তৌহিদুর রহমান

ছোটবেলা থেকেই আমার বই পড়ার অভ্যাস প্রবল। আমি যখন অনেক ছোট তখন আমার এক বড় ভাইয়ের হাতে একটা সবুজ মলাটের বই দেখেছিলাম। তাতে লেখকের নাম লেখা ছিল পি এ নাজির। বড় ভাই কলেজে পড়তেন। করতেন কমিউনিস্ট পার্টি। তার পড়ার টেবিলে অনেক লাল মলাটের বই দেখেছি তখন। তখন অতো কিছু বুঝতাম না। একটু বড় হলে তিনি আমাদের ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসটি পড়তে দিয়েছিলেন। কিন্তু পি এ নাজিরের ঐ বইয়ে কখনো হাত দিতে দেননি। বরাবরই বলেছে এ বই ছোটদের জন্য নয়। সে তখন থেকে এ বইটার সাথে আমি পরিচিত। সাধারণত নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি কৌতূহল একটু বেশিই থাকে। আমারও তা-ই ছিল। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। আমি যখন কলেজে উঠলাম তখন একটা বিষয় ভালোভাবে লক্ষ্য করেছি আমাদের দেশের বামপন্থিরা সব সময় সাধারণ মানুষ ও সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে কিছু একটা লুকাতে চাইত। এখন বুঝি কেন আমার ওই বড় ভাই কখনো পি এ নাজিরের বইটা আমাকে ধরতে দেননি।

আসলে বামপন্থিরা চরম ইসলাম বিদ্বেষী। তারা অতিকৌশলে মুসলিমদের ভালো দিকগুলো কখনো মানুষের সামনে আসতে দেয় না। এদের কাছে হিন্দুরা ভালো, বৌদ্ধরা ভালো শুধু মুসলিমরা খারাপ। মুসলিম মানেই জঙ্গি, মুসলিম মানেই সন্ত্রাসী, খুনি। এ একটা বিষয়ে পশ্চিমাদের সাথে বামদের খুব মিল আছে। পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, তারা চরম ইসলামবিদ্বেষী। পশ্চিমা বিশ্ব এবং বাম-রামরা ১৯৪৭ পূর্ব ইতিহাস বরাবরই আড়াল করে রাখতে সচেষ্ট।

পাকিস্তান সৃষ্টির একটা অপূর্ণ বা খণ্ডিত চিত্র ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী গোষ্ঠী, বামপন্থি ও পশ্চিমারা মিলে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করেছে-আর শুধুমাত্র তাদের উপস্থাপিত সেই ইতিহাসটুকুই আমরা জানি। শিশু থেকে মাস্টার্স শ্রেণি পর্যন্ত আমাদের পাঠ্যপুস্তকে এর বেশি কিছু নেই। ভারতের বুকে ঘটে যাওয়া গণহত্যার মতো অনেক নির্মম ঘটনা হয়েছে উপেক্ষিত পশ্চিমাদের এই ইতিহাসে। যা মূলধারার মিডিয়া ও ইতিহাসের গ্রন্থে অনেকাংশেই অবহেলিত। আমি বিস্মিত ও ব্যথিত হয়ে দেখেছি, বহু স্বনামধন্য লেখকও এ ইতিহাসকে যথোচিত গুরুত্ব দেননি। বলা যায় বাংলাভাষাভাষীদের কাছে যা আজও পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপিত হয়নি।

ভারতে ঘুরতে গেলে অবাক হতে হয়-মনে হবে যেন প্রতিটি ইঞ্চি মাটি একদিন মুসলিমদের স্পর্শে সোনা হয়ে উঠেছিল। চেন্নাই শহরের গ্রিমস রোডের একটা বাড়িতে আমি তিন মাসের মতো ছিলাম। ওখানে বাজারের পাশেই একটা চারতলা বিশাল মসজিদ আছে। এ মসজিদে নামাজী নেই বললেই চলে। ওয়াক্তের নামাজে কোনোমতে চার পাঁচজন হয়। নীচতলায় জুতা রাখা হয়, দোতলায় নামাজ হয়, তিন তলায় শুক্রবারে দু’এক কাতার হয় আর চার তলায় ইমাম সাহেব থাকেন। এ ধরনের শত শত মসজিদ মাদরাসা পড়ে আছে যেখানে নামাজ বা শিক্ষা কার্যক্রম চলে না। এ কথা বললাম এজন্যে যে, ইতিহাস না পড়লে আমরা ভারতবর্ষের সঠিক ইতিহাসটা জানতে পারবো না।

যাহোক, সরাসরি একজন ইতিহাসবিদের মুখ থেকে ইতিহাস শোনার মজাই আলাদা। পিএ নাজিরের বইটি পাঠ করতে যেয়ে আমার পরতে পরতে মনে হয়েছে লেখক যেন আমাদেরকে বার বার সত্যের পাটাতনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। ইতিহাসের দায়-মাটি ও মানুষ, যুদ্ধের ময়দান, উপত্যকা, মসজিদ সবই যেন আমার চেতনায় এক অমোচনীয় ছাপ ফেলে গেছে। লেখক ইতিহাসকে শুধু তথ্যের গাঁথুনিতে নয়, অনুভবের ভাষায় স্মৃতিময় করে তুলেছেন। ইতিহাস যেন হৃদয়ে গাঁথা থাকে, ইতিহাসের কান্না যেন পাঠক শুনতে পায় তারই বিদগ্ধ আয়োজন পিএ নাজিরের এই বইটি। মানবাতার কান্না শুনে যেন পাঠকের হৃদয়ও কেঁদে ওঠে। ইতিহাসের বাক ফেরানোর গল্পে যেন পাঠকের বুক ভারী হয়ে যায়। পূর্বপুরুষের আত্মত্যাগের গল্প যেন পাঠক স্মরণে রাখে তার সফল আয়োজন বইটি।

আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান যখন বলছিলেন, ‘বইটির কাব্যিক ভাষা আমাকে মুগ্ধ করেছে।’ আসলেই তাই এমন অসাধারণ গদ্য ছন্দ বইটিকে করেছে সুখপাঠ্য। একবার পড়া শুরু করলে বইটা শেষ না করে ওঠা যাবে না। ইতিহাসের বই যে এমন সুমধুর ভাষায় লিখিত হতে পারে তা সত্যিই বিরল। বইটিতে মালদা, মুর্শিদাবাদ, কোলকাতা, ইউপি-সহ সারা ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন স্থানের গণহত্যার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

যেমন- ‘মালদহ ও মুর্শিদাবাদ থেকে দাঙ্গার খবর আসতে লাগল। এসব খবর সাধারণত একটু অতিরঞ্জিত হয়েই আসে। তবে ঢাকার খবরের কাগজগুলোতে এসব দাঙ্গার সমর্থন আসতে লাগল। ভারতে মুসলিম নিধনযজ্ঞ খুবই সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল। এমন কোনো মাস বা সপ্তাহ নেই যখন সে দেশে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা ঘটছে না।’ (স্মৃতির পাতা থেকে, পৃষ্ঠা ১২৮)

তার বইয়ের কনটেন্টগুলোর শিরোনাম খুবই কাব্যিক। সাধারণত কবিতার ক্ষেত্রে এ ধরনের শিরোনাম লক্ষ্য করা যায়। শিরোনাম দেখে বুঝার উপায় নেই যে, এটা গল্প, কবিতা না ইতিহাস। এ শিরোনামই পাঠককে বইটির ভিতরে ঢুকতে আকৃষ্ট করবে। পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এখানে তা হুবহু তুলে ধরা হলো, ‘সিগারেট লাইটার জ্বেলে, গ্রাম নয়Ñ শহর, গুড় ভর্তি সিন্দুক, চৌদা সালকা সাজা, লস এঞ্জেলেসের সূর্যাস্ত, ডেভিডের প্রেতাত্মা, চার হাজারী নয়Ñ দু’হাজারী, আপ উধার যাইয়ে, সকাল হলেই বুঝবে, টেলিফোন বয় এবং অর্ধচন্দ্র।’ এতো বড় একটা ইতিহাস গ্রন্থের এই সামান্য কয়টি শিরোনাম। এটা যেন বিন্দুতে সিন্ধু।

ইতিহাসের অনেক ছোট বড় ঘটনা বইটিতে উপস্থাপিত হয়েছে। সে বৃটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল, এমনকি বাংলাদেশ আমলও। ভারত থেকে সবসময় শত শত মুসলিম নির্যাতিত হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। এখনো ঢুকছে। এ ব্যাপরে এ দেশের মানুষ কখনো মাথাঘামায় না। কিন্তু এদেশের কিছু চাটুকার বুদ্ধিজীবী মানে যারা কোলকাতায় বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা ধরে তারা এ ব্যাপারে টুশব্দটি করে না, উল্টো এদেশে কোনো হিন্দু বা উপজাতির কেউ দেশ ছাড়লে তারা বাতাস ভারী করে তোলে। এটা বামপন্থি, ভারতপন্থি কিছু পেইড এজেন্টদের কাজ। পিএ নাজির লিখছেন, ‘মজার কথা, সীমান্তের ওপার থেকে বিতাড়িত অসহায় মানুষের সম্পর্কে কেউ একটা কথাও বললেন না। অথচ এ মানুষ একদিন আসামে গিয়ে জঙ্গল সাফ করে চাষাবাদ করে সেখানে বস্তি স্থাপন করেছিল। আসামে ‘বাঙ্গাল খেদাও’ আন্দোলন সে বরদোলই সরকারের সময় থেকেই বলতে গেলে চলে আসছে। নানা অজুহাতে এসব মানুষকে বিতাড়িত করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। সেই যে কবে শুরু হয়েছে ‘বাঙ্গাল খেদাও’-আজও তা শেষ হয়নি।’ (স্মৃতির পাতা থেকে, পৃষ্ঠা ১৭১) এই বিখ্যাত বইটির লেখকের পুরো নাম ‘মো. পিয়ার আলী নাজির, সংক্ষেপে পিএ নাজির নামে পরিচিত। তিনি ১৯৩০ সালের ৩০ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিম বাংলার হাওড়া জেলার অন্তর্গত বাগনান শহরের নজরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ... তিনি ১৯৫১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্সসহ এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ... পিএ নাজির রাজশাহী, ময়মনসিংহএবং ১৯৬৬ সালে ঢাকা জেলার ডিসি ছিলেন।’ (বইয়ের শেষ মলাট)

এ গ্রন্থটি নিছক একটি গতানুগিতক স্মৃতিচারণ নয়, এটি ইতিহাস, আত্মজিজ্ঞাসা ও মানবতার উপর সংঘটিত এক নির্মম আঘাতের দলিল। লেখক চেয়েছেন এ বইয়ের মধ্য দিয়ে পাঠক শুধু ইতিহাস জানতে নয়-অনুভব করতেও যেন সক্ষম হন। আমরা বইটির ব্যাপক প্রচার কামনা করি। আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে সত্যের সন্ধানে, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহসী সৈনিক করে তোলেন।

লেখক : সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক