খালিদ হাসান বিন শহীদ

হজ্ব আরবি শব্দ। অর্থ: নিয়ত করা, দর্শন করা, সংকল্প করা, সন্ধান করা, সাক্ষাৎ করা, ইচ্ছা করা বা প্রতিজ্ঞা করাসহ কোনো মহৎ কাজের ইচ্ছা করা। শরিয়তের পরিভাষায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ফরজ আমলটি পালনার্থে এবং আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্য ও সন্তোষ লাভের আশায় হজে¦র নির্ধারিত সময়-সীমার ভেতরে নির্দিষ্ট আমল সম্পাদনের জন্য পবিত্র ‘বাইতুল্লাহ’ তথা কাবা ঘর জেয়ারত করাকে হজ¦ বলে। নামাজ, রোজা, যাকাত যেমন ফরয ইবাদত, তেমনি আর্থিক ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান মুসলমান নর-নারীর জন্য হজ¦ অন্যতম অবধারিত কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘মক্কা শরীফ পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম প্রত্যেক ব্যক্তির উপর আল্লাহর জন্য হজ¦ আদায় করা ফরজ।’ (সুরা আল ইমরান, আয়াত: ৯৭) ‘তোমরা আল্লাহর জন্য হজ¦ ও উমরাহ পালন কর।’ (সুরা-আল বাকারা, আয়াত: ১৯৬) মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘যখন আমি ইবরাহিম (আ.)-কে বায়তুল্লাহর স্থান ঠিক করে দিয়ে বলেছিলাম যে, আমার সাথে কাউকে শরিক করো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রাখ তাওয়াফকারীদের জন্য। আর মানুষের মাঝে তুমি হজে¦র ঘোষণা প্রচার করো, তাঁরা তোমার কাছে আসবে পাঁয়ে হেঁটে, উটে চড়ে এবং সর্ব-প্রকার বাহনে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে।’ (সুরা হজ, আয়াত: ২৬-২৭) এখানে আমারা হজে¦র সামাজিক ও ধর্মীয় প্রভাব এবং শিক্ষা ও তাৎপর্যসহ আনুষঙ্গিক কিছু বিষয়ে আলোচনা করছিÑ

আল্লাহর নির্দেশ পালন : মানুষ ও জিনকে আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। ইবাদতের মূলকথা হলো আল্লাহর নির্দেশ পালন করা। সেটা হতে পারে করণীয় কিংবা বর্জনীয়। হজে¦র ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালার নির্দেশ হলো, ‘তোমরা আল্লাহর জন্য হজ¦ ও ওমরা পূর্ণ করো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯৬) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জীবনে একবার হজ¦ পালন করা ফরজ।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ১৭২১)

আল্লাহর সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টি অর্জন : আল্লাহ তাআলা সব সময় বান্দার কাছেই থাকেন। এরপরও কাবা যেহেতু তাঁর ঘর, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জায়গা এবং সেখানকার ভূমি বরকতময়, নিরাপদ, সঙ্গে রয়েছে নবি-রাসুলদের স্মৃতিবিজড়িত অনেক স্থান ও স্থাপনা, তাই সেখানে কেউ প্রবেশ করলে সে বিশেষভাবে আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্য, সন্তুষ্টি ও নিরাপত্তা লাভ করে। এরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের ইবাদতের জন্য নির্মিত সর্বপ্রথম ঘর যা মক্কায় অবস্থিত, সেটি বিশ্ববাসীর জন্য পথপ্রদর্শক। সেখানে রয়েছে মাকামে ইবরাহিমের মতো অনেক প্রকৃষ্ট নিদর্শন। যে সেখানে প্রবেশ করবে, সে নিরাপত্তা লাভ করবে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৬-৯৭) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হজ¦ ও ওমরা পালনকারীরা আল্লাহর মেহমান (বিশেষ মর্যাদা ও সান্নিধ্যপ্রাপ্ত)। তাই তারা আল্লাহর কাছে কিছু আবেদন করলে তিনি তা কবুল করেন। ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করেন।’ (ইবনে মাজা, হাদিস: ২৮৯৮)

পাপমোচন ও পুণ্য অর্জন : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হজ¦ তার আগের সব পাপ ধ্বংস করে দেয়।’ (মুসলিম, হাদিস: ১২১) আরেক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে হজ¦ করে এবং সে হজে¦র মধ্যে অশ্লীল কথাবার্তা বলে না ও অশ্লীল কাজও করে না, সে ব্যক্তি হজ¦ থেকে সেদিনের মতো ফিরবে (নিষ্পাপ অবস্থায়), যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল।’ (বুখারি, হাদিস: ১৫২১)

জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত প্রাপ্তি : হজে¦র বিধান অস্বীকার করলে ঈমান থাকবে না। আর সামর্থ্যবানরাও হজ¦ না করলে জাহান্নামে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘কেউ যদি হজে¦র বিধান অস্বীকার করে, তার জানা উচিত, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিজগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭) হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি বান্দার শরীর সুস্থ রাখলাম, তার জীবিকায় প্রশস্ততা দিলাম, এরপর পাঁচ বছর গেল, এর মধ্যে সে আমার ঘরে হজে¦র উদ্দেশ্যে এলো না, তা হলে সে বড়ই হতভাগা!’ (তাবারানি, হাদিস: ৪৯০)

সামাজিক তাৎপর্য : একটি ইসলামি আদর্শের সমাজ গঠনের জন্য যে গুণগুলো এর সদস্যদের থাকা দরকার, সবগুলোর চর্চাই হজে¦র মধ্যে হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলোÑ

ধৈর্য ও ত্যাগ : শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক তিনটি বিষয়ের যৌথ প্রয়াসে পালিত হয় হজ¦। এক্ষেত্রে ধৈর্য ও ত্যাগের মানসিকতা না থাকলে শীত-গরমের তীব্রতা উপেক্ষা করে, মানুষের ভিড় ঠেলে একটি ইবাদত সম্পন্ন করা কখনো সম্ভব হতো না। তওয়াফ, সাঈ, কঙ্কর নিক্ষেপসহ সব কাজই মোটামুটি কষ্টের। সুতরাং হজ¦ থেকে মানুষ ধৈর্য ও ত্যাগের মতো মহৎ গুণাবলি শিক্ষা লাভ করে।

সাম্য ও সম্প্রীতি : হজ¦ রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু, আরব-অনারব, নারী-পুরুষ সবার মধ্যে একটি সাম্যভাব প্রতিষ্ঠা করে। সঙ্গে সঙ্গে হজ¦ আদায়কারীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভালোবাসাবোধ জাগ্রত করে। সবার কাজ এক, পোশাক এক, ধ্বনি এক, লক্ষ্য এক। একই দেহ আর একই প্রাণের উৎসব যেন কাবার প্রান্তরে চলে। ইসলাম মুসলমানদের এ রূপটিই সব সময় কামনা করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় সব মুমিন ভাই ভাই।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১০)

একতা ও ঐক্য : একতা শক্তির মূল। বিচ্ছিন্নতা দুর্বলতার কারণ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো, বিভক্ত হয়ো না।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩) হজ যেন সেই একতার দৃশ্যই ফুটিয়ে তোলে।

বৈষম্যহীনতা ও সম্মান প্রদান : মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদা সম্পন্ন যে অধিক মুত্তাকি।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১৩) আদমের সন্তান হিসেবে মানুষ সবাই সমান। কারও ওপর কারও প্রাধান্য নেই। হজ¦ মানুষের মাঝে বর্ণ ও শ্রেণি বৈষম্য দূর করে প্রত্যেককে সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষা দেয়। যে গুণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জেনে রেখ, অনারবের ওপর আরব ও আরবের ওপর অনারব লোকের কোনো প্রাধান্য নেই। কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গ আর শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গ লোকের কোনো প্রাধান্য নেই। প্রাধান্য শুধু তাকওয়ার ভিত্তিতে হয়।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২৩৪৮৯) অন্য এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও ধন-সম্পদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না; বরং তিনি দৃষ্টি দিয়ে থাকেন তোমাদের অন্তর ও আমলের প্রতি। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৬৪)

লেখক : ধর্মীয় আলোচক ও খতিব