বিশ্বসভ্যতা ও মানবেতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ও অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হচ্ছে পবিত্র আশুরা। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় আশুরার শিক্ষা অপরিসীম। পবিত্র আশুরা জীবন উৎসর্গ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিক্ষা দেয়। পবিত্র আশুরা তথা হিজরী নববর্ষের প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখ। স্বৈরাচার, মিথ্যাবাদী ও জালেম শাসকের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক বিপ্লবের দিন। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনায় এসে দেখলেন, ইহুদিরা আশুরার দিনে সাওম পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কোন দিন যে তোমরা সাওম পালন করছ?’ তারা বলল, এটা এমন এক মহান দিবস যেদিন আল্লাহতায়ালা মুসা (আ.) ও তার সম্প্রদায়কে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরাউনকে তার দলবলসহ ডুবিয়ে মেরেছিলেন। মুসা (আ.) শুকরিয়া হিসেবে এ দিনে সাওম পালন করেছেন। এ কারণে তারাও সাওম পালন করে থাকে। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন ‘তোমাদের চেয়ে আমরা মুসার (আ.) অধিকতর ঘনিষ্ঠ ও নিকটবর্তী।’ অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) সাওম পালন করলেন ও অন্যদের সাওম পালনের নির্দেশ দিলেন (সহিহ বুখারি : ১৮৬৫)।
আশুরার মর্যাদার সঙ্গে অনেক আনন্দ ও বেদনার ইতিহাস অনেক আগ থেকেই জড়িত ছিল এবং আছে। তবে সবকিছুর পর এ দিনের আবেগঘন বেদনাবিধুর মর্যাদার সঙ্গে ফুরাত তীরের কারবালার শাহাদাতের ঘটনা জড়িত হওয়ায় এ দিনের মর্যাদা মুসলমানদের কাছে অনেক বেশি। ইমাম হোসেনের শাহাদাত ও আবেগঘন বক্তৃতা প্রত্যেক ইমানদারের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
৬১ হিজরীর এ দিনে অত্যাচারী শাসক ইয়াজিদের অন্যায়, অত্যাচার ও ইসলাম সম্পর্কে প্রচারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে স্ব-পরিবারে কারবালার ময়দানে শাহাদাত বরণ করেছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.)।
ঐতিহাসিক বর্ণনায় জানা গেছে, ইয়াজিদ অন্যায়ভাবে ক্ষমতায় আরোহণের পর তার শাসন ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে নিজের মনমতো হাদিস ও ফতোয়া তৈরি করেন। তিনি এক শ্রেণীর আলেম নামধারী ব্যক্তিদেরকেও নানা পদ পদবীর লোভ দেখিয়ে তার শাসন ক্ষমতার পক্ষে ব্যবহার করেন। নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে জাল হাদিস তৈরি করে প্রচার করতে থাকে। সত্যপ্রিয় মানুষের উপর অন্যায়ভাবে জুলুম নির্যাতন চালাতে থাকে। ইয়াজিদের অবৈধ শাসনের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে গ্রেফতার করা হতো, নির্যাতন চালানো হতো, অবশেষে হত্যা করা হতো। এসব অন্যায় জুলুমের প্রতিবাদে নবী মুহাম্মদ (সা.) -এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.) সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। তিনি জনগণকে ইয়াজীদের মিথ্যাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) তার পরিবারের সদস্যসহ সঙ্গী সাথীদের নিয়ে ইয়াজিদের অন্যায়ের প্রতিবাদে এগিয়ে আসেন। কুফার কারবালা নামক স্থানে আসলেই তাকে বাধা দেয়া হয়। তিনি এখানেই তাবু স্থাপন করেন। ইয়াজিদের নিযুক্ত কুফার গর্ভনর ইবনে জিয়াদ ৯ই মহররম ইমাম হুসাইন (আ.)’র ছোট্ট শিবিরের ওপর অবরোধ জোরদারের ও হামলার নির্দেশ দেয়। এর আগেই আরোপ করা হয়েছিল অমানবিক পানি-অবরোধ। পশু-পাখি ও অন্য সবার জন্য ফোরাত নদীর পানি ব্যবহার বৈধ হলেও এ অবরোধের কারণে কেবল নবী-পরিবারের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় এই নদীর পানি। ইয়াজিদ বাহিনীর সেনা সংখ্যাও ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং দশই মহররমের দিনে তা প্রায় বিশ বা ত্রিশ হাজারে উন্নীত হয়। আর পক্ষান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.) এর বাহিনীতে সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র একশ’। ইয়াজিদের ক্ষমতার পক্ষে সমর্থন দেয়ার জন্য গভর্নর ইবনে জিয়াদ বার বার ইমাম হোসাইন (রা.) এর নিকট প্রস্তাব দেন। কিন্তু ইমাম হোসাইন (রা.) অন্যায়ের সাথে আপস না করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন।
কারবালার ময়দানে ইবনে জিয়াদ যুদ্ধ শুরুর জন্য তার সেনাপতি ইবনে সাদকে চরমপত্র দিল। হয় আমিরুল মোমেনিন হিসেবে ইয়াজিদের আনুগত্য স্বীকার করতে হবে নতুবা মৃত্যু। এছাড়া আর কোন পথ ইমামের সামনে খোলা রইল না। ইমাম ইয়াজিদের আনুগত্যের পরিবর্তে আল্লাহর আনুগত্যকেই বেছে নিলেন। কারণ তিনি নিজেই দোয়া করতেন, “হে আল্লাহ! যতদিন পর্যন্ত আমি তোমার আনুগত্য করি অনুসরণ করি, ততদিন আমার হায়াত বাড়িয়ে দিও। আর যদি তা শয়তানের চারণভূমিতে পরিণত হয় তাহলে আমাকে তোমার কাছে তুলে নিও।”
ইমাম হোসাইন (রা.) তার সঙ্গী সাথীসহ সবাইকে নিয়ে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করলেন। তবু ইয়াজিদের শাসনক্ষমতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেননি। ইয়াজিদ প্রায় ৫ সহ¯্রাধিক সেনাবাহিনী নিয়ে ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়ে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর ক্ষুদ্র ঈমানদার ১শ’ জন সাহাবীকে শহীদ করে তার ক্ষমতা সাময়িকভাবে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় চিরদিনের জন্য তিনি ইসলাম ও মুসলমানদের তথা সত্যপ্রেমীদের শত্রুতে পরিণত হয়েছেন। আর ইমাম হোসাইন (রা.) অন্যায়ের প্রতিবাদ করে জীবন দিয়ে শাহাদাত বরণ করে ইহকাল ও পরকালে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। আজো যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনগণের সমর্থন না নিয়ে ক্ষমতা দখল করে অন্যায় নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের জন্য এ ঘটনা অবশ্যই শিক্ষনীয়।
পবিত্র আশুরার দিন শুধু মাত্র ইমাম হোসাইন (রা.) শাহাদাত বরণের দিন নয়, এ দিন পৃথিবী সৃষ্টি থেকে কেয়ামত পর্যন্ত অসংখ্য ঘটনার দিন। শুধু মুসলমান নয় সকল মানুষের কাছে দিনটি স্মরণীয়। ইতিহাসে বিশাল জায়গা দখল করে আছে পবিত্র আশুরা দিবস। মহান আল্লাহ তায়ালা এ দিনেই আরশ, কুরছি, লওহ, কলম আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং এ দিনেই আদম (আ:)-কে সৃষ্টি করে তাকে বেহেশতে স্থান দিয়েছেন। পরবর্তীতে শয়তানের প্ররোচনায় ভুলের কারণে এ দিনেই তাঁকে দুনিয়াতে পাঠিয়ে আল্লাহ প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছেন। হযরত নূহ (আ:) সাড়ে নয়শত বছর ধরে তাওহীদের বাণী প্রচারের পর যখন সে যুগের মানুষ আল্লাহর বিধি নিষেধ পালনে অস্বীকৃতি জানায়, তখন নেমে আসে আল্লাহর গজব। ফলে হযরত নূহ (আ:) এর সম্প্রদায় ধ্বংস হয়েছে। শুধু রক্ষা পেয়েছে তাওহীদে বিশ্বাসী নূহ (আ:) এর অনুসারী বৃন্দ। পবিত্র আশুরার দিনে মহাপ্লাবনের সময় হযরত নূহ (আ:) এর নৌকা তার অনুসারীদের নিয়ে জুদি পাহাড়ের পাদদেশে এসে থেমেছিল। আজো তার কিছু নির্দশন সেখানে পাওয়া যায়। পবিত্র আশুরার দিনেই হযরত ইব্রাহীম (আ:) শত বিধি-নিষেধের মধ্য দিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি নমরুদের অগ্নিকুন্ড থেকে উদ্ধার লাভ করেন এবং নিজের প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আ:) কে আল্লাহর নামে জবেহ করতে উদ্যত হলে খলিলুল্লাহ বা আল্লাহর বন্ধু হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিলেন পবিত্র আশুরার দিনে। এদিনেই হযরত আইউব (আ:) কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন, হযরত ঈসা (আ:) জন্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং কাফেরদের ষড়যন্ত্রে শিকার হলে আল্লাহ তাকে চতুর্থ আসমানে উঠিয়ে নেন। এদিনেই হযরত দাউদ (আ:) আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা লাভ করেছিলেন, হযরত সোলেমান (আ:) তার হারানো রাজত্ব পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছিলেন, হযরত ইউনুস (আ:) মাছের পেট থেকে মুক্তি লাভ করেছিলেন, হযরত ইয়াকুব (আ:) তার হারানো পুত্র হযরত ইউসূফ (আ:)কে চল্লিশ বছর পর ফিরে পেয়েছিলেন। পবিত্র আশুরার দিনে ফেরাউনের স্ত্রী বিবি আছিয়া শিশু মুসাকে গ্রহন করেছিলেন। আবার স্বীয় কওমের লোকজনসহ হযরত মূসা (আ:) লোহিত সাগর অতিক্রম করে ফেরাউনের জুলুম থেকে মুক্তি লাভ করেন। পক্ষন্তরে ফেরাউন সদলবলে নীল নদে ডুবে মারা যায়। পবিত্র আশুরা সমগ্র জগৎ সৃষ্টির দিন হিসেবে যেমনি স্বীকৃত তেমনি এদিন কেয়ামত অনুষ্ঠিত হয়ে জগৎ ধ্বংস প্রাপ্ত হবে। এদিন এমনি আরো বহু ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং আরো হবে।
পবিত্র আশুরার দিন মুসলিম জাহানের জন্য যে কারণে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হৃদয়বিদারক স্মরণীয় তা হলো, এদিনে স্বৈরাচারী ইয়াজিদ বাহিনী বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর প্রাণাধিক দৌহিত্র অকুতভয় সৈনিক হযরত ইমাম হোসাইন (রা:) কে একজন ব্যতিত স্বপরিবারে কারবালার মরুপ্রান্তরে নির্মমভাবে হত্যা করে। হযরত ইমাম হোসাইন ক্ষমতার জন্য ইয়াজিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেননি। বরং তিনি লড়াই করেছিলেন ইয়াজিদের ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন ইয়াজিদ ইসলামী রাষ্ট্রের নিয়ম কানুন লংঘন করে এবং কুরআন হাদীসকে উপেক্ষা করে মনগড়া পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। ফলে ইমাম হোসাইন (রা:) আশংকা করেছিলেন আল্লাহর আইনে পরিচালিত খেলাফত পদ্ধতি বিলুপ্ত হয়ে মনগড়া স্বৈরতান্ত্রিক রাজত্ব কায়েম হবে। পরবর্তীতে তাই হয়েছে।
ইমাম হোসাইন (রা:) ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছিলেন, সত্যের পতাকা সমুন্নত রাখার জন্য তিনি স্বপরিবারে জীবন দিয়ে শাহাদাত বরণ করে স্মরণীয় হয়ে আছেন। আজো কেউ যদি পাশ্চাত্য সভ্যতার হিংস্র থাবা ও আল্লাহর আইনের পরিবর্তে মনগড়া আইনে পরিচালিত রাষ্ট্রশক্তির প্রতিবাদ করতে গিয়ে জীবন বিলিয়ে দেন। তাহলে হযরত ইমাম হোসাইন (রা:) এর উত্তরসূরী হিসেবে শাহাদাতের মর্যাদা নিয়ে বেহেশত লাভ করবেন।
এদিন উপলক্ষে রোযা পালন করার কথা বলেছেন রাসূল (সা:)। এদিনে কুরআন তেলাওয়াত ও আলোচনার আয়োজন করে আল্লাহর কাছে দোয়া করা যায়। যাতে ইমাম হোসাইন (রা:) এর শাহাদাতের বদৌলতে আল্লাহ গোটাবিশ্বে ইসলামী শাসন কায়েম করার ব্যবস্থা করে দেন।
লেখক : সাংবাদিক।