কিন্তু ফ্লোয়িং ওয়াটারে তো লার্ভা থাকে না। কিন্তু এখানে জলাবদ্ধতাও প্রচুর। বাড়ির আঙ্গিনা থেকে শুরু করে সব জায়গায় ময়লা আবর্জনা, পানি জমা থাকে,” বলেন তিনি।তিনি বলছেন, “সময়মতো সঠিকভাবে মশার ওষুধ ছিটানো হলে এবং পৌর শহরটা যদি আরও পরিচ্ছন্ন থাকতো, তাহলে পরিস্থিতি এই পর্যায়ে যেত না।” আর যেসব মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে, তার কার্যকারিতা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি। তিনি জানান, বরগুনার সবাই এখন ডেঙ্গু নিয়ে ব্যস্ত। এদিকে, বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডেঙ্গুর বিষয়ে বিবিসিকে জানান, “গতবার থেকেই ওখানে ডেঙ্গু রোগী বেশি, এবার আরও বেশি।” কারণ হিসাবে তিনি জানান, ওই এলাকায় থেকে নমুনা নিয়ে দেখা গেছে যে সেখানে এডিস মশা আছে। তার মতে, বাংলাদেশকে যেহেতু প্রতিবছরই ডেঙ্গু সংক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়, তাই এক্ষেত্রেও এ দেশের চিকিৎসকরা অভ্যস্ত।

ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধী টিকা কয়েকটি দেশে অনুমোদিত হয়েছে। তবে এ’টিকা শুধু একবার সংক্রমিত হয়েছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে কার্যকর। মূলত এডিস মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। তাই মশার আবাসস্থল ধ্বংস করে মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করতে হবে। এ জন্য এডিস মশার বংশবিস্তারের উপযোগী বিভিন্ন আধারে, যেমন কাপ, টব, টায়ার, ডাবের খোলস, গর্ত, ছাদ ইত্যাদিতে আটকে থাকা পানি অপসারণ করতে হবে। শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরিধান করতে হবে। শত্রুটি হলো মশা নামক একটি পোকা। একে দমন করতে হলে ঢিলেঢালা পদ্ধতিতে কোনো কাজ হবে না। গ্রহণ করতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ। সব পরিসংখ্যানিক উপাত্ত সামনে রেখে সে অনুযায়ী বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগই আনবে কাক্সিক্ষত সফলতা।

লেখক : প্রাবন্ধিক।