মুহাম্মদ ওয়াছিয়ার রহমান

বেশ কয়েক মাস দেশে রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে। ৩৩টি দল ও কয়েকটি জোট মিলে এ বিতর্ক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিএনপিসহ দু-তিনটি দল বাকিদের সাথে দ্বিমত পোষণ করছে। সেখানে বিএনপির বড় প্রশ্ন যেকোনো সংস্কার, পিআর বা সংখ্যানুপাত নির্বাচন এগুলো তো নির্বাচিত সরকারের কাজ, এগুলো এখন কীভাবে হবে? বিএনপির কাছে প্রশ্ন হচ্ছে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ কোন আইন, বিধি বা সংবিধান বলে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন উপ-রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হলেন এবং পরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হলেন? তিনি তো তখন প্রধান বিচারপতি পদে সমাসীন ছিলেন। তার শর্ত অনুসারে আমরা পরে সংবিধান সংশোধন করে আবার তাকে প্রধান বিচারপতি পদে ফিরিয়ে নিয়েছি। এটা তো কোনো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নয়। এটা তো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তখন তো প্রশ্ন তোলেননি বিএনপি। বাংলাদেশে বিদ্যমান সংবিধান তো ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্যগণ প্রণয়ন করে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ কীভাবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করে?। ১৯৭১ সালে এপ্রিল শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে এবং ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত সে দায়িত্বে ছিলেন তিনি। শেখ মুজিব কি কখনও রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ পড়েছিলেন? তাহলে ইতিহাস কীভাবে তাকে শপথ ছাড়া ঐ পদ দেয়। ২০১৭ সালে আওয়ামী লীগের নেতারা বিচারপতি এস.কে সিনহাকে বললেন-বটতলার উকিল, তোকে আমরা প্রধান বিচারপতির চেয়ারে বসিয়েছি। কীভাবে সম্ভব? প্রধান বিচারপতি নিয়োগ তো রাষ্ট্রপতির কাজ আওয়ামী লীগ নেতারা কীভাবে এ দাবি করলেন? সংবিধানের কোন ধারাবলে তারা নিয়োগ দিলেন?

আমাদের দেশে ব্যক্তিতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র, দলতন্ত্র, ছবিতন্ত্র, এলাকাতন্ত্র, অর্থতন্ত্র, জুলুমতন্ত্র ও সিন্ডিকেটতন্ত্রের মতো ইস্যু রাজনীতিকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। অধিকাংশ দলের মধ্যে ব্যক্তিতন্ত্রের দৌরত্ম্য বিরাজমান। মনে হয় দলের মধ্যে উনি ছাড়া আর কোন যোগ্য লোক নেই। তার অনুপস্থিতিতে তার পরিবারের সদস্য দায়িত্বে আসছে বা আসার প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এজন্য বেশকিছু দল একক ব্যক্তির নেতৃত্বে চলছে। সেক্ষেত্রে দলের চেয়ে ব্যক্তি গুরুত্ব অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। ঐ ব্যক্তি মরার আগ পর্যন্ত দলের দায়িত্ব তিনি ছাড়া অন্য কেউ আসতে পারছে না। এ জন্যই সংগঠনের কেন্দ্রীয় অফিস থাকার পরও সভানেত্রী বা চেয়ারপারসনের অফিস আলাদা থাকে এবং কেন্দ্রীয় অফিসের চেয়ে ঐ অফিস গুরুত্ব বেশি পায়। এজন্য বড় বড় দলের দলীয় নির্বাচনে প্রার্থী থাকে একজন। অন্য কেউ প্রার্থী হতে চাইলে বা হলে দলীয় একটি মহল যেন তাকে খেয়ে ফেলতে চায়।

আর দলীয় প্রধান পদে নির্বাচনী মহড়া হলেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে মনোনয়ন কার্যকর হয়ে থাকে। বড় দলগুলোতে দলীয় প্রধান পদে নির্বাচন হয় তবে প্রার্থী থাকে একজন। এটা নির্বাচন বলেলও সিডিন্ডকেটি নির্বাচন বলা সংগত। রাষ্ট্রের কোন নির্বাচনে একটি দল নির্বাচন করলে আমরা তাকে অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলে থাকি। দলের বেপারে কোন কথা বলি না কারণ- ‘কাকে বলবো চিনা চোর, নিজের মাথায় এক আটি’।

দলীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি যথাযথ নির্বাচনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করলেও নেতৃত্ব পরিবর্তন হচ্ছে না। প্রথম বার হলেও এবি পার্টি সরাসরি ভোট করেছে, এটা শুভ লক্ষণ। শোনা যায়, এনসিপি তাদের নেতা নাকি ৩ বছরের বেশি থাকতে পারবে না। এটা একটা নতুন উদ্যোগ। রাষ্ট্র সংস্কার যেভাবেই হোক রাজনৈতিক সংস্কার আবশ্যক। রাষ্ট্রপতি পদে কোন ব্যক্তি দু’বারের বেশি আসতে পারবে না। অন্য ছোট-খাট দু-একটি দল যথাযথ প্রক্রিয়ায় তাদের দলীয় নির্বাচন করে থাকে। এটা সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে হাওয়া দরকার। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ আর রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ পদ আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক দলের মধ্যে নির্বাচনী গণতন্ত্রচর্চা শুরু হলে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব। দুঃখজনক হলেও সত্য, গত ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পিরোজপুর সদর উপজেলা বিএনপির কমিটি নির্বাচনে ব্যালট ছিনতাই ও সংঘর্ষ হয়েছে। অবশেষে জেলা কমিটি বাতিল করেছে কেন্দ্রে।

