বাংলাদেশে যতগুলো সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে মানবপাচার (Human Trafficking) অন্যতম। মানবপাচার বলতে সাধারণত বোঝায়- অবৈধভাবে মানুষ কেনাবেচা করা কিংবা মিথ্যা আশ্বাস, প্রলোভন দেখিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া অথবা বিক্রি করে দেওয়া। এটি গুরুতর অপরাধ। পাচার হওয়া মানুষদের বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে নারীদের জোর করে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়। পুরুষ ও নারীদের দিয়ে কারখানা বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কম মজুরিতে বা বিনা মজুরিতে কাজ করানো হয়। কাউকে দাস বানিয়ে রাখা হয় এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করানো হয়। এ সমস্যা শুধুমাত্র একটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিদ্যমান। সাগরপথে অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি দেয়ার তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। এর অন্যতম কারণ দরিদ্র ও বেকারের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়া। গত ১০ বছরে দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা সাড়ে ২৪ শতাংশ বেড়েছে। প্রতিবছর উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক লাখ শিক্ষার্থী পাশ করে বের হলেও সে তুলনায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। বর্তমানে শ্রমবাজারে ২৬-২৮ লাখ কর্মক্ষম বেকার রয়েছেন।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। অনেকে উন্নত জীবনের আশায় অবৈধভাবে ইউরোপের পথে পা বাড়াচ্ছেন। যেনতেন উপায়ে হঠাৎ বড়লোক হওয়ার স্বপ্নে ছোট নৌকায় উত্তাল ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে কেউ প্রাণ হারাচ্ছেন, আবার কেউ লিবীয় পাচারকারী চক্রের হাতে নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বিদেশে যাওয়া মানুষের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ মাইগ্রেশন এবং ট্রাফিকিং এর পার্থক্য বোঝেন। অধিকাংশই বুঝতেই পারেন না যে তারা পাচারের শিকার হচ্ছেন। তাদের কাছে বিদেশে যাওয়া মানেই সোনার হরিণ পাওয়া। অথচ সামান্য ভুলের কারণে অনেকের জীবনের আলো নিভে যায়, পরিবারের ভিটেমাটি হারিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়। কিন্তু এ বিষয়গুলো তাদের কাছে মূখ্য বিষয় নয়; বরং বিদেশে যাওয়াটাই যেন সব। এ প্রবণতা জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করা প্রয়োজন। কারণ মানবপাচার কোনো সীমান্ত চেনে না- এটি বৈশ্বিক অভিশাপ।
ভূমধ্যসাগর ‘স্বপ্নের মৃত্যু সাগর হিসেবে’ পরিচিত। ২০১৫ সালের সমুদ্রপথে লিবিয়া যাওয়ার পথে ২৪ জন বাংলাদেশীসহ ১১৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০১৮ সালের অক্টোবরে মেক্সিকোর দুর্গম গহীন জঙ্গলে ২০০ জনের বেশি বাংলাদেশীকে আটক করা হয়েছিল। কাজের সন্ধানে অবৈধ পথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁরা মেক্সিকোর জঙ্গলের পথে পাড়ি দিয়েছিল। ২০১৯ সালে উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়ার উপকূলে ভয়াবহ নৌকাডুবির ঘটনায় ৭০ জন মানুষের সলিল সমাধি হয়েছিল। তবে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) বলেছিল এ ঘটনায় অন্তত ৫০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এ মর্মান্তিক ঘটনায় ৩৭ জন বাংলাদেশীও প্রাণ হারিয়েছিল। এ মৃত্যু বিশ্বের বিবেকবান মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছিল। কিন্তু শিক্ষা নেয়নি কেউ।
ইউরোপে যাওয়া অন্যায় নয়, অপরাধও নয়। কিন্তু অবৈধভাবে যাওয়া অপরাধ। মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ এর দ্বিতীয় অধ্যায়ে মানবপাচার ও সংশ্লিষ্ট অপরাধসমূহ সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর একাধিক সদস্য গোষ্ঠীর সকল সদস্যের সাধারণ অভিপ্রায় সাধনের উদ্দেশ্যে কোন আর্থিক বা অন্য কোনো বস্তুগত বা অবস্তুগত মুনাফা অর্জনের নিমিত্ত এ আইনের অধীন কোন অপরাধ সংঘটন করিলে উক্ত গোষ্ঠীর প্রত্যেক সদস্য উক্ত অপরাধ সংঘটনের দায়ে অভিযুক্ত হবে এবং অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা অন্যূন ৭ (সাত) বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে এবং অন্যূন ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। তবে আইনে কঠোর শাস্তির বিধান থাকলেও মানবপাচার থামছে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে ২০১৯ সাল থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মানবপাচার আইনে মামলার সংখ্যা ৪,৫৯৬টি। এর মধ্যে সাজা হয়েছে মাত্র ৫৪টিতে। বাকিগুলো তদন্তাধীন বা বিচারাধীন অবস্থায় ঝুলে আছে। এখন পর্যন্ত কেবল ২৪ জন পাচারকারী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছেন। অপরদিকে ৮৪৮ টি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন এবং ৯০২টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। বছরভিত্তিক মামলার পরিংখ্যান বিশ্লেষণে বলা হয় ২০১৯ সালে ৬৮৫, ২০২০ সালে ৫৩৮, ২০২১ সালে ৫৯৯, ২০২২ সালে ৬৯৭, ২০২৩ সালে ৮৫১, ২০২৪ সালে ১১৩৫ এবং ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ৯১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ পরিসংখ্যান হয়ত কারও কারও কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে! কিন্তু সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমটিই জানিয়েছে।
অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়া অনেকেই নিপীড়ন, দাসত্ব ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন। বিশেষ করে নারীরা বাসাবাড়ির কাজের প্রলোভনে বিদেশে গিয়ে যৌন ব্যবসায় বাধ্য হচ্ছেন। অধিকাংশকে লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দি রেখে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। মর্মান্তিক খবরগুলো পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হলেও জনসচেতনতা দৃশ্যমান নয়। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সাগরপথে প্রায় ৯২ হাজার বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেছেন, যাদের বেশিরভাগের বয়স ২৫-৪০ বছর। মাদারীপুর, সিলেট, শরীয়তপুর, সুনামগঞ্জসহ বাংলাদেশের অন্তত ১০-১২ টি জেলার লোকজন অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার জন্য মরিয়া। প্রতারিত বা নির্যাতনের শিকার মানুষগুলো দেশে ফিরে মামলা করলেও মূল পাচারকারীরা অনেক সময় ধরা- ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবপাচার মামলাসংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৪ সালেই মানবপাচার আইনে ১০৩৪টি নতুন মামলা হয়েছে; পুরোনো মামলাসহ মোট মামলা দাঁড়িয়েছে সাড়ে চার হাজারের বেশি।
প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা গেলে মানবপাচারের ফাঁদ থেকে কিছু মানুষকে সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হবে। বিদেশের মাটিতে কাজ করে যারা দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন তারা রেমিট্যান্স যোদ্ধা। এ রেমিট্যান্স যোদ্ধারা হেরে গেলে, হেরে যাবে দেশ। দেশের অর্থনীতির চাকাকে প্রবাসীরাই সচল রেখেছে। তারা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের প্রবৃদ্ধি বজায় রাখছেন। এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের শাসনামলে ২০২০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১০৩১টি নতুন রিক্রুটিং এজেন্সি অনুমোদন পেয়েছে- যা আগের ৩০ বছরের অনুমোদনের সংখ্যার চেয়ে বেশি। এ অনুমোদনের সুফল প্রবাসীরা পাননি; বরং তাদের ভাগ্যে লাঞ্ছনা আর নিপীড়ন জুটেছে। এর সুফল আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ভোগ করেছে। প্রবাসে কর্মী পাঠানোর নামে তারা লুটপাট করেছেন।
প্রতি বছর ৩০ জুলাই ‘বিশ্ব মানবপাচার প্রতিরোধ দিবস’ পালিত হয়। জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০১৩ সাল থেকে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ দিবস উপলক্ষে নানা সেমিনার, কর্মসূচি-সিম্পোজিয়াম ও আলোচনা সভা হলেও পাচার থামছে না। প্রতিবছরই পাচারের শিকার হচ্ছে মানুষ। পাচারের শিকার বহু মানুষ দাসত্বের জীবন পার করছে। অনেকে ভিটেমাটি হারিয়ে পথে বসছে। পাচারকারীরা এখন সাগরপথ ছাড়াও ভিজিট ভিসার মাধ্যমে মানুষ পাচার করছে। অর্থাৎ মানবপাচার প্রতিরোধ দিবস শুধু কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ। একটি আধুনিক রাষ্ট্র যখন কর্মসংস্থান, কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য, শ্রমিকের মজুরি, যুবকের চাকরির সুযোগ দিতে ব্যর্থ হয়- তখন মানুষ অবৈধ পথে বিদেশে যেতে বাধ্য হয়। যাদের রেমিট্যান্সে দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ে, সে প্রবাসীরা যখন দেশে ফেরে লাশ হয়ে, তখন বিমানবন্দরের কফিনের সারি নির্বিকার রাষ্ট্রের বিবেককে ধিক্কার জানায় পাশাপাশি ব্যর্থতার জ¦লন্ত দলিল হয়ে দাঁড়ায়। মানবপাচার বন্ধ করতে হলে আইনের কঠোর প্রয়োগ, জনসচেতনা ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন অভিবাসনের নামে মানবপাচারের রুট চিরতরে বন্ধ করা, যেন মানবপাচার করার সাহস কেউ না দেখায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক।