নারী অধিকারের বিষয়টি শুধু আমাদের দেশে নয় বরং পুরো বিশ্বেই একটি বহুল আলোচিত ও চর্চিত বিষয়। আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ চিন্তা-দর্শন, বোধ-বিশ্বাস, আবেগ-অনুভূতি থেকে নারী অধিকার বিষয়ক বিস্তর কথাবার্তা বলে থাকি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, মানবসভ্যতার অভাবনীয় বিকাশের একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এ বিষয়ে আমরা সর্বজনীন কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারিনি। যা ক্রমবিকাশমান সভ্যতাকে কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বস্তুত ‘নারী’ বা ‘মহিলা’ বলতে একজন স্ত্রীজাতীয় মানুষকে বোঝায়। অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীকে ‘মেয়ে’, ‘বালিকা’ বা ‘কন্যাশিশু’ বলা হয়। নারীরা বয়োঃসন্ধিকাল থেকে রজোনিবৃত্তি পর্যন্ত গর্ভধারণ ও প্রসব দিতে সক্ষম। নারী প্রজননতন্ত্রের মাধ্যমে পুরুষ ও নারীদেহের মধ্যে পৃথক করা হয়। ইংরেজিতেও নারী বিষয়ক সংজ্ঞায় এ কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। এতে বলা হয়েছে, A woman is an adult female human. Before adulthood, a female child or adolescent is referred to as a girl. ঐতিহাসিকভাবেই নারীদের কার্যকলাপ ও সুযোগকে সীমিত রাখা হয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে ধর্মীয় বিধিবিধান নারীদের উপর নির্দিষ্ট কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এক্ষেত্রে ধর্মের অপব্যাখ্যাও নেহাৎ কম নয়। ধর্মান্ধতা ও গোঁড়ামী এক্ষেত্রে একটি অতিউল্লেখযোগ্য অনুষঙ্গ। তবে একবিংশ শতাব্দীতে এসব বিধিনিষেধ শিথিল হতে শুরু করেছে এবং এর ফলে নারীরা প্রথাগত গৃহকর্মের বাইরের জীবিকায় প্রবেশ করতে শুরু করেছেন। উচ্চ শিক্ষা অর্জনের অধিকার পাচ্ছেন। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, নারীর প্রতি সহিংসতার একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এক্ষেত্রে অভিযোগের তর্জনিটা পুরুষের দিকেই সব সময়। অবশ্য একটি পক্ষ নারীবাদী আন্দোলন এবং মতাদর্শের মধ্যে লৈঙ্গিক সমতা অর্জনের কথা বলে প্রকৃত সমস্যাকেই পাশ কাটিয়ে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। তারা নারী অধিকার আদায়ের নামে নারী সমাজকে রীতিমত পুরুষের প্রতিপক্ষ বানিয়েছেন। তারা নারী-পুরুষের লৈঙ্গিক সমতার কথা বললেও তা মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। কারণ নারী-পুরুষের মধ্যে যে সৃষ্টিগত বৈপরিত্য রয়েছে, তা কোনভাবেই সমতা আনা সম্ভব নয়। এমন কল্পনাকে সম্পূর্ণ অবাস্তব ও দায়িত্বহীন বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত।
সংস্কৃত পণ্ডিতরা নারীকে ‘রমণী’ বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বস্তুত ‘নারী’ ও ‘মহিলা’ উভয়ই তৎসম শব্দ। অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষা থেকে সরাসরি গৃহীত। ‘নারী’ শব্দকে সাধারণত ‘নর’ অর্থ ‘মানুষ’ বা ‘পুরুষ মানুষ’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। তবে সংস্কৃত পণ্ডিত বিজয় চন্দ্র মজুমদারের মতে, ‘বেদের ভাষার মধ্যে যাহা প্রাচীনতম সেই ভাষার স্ত্রীজাতির সাধারণ নাম ছিল ‘নারী’; এই নারী শব্দ ‘নর’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গের রূপ নহে। নর শব্দটি সুপ্রাচীন বেদ-সংহিতায় প্রচলিত নাই। যে যুগে নর শব্দ ছিল না, কিন্তু ‘নৃ’ শব্দ ছিল, সেই যুগেই স্ত্রীজাতি বুঝাইবার জন্য নারী শব্দের যথেষ্ট প্রচলন ছিল...’।
এবার অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে। বস্তুত অধিকার হচ্ছে আইনগত, সামাজিক বা নৈতিক নীতির স্বাধীনতা বা দাবী; অর্থাৎ, আইনী আইন, সামাজিক সম্মেলন বা নৈতিক তত্ত্ব অনুসারে মানুষের অধিকার বা মানুষের কাছে ঋণী হওয়া সম্পর্কে মৌলিক আদর্শ নিয়মগুলো। আইন এবং নীতিশাস্ত্র, বিশেষত ন্যায়বিচার এবং ডিঅন্টোলজি তত্ত্বের মতো এ শৃঙ্খলাগুলোতে অধিকার অপরিহার্য। মূলত, সৃষ্টিগত ও প্রথাগত এবং প্রচলিত আইন অনুসারে যা প্রাপ্য তা-ই অধিকার। আর এসব প্রাপ্য থেকে কাউকে কোনভাবে বঞ্চিত করা হলে তা অধিকার হরণের পর্যায়ে পড়ে। বস্তুত, প্রত্যেক মানুষ জন্মগতভাবে কিছু অধিকার সংরক্ষণ করেন। আর এর অন্যথা হলেই অধিকার হারানোর জোরালো প্রশ্ন ওঠে। ইংরেজিতে অধিকারের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘Rights are legal, social, or ethical principles of freedom or entitlement; that is rights are the fundamental normative rules about what is allowed of people or owed to people according to some legal system, social convention, or ethical theory. Rights are an important concept in law and ethics, especially theories of justice and deontology.’
শুধু আমাদের দেশে নয় বরং গোটা বিশ্বেই নারী অধিকার নিয়ে নানা ধরনের মতবাদ চালু রয়েছে। ধর্ম, বিশ্বাস, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, চিন্তা ও আদর্শগত পার্থক্যের কারণে নারী অধিকার নিয়ে ভিন্নভিন্ন অবস্থান ও বিস্তর মতপার্থক্যও লক্ষ্য করা যায়। এক পক্ষের কাছে যা অধিকার, অপরপক্ষের কাছে তা অনধিকার বলে বিবেচিত হয়। কেউ কেউ পুরুষের সমান্তরালীকরণকেই নারীর প্রকৃত অধিকার বলে মনে করেন। তারা নারী-পুরুষ উভয়ে একই মানদণ্ডে বিবেচনা করতে পুলকবোধ করেন। এ ধারণার প্রবক্তারা নারী-পুরুষ উভয়কে মনুষ্য প্রজাতি ছাড়া অন্যকিছু মনে করতে নারাজ। এদের পক্ষ থেকেই এসেছে উভলৈঙ্গিক পোশাকের ধারণাও। তাদের মতে পুরুষ-নারী উভয়ই মানুষ। তাই পুরুষ-নারীর মধ্যে কোন পোশাকী পার্থক্য থাকা যৌক্তিক নয়। তাদের ভাষায়, যে পোশাক লিঙ্গ নির্দেশ করে তা বৈষম্যমূলক ও মানবতার অপমান। আবার পক্ষ বিশেষ নারীর সমঅধিকারের পক্ষপাতি। তারা মনে করেন পুরুষ-নারীকে কোনভাবেই সমান্তরাল করা যাবে না। শুধু অধিকারের ক্ষেত্রে সমতা আনাই যুক্তিযুক্ত। কারণ, সৃষ্টিগতভাবে উভয়ের মধ্যে যে পার্থক্য বা তারতম্য রয়েছে তা সমান্তরালের ভাবনা শুধুমাত্র বাতুলতা নয় বরং চিন্তাগত বিভ্রান্তি।
তারা মনে করেন পুরুষ যা পারে নারীর পক্ষেও তা করা সম্ভব। তাই সকল ক্ষেত্রেই পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমান সুযোগ নিশ্চিত হওয়া দরকার। শিক্ষা-দীক্ষা, পেশা-কর্মে, রাজনীতিতে, ক্ষমতায়নে, সামাজিকতায়, পারিবারিক জীবন, লোকাচার ও চলাফেরায় পুরুষরা যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন, নারীদের ক্ষেত্রে তা নিশ্চিত করতে হবে। আবার বিশেষ পক্ষ সমঅধিকার নয় বরং নারীর নায্য অধিকারের পক্ষে। তারা মনে করেন, নারী-পুরুষের মধ্যে সৃষ্টিগত যে পার্থক্য রয়েছে তা কোনভাবেই সমান্তরাল করার সুযোগ নেই। খুব সঙ্গত কারণেই পুরুষ ও নারীর মধ্যে দায়িত্ব, কর্ম ও অধিকারগত ভিন্নতা রয়েছে। তাই নায্য অধিকারের ধারণাটাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। সৃষ্টির আদিকাল থেকে চলে আসা নারী অধিকার বিষয়ক এসব মতপার্থক্যের বিষয়ে একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কোন একক ও অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়নি। এটিকে সভ্যতার ব্যর্থতা বললেও অত্যুক্তি হবার কথা নয়।
প্রথমেই আলোচনা আসা যায় নারীকে পুরুষের সমান্তরাল মনে করা এবং সমঅধিকার বিষয়ে। মূলত, এ দু’টো ধারণাই ত্রুটিপূর্ণ মনে করার যথেষ্ট উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। কারণ, মানুষে মানুষে সমান্তরাল হওয়ার সুযোগ নেই। কোন পুরুষ যেমন অপর পুরুষের সমকক্ষ নন, ঠিক তেমনিভাবে কোন নারীও অপর কোন নারীর সমান্তরাল হতে পারেন না। আর নারীকে পুরুষের সমতুল্য বা পুরুষকে নারীর সমতুল্য করার চিন্তা করাকে এক ধরনের বিকারগ্রস্ততা বলা যায়। এমন নেতিবাচক চিন্তা কোনভাবেই নায্য হতে পারে না। কারণ, নারী-পুরুষ যেই হোন না কেন তারা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা সত্তা। প্রত্যেকের অবয়ব, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তিত্ব, মেধা, মনন, দেহাবয়ব, কর্মতৎপরতা, যোগ্যতা, প্রজ্ঞা, রুচী-অভিরুচী, আবেগ-অনুভূতি, শক্তি-সামর্থ্য ও কর্মপরিধিও ভিন্নতর। তাই এক মানবসত্তা অপর মানবসত্তার সমান্তরাল হওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। আর সমঅধিকারের ধারণা তো আরও বেশি ত্রুটিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর।
বস্তুত, মানুষের অধিকার কখনো সমান হয় না। এমন চিন্তা মানসিক বিকারগ্রস্ততা বৈ কিছু নয়। চাই সে পুরুষ হোক বা নারী। পৃথিবীতে যত মানুষ অধিকারও তত ধরনের; তত রকমের। যে অধিকার পিতার রয়েছে, সে অধিকার সন্তানের নেই; পক্ষান্তরে যে অধিকার সন্তানের রয়েছে সে অধিকার পিতার নেই। একইভাবে মা-মেয়ের অধিকারও সমান নয়। মূলত, নারী-পুরুষ সমঅধিকার তো দূরের কথা পুরুষে-পুরুষেও তো অধিকার সমান নয়। সঙ্গত, কারণেই কোন পুরুষ অফিসের ডিসি, অপর পুরুষ চাপরাশি। কেউ প্রধান শিক্ষক, কেউ সহকারী প্রধান শিক্ষক, কেউ সহকারী শিক্ষক আর কেউ চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি। এরা প্রত্যেকেই পুরুষ বা নারী হলেও অভিজ্ঞান ও পদ মর্যাদার কারণেই কর্মে, অধিকারে, দায়িত্বে ও মর্যাদায় এক ও অভিন্ন নন। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, সমঅধিকারের ধারণাটা ইতর প্রাণীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারলেও মানুষের জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ, পশুতে পশুতে কোন স্তর বিন্যাস না থাকলেও মানুষে মানুষে স্তর বিন্যাস রয়েছে সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই। এটি অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতা। এ বৃত্তের বাইরে আসা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।
আমাদের দেশে নারী অধিকার নিয়ে নানা কথা থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে এ বিষয়ে বড় বড় অর্জন আছে বলে প্রচার-প্রচারণা রয়েছে। নিকট অতীতের সরকারের পক্ষে দাবি করা হয়েছে যে, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের নারী উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের এমডিজি অ্যাওয়ার্ড, সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড, প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন, এজেন্ট অব চেঞ্জ, শিক্ষায় লিঙ্গসমতা আনার স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেস্কোর ‘শান্তি বৃক্ষ’ এবং গ্লোবাল উইমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড-২০১৮ সহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছে। এসব আমাদের দেশে নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অর্জন। তবে এসব দাবি পুরোপুরি সত্য নয় বরং এক্ষেত্রে বড় ধরনের শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে।