পিআর পদ্ধতি পৃথিবীর একানব্বটির বেশি দেশে চালু আছে। এতে জনগণের ভোটের মূল্যায়ন হয়। কোন দল দশ শতাংশ ভোট পেলে সংসদে দশ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব পাবে। বর্তমান অবন্থায় ২০ শতাংশ ভোট পেয়েও সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব নাও থাকতে পারে। পিআর পদ্ধতিতে দল ও আদর্শ প্রাধান্য পায়। ব্যক্তি সেখানে গৌণ। গণতন্ত্রের চর্চায় সরাসরি ও পিআর দুটি পদ্ধতিতেই কিছু না কিছু সমস্যা আছে। সে সমস্যা রাজনৈতিক দলের আদর্শ ও চারিত্রিক ব্যর্থতাজনিত। পিআর পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সভায় এ পদ্ধতিসহ কিছু বিষয় পাশ না হওয়ার পিছনে দলতন্ত্র প্রবল আকারে কাজ করেছে। যারা পিআর মানেন না বা পিআর জনগণ বুঝে না বলে জিকির করেন। তাদের দলে আগে নির্বাচনী কার্যক্রমে পূর্ণ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়। পিআর-এর সুবিধা হলো জনগণের ভোটের মূল্যায়ন, রাজনীতিতে দাদাগিরি প্রশমন ও ছোট দল গুলোর মর্যাদা রক্ষা। অসুবিধা হলো সরকার পরিচালনায় সংশ্লিষ্টদের মানসিক টেনশান থাকতে হয়। রাজনৈতিক ভারসাম্যের ঝুঁকি তো আছেই। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন সরকারী অনেক কর্মকর্তা নতুন স্থানের পেস্টিং হওয়ার দু-এক সপ্তাহ বা দু-এক মাসের মধ্যে কখনও কখনও তাকে বদলি করায় হয়। তখন তো এটা মনে রাখা হয়না যে এতে প্রশাসনের ভারসাম্য ক্ষুন্ন হচ্ছে। তবে রাষ্ট্রের ব্যাপাওে রাজনৈতিক ভারসাম্যের প্রশ্ন আসছে কেন? ও ওরা কর্মচারী যা ইচ্ছা তাই করা যাবে! এখানে আর রাজনীতিবদরা স্বৈরাচার হলেও তাকে কোনো ঝামেলা পোহাতে হবে না। রাজনীতিবিদরা নিজেদের কী মনে করেন?

বিএনপি বারবার বলে আসছে জনগণ পিআর বোঝে না। এ বক্তব্য জনগণকে অবজ্ঞার শামিল। বিএনপির প্রশ্নের সূত্র ধরে বলতে হয়, বিএনপির নেতাদের কয়জন তাদের দলীয় লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও ১৯ দফা কর্মসূচি জানে বা মুখস্থ রাখে। বিএনপির ঐ বক্তব্য যদি অবমাননা না হয় তবে তাদের নেতাদের সম্পর্কে এমন প্রশ্ন তোলাও অবমাননা হবে না। শুধু বিএনপি নয় অধিকাংশ দলেরই এমন হালহকিকত।

রাজনীতির এ করুণ হালের কারণে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী দলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধার ধান্ধায় নেতা-কর্মী জড় হয়। এক্ষেত্রে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্প্রতি দলের নেতা-কর্মীদের আগামী ফেব্রুয়ারি ২০২৬ পর্যন্ত কোনো ধরনের চাঁদাবাজি-দখলবাজি না করার আহ্বান রাজনীতির গুণগত মানের হালহকিকত নির্দেশ করে। বিএনপির কিছু নেতা-কর্মীর কারণে বিএনপিকে দারুণ সমালোচনার দায় ভোগ করতে হচ্ছে। তাইতো নেতা-কর্মীদের হাত থেকে বাঁচতে তারেক রহমানের এমন আকুতি।

রাজনীতিবিদদের মধ্যে পড়াশোনা একেবারেই কমে গেছে। এক্ষেত্রে জামায়াত নেতা-কর্মীকে মাসে কুরআন-হাদিস বাদে তিনশ’ পৃষ্ঠা বই পড়তে হয়। কমিউনিস্ট পার্টিতেও পড়াশোনা করতে হয়। পড়াশোনা না করার কারণে অন্যরা ধান্ধাবাজিতে বেশি লিপ্ত থাকে। বিএনপি যেমন অভিযোগ করছে জনগণ পিআর বুঝে না, শুধু জনগণ নয়, আসলে অনেক রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও পিআর বোঝেন না। যেহেতু পিআর নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে তাই জনগণের এ সম্পর্কে বুঝকে শাণিত করতে রেডিও-টিভি ও পত্র-পত্রিকায় সরকারিভাবে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে জনগণকে এ বিষয় আরও সচেতন করা দরকার। পিআর ছাড়া আপাতত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন সম্ভব নয়। তবে রাজনৈতিক দলগুলো প্রয়োজনে আপাতত পরীক্ষামূলক একবার চালু করতে পারে। বাস্তবতা পরীক্ষা করে পরে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। ঐকমত্য কমিশনের সভায় অধিকাংশের মতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। অন্যথায় দলতন্ত্রের প্রভাব ঐকমত্য কমিশনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক।