॥ অ্যাডভোকেট তোফাজ্জল বিন আমীন ॥

দেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রতিনিয়ত উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ও হতাশায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ভয়াবহ আকারে বাড়ছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক হিসেবে দেখা গেছে, দেশে প্রায় ৩ কোটি মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। এর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই চিকিৎসা সেবার বাইরে। অথচ চিকিৎসা সেবা পাওয়া প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। মানসিক রোগে যারা আক্রান্ত তারাও মানুষ। অন্যান্য রোগের চিকিৎসা হতে পারলে মানসিক রোগের চিকিৎসায় বাধা কোথায়? এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। যারা মানসিক রোগী তাদেরও কিছু দায়দায়িত্ব রয়েছে। তারা সে দায়িত্বটুকু পালন করছে না। ফলে এ রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। বিশেষ করে অসচেতনতা, কুসংস্কার, লোকলজ্জা ও সামাজিক ভয়ের কারণে অনেক মানসিক রোগী এ ধরনের সমস্যার কথা সাধারণত কাউকে জানাতে চান না। এমনকি চিকিৎসকের কাছেও বলতে সংকোচবোধ করেন। ফলে রোগ আরও জটিল হয়ে ওঠে। মানসিক রোগের চিকিৎসা শুধু ওষুধের ওপর নির্ভরশীল নয়; বরং রোগীর প্রতি পরিবারের আচরণই তার সুস্থতার বড় নেয়ামক ভূমিকা রাখে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা অনেক সময় রোগীর প্রতি সহমর্মিতা দেখাই না; বরং তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা অবমাননামূলক আচরণ করি। অথচ আমরা নিজেদেরকে ভালো মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করতে ভুল করি না। সবাই ভালো মানুষ সাজি। সহমর্মিতা, ধৈর্য এবং সম্মানজক ব্যবহারই পারে একজন মানসিক রোগীকে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাতে। কিন্তু আমরা সেটা ভুলে যায়। একজন মানসিক রোগীর কথা, মনোভাব বা আচরণ স্বাভাবিক হবে না এটাই স্বাভাবিক। তাই তাদের সঙ্গে কখনো খারাপ আচরণ করা যাবে না। সহজ ও নরম ভাষায় কথা বলা প্রয়োজন। যেন তারা মনে কষ্ট না পায়। তারা কোন প্রশ্ন করলে দ্রুত উত্তর না দিয়ে ধীরে ধীরে বুঝিয়ে উত্তর দেয়া প্রয়োজন। যেন তারা উত্তেজিত না হয়। তাদের সঙ্গে কোন তর্ক, চাপ প্রয়োগ বা জোরাজুরি করা যাবে না। তারা যদি পরিবারের কাছ থেকে সত্যিকার অর্থে মানসিক সাপোর্ট পায় তাহলে তারা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।

বাংলাদেশে মানসিক রোগীর সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত করে জানা না গেলেও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট জানিয়েছে- দেশে প্রায় ৩ কোটি মানুষ বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা নিয়ে জীবনযাপন করেন। এর একটি বড় অংশ চিকিৎসার বাইরেই থেকে যায়। সারা বিশে^র ন্যায় বাংলাদেশেও প্রতিবছর ১০ অক্টোবর বিশ^ মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত হয়। এ দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে অ্যাকসেস টু সার্ভিসেস-মেনটাল হেলথ ইন ক্যাটাস্ট্রোফেস অ্যান্ড ইমার্জেন্সিস’ অর্থাৎ বিপর্যয় কিংবা জরুরি অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা যেন পাওয়া যায়। বিশ^ মানসিক স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এক বার্তায় বলেন- সংঘাতে আক্রান্ত প্রতি পাঁচজনের একজন মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় ভোগেন। অথচ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও সহায়তা পাওয়া যায় না। মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি অপরিহার্য। জরুরি প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসাবেই মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং এতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কেন বাড়ছে মানসিক রোগীর সংখ্যা এ প্রশ্ন যে কেউ উত্থাপন করতেই পারেন। তবে আমার কাছে মনে হয় মানসিক রোগীর সংখ্যা বাড়ার প্রধান কারণগুলো হচ্ছে- সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত মানসিক চাপ, বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, খরা, বেকারত্ব ও আয় অসামঞ্জস্য, ঋণ ও দারিদ্র্য, পারিবারিক দ্বন্ধ¦ ও বিচ্ছেদ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মাদক, ধূমপান ও অ্যাকোহল দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ব্যথা, পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে যাওয়া, উদ্বেগ দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ব্যথা, পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে যাওয়া উদ্বেগ, ডিপ্রেশন ও একাকিত্ব ইত্যাদি। যদি সচেতনতা, পারিবারিক সহায়তা এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধি না করা হয় তাহলে এ সংকট আরও বাড়বে। সুতরাং মানসিক চাপ কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

চিকিৎসা সেবা পাওয়া প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। এটা সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত। রোগ নির্ণয় করার পর একজন ভালো মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা প্রয়োজন। কিন্তু অনেক রোগীর পক্ষে এ রোগের চিকিৎসকের দেখা পাওয়া মেলা ভার। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে জনসংখ্যা অনুপাতে চিকিৎসকের সংখ্যা খুবই কম। আর মানসিক রোগীর চিকিৎসকের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। ২০২৫ সালের আনুমানিক তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে আনুমানিক ২০০-২৫০ জন সাইকিয়াট্রিস্ট আছে। জনসংখ্যার সঙ্গে তুলনা করলে প্রতি লাখ মানুষের জন্য মাত্র ১-২ জন সাইকিয়াট্রিস্ট। আর প্রশিক্ষিত সাইকোলজিস্ট আছেন প্রায় ৩০০-৩৫০ জন যা দেশের চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রপুতুল। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা ২০১৮-২০১৯ অনুসারে দেশের প্রায় ১৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং ১৩ শতাংশ কিশোর-কিশোরী বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত। প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য শূন্য দশমিক ১৩ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং শূন্য দশমিক শূন্য ১ জন অন্যান্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন।

প্রতি বছরের ১০ অক্টোবর পালিত হয় বিশ^ মানসিক স্বাস্থ্য দিবস World Mental Health Day প্রথমবার এটি শুরু হয় ১৯৯২ সালে, আন্তর্জাতিক মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থা World Federation for Mental Health (WFMH) এর উদ্যোগে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়। কিন্তু এর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের উদ্যোগ চোখে পড়ার মত নয়। অথচ এ দিবসটির উদ্দেশ্য ছিল মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা, মানসিক রোগীদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রসার করা। অন্যান্য দেশের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এখনও সীমিত। হাসপাতালের সংখ্যা খুবই কম। সরকারি ও বেসরকারি উভয় মানসিক হাসপাতাল আছে। তবে সংখ্যার দিক থেকে সরকারি হাসপাতাল প্রধান। মানসিক রোগীর সংখ্যা বিপুল হলেও হাসপাতালের সংখ্যা কম। হাতে গোনা কয়টি মাত্র। ঢাকা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ NIMH, রাজশাহী মানসিক হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মানসিক হাসপাতাল, বরিশাল মানসিক হাসপাতাল, খুলনা মানসিক হাসপাতাল ও পাবনা মানসিক হাসপাতাল।

এসব প্রতিষ্ঠানের সেবার ব্যাপারে সাধারণ মানুষ খুব কমই জানেন। কেবল পাবনা মানসিক হাসপাতাল কিছুটা পরিচিত। দেশের অন্যান্য স্থানে যে মানসিক হাসপাতাল আছে তা অনেকেই জানেন না। মানসিক সমস্যা দেখা দিলে এখনো অনেকে কবিরাজ বা ঝাড়ফুঁকের দিকে ছুটে যান। গ্রামে আমার পরিচিত এক নারী সম্প্রতি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। আমি তার পরিবারকে হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দিই। কিন্তু তার সন্তানরা রাজি হয়নি। তাদের বিশ্বাস- ‘‘মাকে জি¦নে ধরেছে, ডাক্তার কিছু করতে পারবে না’ কবিরাজই চিকিৎসা করবে। ফলে তারা হাসপাতালে না নিয়ে কবিরাজের কাছে নিয়ে যায়। গ্রামাঞ্চলে অনেকে রোগ নিরাময়ের জন্য কবিরাজ কিংবা হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে যায়। তারা এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যা রোগীর জন্য ক্ষতিকর। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর অধিকার লঙ্ঘিত হয়। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই জানে না যে, শরীরের মতো মনেরও রোগ হতে পারে।

এ অবস্থার পরির্বতনের জন্য স্বাস্থ্যসেবার সচেতনতা, প্রশিক্ষণ এবং সামাজিক সচেতনতার প্রয়োজন। মানসিক চিকিৎসা সেবার বিকেন্দ্রীকরণ করা দরকার। যেন সবাইকে ঢাকামুখী হতে না হয়। বিশেষ করে দেশের জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে মানসিক চিকিৎসা ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যেন বিনা চিকিৎসায় কারও জীবন বিপন্ন না হয়। মানসিক রোগীদের জন্য নি¤œলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরিÑ জেলা হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য ইউনিটে মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন, ডাক্তার, নার্স ও সাইকোলজিস্ট প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি, জনবল সংকট দূর করা এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় বাজেটের বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। মানসিক রোগীদেরও আমাদের মতোই মর্যাদা ও অধিকার আছে। তাই তাদের প্রতি সর্বদা মানবিক ও সহানুভূতিশীল আচরণ নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। একটি সহানুভূতিশীল, সচেতন ও সমর্থনমুখী সমাজই পারে মানসিক রোগীদের জীবনের আশা এবং সুস্থতার সম্ভাবনা প্রতিষ্ঠা করতে।

লেখক : প্রাবন্ধিক।