এর প্রমাণ মেলে ২০২৪ সালের নারী নির্যাতন বিষয়ক পরিসংখ্যান থেকে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর সারাদেশে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৫২৩ জন নারী। এদের মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন ২৭৮ জন এবং আত্মহত্যা করেন ১৭৪ জন। উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৫০৭ জন নারী। অন্যদিকে ২০২৪ সালে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৭৭ নারী। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যার শিকার হন ৩৬ জন নারী এবং আত্মহত্যা করেন ৭ নারী।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০২৪: আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর পর্যবেক্ষণ’ প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্যানুসন্ধানের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীর প্রতি সহিংসতা ২০২৪ সালের আরেকটি উদ্বেগজনক বিষয় ছিল। বিশেষ করে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা, যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতনের নানা ঘটনাসহ শিশু হত্যা ও নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৪০১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৪ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন। ধর্ষনের চেষ্টার শিকার হয়েছে ১০৯ জন। এরমধ্যে ধর্ষণের চেষ্টার পর হত্যা করা হয় ১ জনকে। এরপরও আমাদের দেশে নারী অধিকারের অগ্রগতির বিষয়টি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। যদিও এক্ষেত্রে বিচ্যুতিটাও নেহাৎ উপেক্ষা করার মত নয়। কারণ, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে নারীর প্রতি অহিংসতা আগের তুলনায় অনেকাংশেই বেড়েছে। এরপরও অর্জনগুলোকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। উল্লেখ্য, নিকট অতীতে আমাদের দেশের সংসদ নেত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী। এমনকি জাতীয় সংসদসহ সকল নির্বাচনে সকল পদেই যদি নারীরা নির্বাচিত হন আইন সংবিধান বা আইন সেক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক নয়। সর্বোপরি নারীদের ক্ষেত্রে সবকিছু অবারিত রাখার পরও তাদের জন্য সংরক্ষিত কোটা রয়েছে। চাকরির ক্ষেত্রেও একই কথায় প্রযোজ্য। আর দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নারী হওয়ার কারণে কোন বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তেমনটা নেই বললেই চলে। কালেÑভদ্রে ব্যতিক্রমী কোন ঘটনা ঘটলেও পুরুষরা এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্ত নন।
সরকারের দাবি অনুযায়ী আমরা নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে মাইল ফলক স্পর্শ করলেও তা এখনও সমস্যা মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে তথাকথিত নারীবাদীরাই এ সমস্যাটিকে অমিমাংসিত রেখেছেন। নারীর ক্ষমতায়ন, কর্মে ও পারিশ্রমিকে সমতা, পুরুষের সমান্তরালে রাজনৈতিক অধিকার, শিক্ষা ও চাকরিতে যোগদানের সমান অধিকার নিয়ে বিরোধপূর্ণ পক্ষগুলোর মধ্যে তেমন মতপার্থক্য নেই। মতপার্থক্যটা রয়ে গেছে নারীর পারিবারিক ও তার দাম্পত্য জীবনের অধিকার-অনাধিকার বিষয়ে। এ বিষয়টিকেই পরিকল্পিতভাবেই জিইয়ে রেখেছে তথাকথিত প্রগতিবাদীরা। তারা সকল ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের সমকক্ষ করতে চান। যদিও তা বাস্তবসম্মত নয়।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সমঅধিকারের ধারণাটাই বেশ ত্রুটিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর। কারণ, ব্যক্তি বিশেষে অধিকারের ভিন্নতা রয়েছে। মূলত তথাকথিত নারী অধিকারের ধারক-বাহকরা নারী ও পুরুষের সম্পর্ককে এমনভাবে উপস্থাপন করেন যে, মনে হয় নারী-পুরুষ ভিন্নভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা; একে অপরের প্রতিপক্ষ। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। বস্তুত, পুরুষ-নারীতে যে প্রীতির সম্পর্ক তা পুরুষে-পুরুষে বা নারীতে-নারীতে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। নারী-পুরুষের অকৃত্রিম ভালবাসা ও প্রীতিই মানবসভ্যতা এবং সৃষ্টির ধারাবাহিকতার রক্ষাকবজ। এর ব্যত্যয় ঘটলে সভ্যতা ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠবে। একথা মনে রাখা উচিত যে, আমরা তো আমাদের পিতামাতার ভালবাসার ফসল; যুদ্ধবিগ্রহের নয়। তাই সমঅধিকারের কথা বলে পুরুষ ও নারীকে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করানো সমাজ-সভ্যতার জন্য মারাত্মক হুমকী। অবশ্য কোন কোন ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। আর ব্যতিক্রম কখনো ঐহিত্য নয়, হতে পারে না।
একথাও অস্বীকার করা যাবে না যে, আমাদের এ ক্ষয়িষ্ণু সমাজে কোন কোন ক্ষেত্রে নারীরা নানাবিধ বৈষম্য ও প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছেন। সামাজিক অন্যায়, উৎপীড়ন, লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। পারিবারিক পরিমণ্ডলে দৃশ্য-অদৃশ্য, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য শত অবমাননা, নিপীড়ন-নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। সীমিত পরিসরে হলেও পুরুষদের ক্ষেত্রেও এধরনের বৈষম্যের অভিযোগ রয়েছে। এসব সমস্যা নারী-পুরুষের সমঅধিকার থিউরীর মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব নয় বরং এজন্য আমাদেরকে দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন আনতে হবে।
মূলত, পাশ্চাত্যে নারী প্রগতির প্রধান ধারণা এসেছিল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও চার্চের পক্ষ থেকে। রেনেসাঁ পরবর্তী ব্যক্তি স্বতন্ত্রবাদ, অষ্টাদশ শতাব্দীর যুক্তিবাদ এবং উদার নৈতিকতার পরিপ্রেক্ষিতে পাশ্চাত্য লোকাচারের প্রভাব ছিল কম। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে নারী প্রগতির প্রধান বাধা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থেকে না আসলেও এক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদাসীনতাও কম দায়ী নয়। কেউ কেউ নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীকে প্রধান অন্তরায় মনে করলেও বাস্তবতার সাথে তা মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয় বরং ধর্মীয় জ্ঞানের অপ্রতুলতা, কুপমণ্ডুকতা, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, ধর্মের অপব্যাখ্যা ও অপ্রয়োগই এজন্য প্রধানত দায়ী করা যেতে পারে।
মূলত, মাত্রাতিরিক্ত অবক্ষয়, মূল্যবোধের বিচ্যুতির কারণেই আমাদের সমাজে নারীরা অধিকার বঞ্চিত, অবহেলিত ও উপেক্ষিত। নারী-পুরুষের সমঅধিকারের পক্ষে কথা বলা হলেও এক্ষেত্রে নায্য অধিকারের ধারণাটাই অধিক যুক্তিযুক্ত। তাই একথা বললে অত্যুক্তি হবার কথা নয় যে, নারী-পুরুষ কর্মে, দায়িত্বে ও অভিজ্ঞানে কেউই কারো সমকক্ষ নয় বরং তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে একে অপরের চেয়ে শ্রেয়তর। নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে যে সৃষ্টিগত তারতম্য ও তফাৎ রয়েছে তা কোনভাবেই সমান্তরাল করা যাবে না। কেউ কেউ নারী ও পুরুষকে পরস্পরের সমকক্ষ করার জন্য উভলৈঙ্গিক পোশাকের দাবি তুলেছেন তাও রীতিমত হাস্যকর ও বিভ্রান্তিমূলক। আপেল-কমলা উভয়ইটিই ফল হলেও ‘ফল’ শিরোনাম দিয়ে একই মোড়কে রাখলেও ফল দু’টির স্বাদ, গন্ধ ও খাদ্যপ্রাণ এক ও অভিন্ন হয়ে যায় না। যেমনিভাবে উভলৈঙ্গিক পোশাক দিয়ে নারী-পুরুষের সৃষ্টিগত তারতম্য একাকার করাও সম্ভব নয়, ঠিক তেমনিভাবে সমঅধিকারের কথা বলে ডাঙার প্রাণীকে পানিতে নামিয়ে, পানির মাছকে ডাঙায় তুলে বাঁচানোও সম্ভব নয়। মূলত, এটিই হচ্ছে বাস্তবতা।
মহল বিশেষ ধর্ম ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রধান অন্তরায় বলে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। কিন্তু নিরপেক্ষ বিশ্লেষণে তা যৌক্তিক বলে মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে বিংশ শতকে ধর্মীয় বিশেষ করে ইসলামী স্কলারগণ নারী অধিকার নিয়ে ইসলামের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন এবং পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও নিজ নিজ ক্ষেত্রে সমান্তরাল এবং একে অপরের পরিপূরক ও সহায়ক তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। একথা বলা ঠিক হবে না যে, নারীরা তাদের অধিকার যথাযথভাবে ভোগ করতে পারছেন। তবে নারীর ক্ষমতায়ন, রাজনীতি, চাকরি-বাকরিতে নারীরা ব্যাপকভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে যেসব অভিযোগ রয়েছে তা পুরোপুরি সত্য নয় বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোটা সংরক্ষণ ও নানাবিধ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারণে তারা ক্ষেত্র বিশেষে পুরুষের চাইতে অধিক সুবিধাভোগী। কিন্তু প্রশ্ন রয়েছে পারিবারিক জীবন নিয়ে। অভিযোগ রয়েছে নারীরা পারিবারিকভাবে নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। দাম্পত্যসঙ্গীদের কাছে জবাবদিহিতা ও অধিনস্ততাকে মহল বিশেষে বৈষম্য বলে বিবেচনা করা হয়। আর এটিও কোন যৌক্তিক কথা নয়। কারণ, মানুষ কখনোই জবাবদিহিতার উর্ধ্বে নয়। একজন নারী শুধুু পারিবারিক পরিসরেই জবাবদিহিতা করেন। কিন্তু একজন পুরুষের জবাবদিহিতার ক্ষেত্র আরো বহুমাত্রিক। আমাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী পরিবারের অর্থনৈতিক দায়িত্ব থাকার কারণেই পুরুষ পরিবার প্রধান। তিনি হন তার সঙ্গীনির চেয়ে জ্যেষ্ঠ, অধিকতর যোগ্য ও দায়িত্বপরায়ন। তাই পারিবারিক শৃঙ্খলা ও শিষ্টাচারের জন্য একজন পুরুষ নারীর চেয়ে প্রাধান্য পাওয়ার যোগ্য। অবশ্য তাও শুধুই প্রতীকী। প্রভূ-ভৃত্য পর্যায়ের নয় বরং প্রীতি ও সম্মানের। একথা স্মরণ রাখা উচিত তারা কারো কন্যা, কারো জায়া; আবার কারো জননীও।
আমাদের সমাজে নারীরা পরিপূর্ণ অধিকার ভোগ করছে একথা বলা যাবে না। অনেক ক্ষেত্রেই তারা নানাবিধ বৈষম্য ও প্রতিকূলতার শিকার হয়ে থাকেন। আর তা আইন করে সমাধান করা যাবে না বরং এজন্য আমাদেরকে অবশ্যই দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টাতে হবে। মনে রাখতে হবে নারীরা পুরুষের মতই মানুষ; একই শ্রষ্টার সৃষ্টি। উভয়ই স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বীয় দায়িত্ব পালনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। তাই নারীকে পারিবারিক পরিসরে ক্রীতদাসী মনে করার সুযোগ নেই বরং পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। পুরুষদের মাথাব্যথা হলে যেমন কিছু একটা আশা করা হয়; ঠিক তেমনিভাবে সকলকে একথাও স্মরণ রাখা দরকার নারীরা কিন্তু মস্তকবিহীন মানবী নন। মাথাব্যথা তাদেরও হতে পারে। তাই আসুন দৃষ্টিভঙ্গী বদলাই; বিশ্বই বদলে যাবে। অধিকার আদায়ে লড়াই-সংগ্রামের প্রয়োজন হবে না!