জালাল উদ্দিন ওমর

১৯৪৭ সালে বৃটেন থেকে স্বাধীন হবার পর হতেই কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। দেশ দুটির মধ্যে একাধিকবার যুদ্ধ হয়, যাতে অনেক মানুষ মারা যায়। দেশ দুটির মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র হলে উপমহাদেশ জুড়েই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং যুদ্ধের আশংকা দেখা দেয়। এতদঞ্চলের মানুষ আতংকিত এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। ভারত এবং পাকিস্তান উভয়েই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হওয়ায় তাদের দ্বন্দ্ব সংঘাতে দুশ্চিন্তা এবং আতংক বহুগুণে বেড়ে যায়। যুদ্ধে দেশ দুটি পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার করলে ভারত পাকিস্তানের জনপদসমূহ হিরোশিমা, নাগাসাকির মত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। মুহূর্তেই মারা পড়বে কয়েক কোটি মানুষ। সবকিছুই পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। ভারত এবং পাকিস্তানের নেতাদের প্রতি অনুরোধ, যুদ্ধের পথে না হেঁটে শান্তির পথে হাটুন। যুদ্ধের হুমকি না দিয়ে শান্তির কথা বলুন। যুদ্ধের মাঠে খেলতে না নেমে আলোচনার টেবিলে বসুন। প্রত্যেকেই অপরকে তার ন্যায্য অধিকার প্রদান করলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তখন দ্বন্দ্ব সংঘাত থাকবে না।

ভারত-পাকিস্তান নিকট প্রতিবেশী। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ভারত এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাকিস্তানের সৃষ্টি। আয়তন, জনসংখ্যা এবং সামরিক শক্তির মাপকাঠিতে ভারত শক্তিশালী এবং বড় দেশ। অপরদিকে পাকিস্তান ছোট দেশ। কিন্তু পাকিস্তানের হাতে থাকা পারমাণবিক অস্ত্র সামরিক শক্তিকে ব্যালান্স করেছে। ফলে পাকিস্তানকে অবজ্ঞা করার সুযোগ এখন ভারতের নেই। সাম্প্রতিক যুদ্ধে এ সত্যটি সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত হয়েছে। দেশ দুটি প্রতিযোগিতা করে সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে। উভয় দেশই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হয়েছে, পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে এবং এর মজুদ বাড়িয়ে চলছে। দুটি দেশই কিছুদিন পর পর পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। তারা সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনীর সংখ্যা বাড়াচ্ছে এবং প্রতিনিয়তই এসব বাহিনীতে ট্যাংক, যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন এবং সাবমেরিনসহ ভয়ানক সব মরণাস্ত্র যুক্ত করছে। উভয় দেশই প্রতিবছর বাজেটের বিরাট অংশ সামরিক খাতে ব্যয় করে। অথচ দেশ দুটির অর্ধেক জনগোষ্ঠী অশিক্ষা, দারিদ্রতা, পুষ্টিহীনতার শিকার এবং বিশাল জনগোষ্ঠী দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে।

১৯৪৭ সালের ২২ শে অক্টোবর কাশ্মীরের তৎকালীন রাজা হরি সিং কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে। ভারত-পাকিস্তান উভয়েই কাশ্মীরকে তাদের অংশ দাবী করে। ১৯৪৮ সালের ১৩ আগস্ট জাতিসংঘে গৃহীত ৪৭ নং প্রস্তাবে গণভোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের কথা বলা হয়। কিন্তু সে গণভোট এখনো অনুষ্ঠিত হয়নি। কাশ্মীরের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে ভারতের কাছ থেকে স্বাধীনতার জন্য লড়ছে। ভারত কাশ্মীরী জনগণের স্বাধীনতার আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা হিসাবে অভিহিত এবং এতে সমর্থন দানের জন্য পাকিস্তানকে দোষারোপ করে আসছে। কাশ্মীরীদের আন্দোলনকে দমন করতে ভারত বরাবরই কঠোর নীতি গ্রহণ করেছে। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারত সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে বর্ণিত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে। ভারত কাশ্মীরে প্রায় আট লাখ সেনা মোতায়েন করেছে। পাকিস্তান ঘোষণা করেছে, তারা কাশ্মীরী জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাবে। দেশ দুটি পর¯পরের বিরুদ্ধে আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ করে এবং উভয়েই তা অস্বীকার করে। সীমান্তে দেশ দুটির সেনাবাহিনীর মধ্যে গোলাগুলী চলে, যাতে সৈনিকসহ নিরপরাধ মানুষ মারা যায়। দুদিন পরে পতাকা বৈঠক এবং শান্তির প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়। নিরাপদ জীবনের আশায় মানুষ বুধ বাঁধে। কিছুদিন পর দেশ দুটি আবারো দ্বন্দ্বে জড়ায় এবং উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সীমান্ত এলাকার মানুষের জীবনে আবারো বিপর্যয় নেমে আসে। আতংক, ভয় এবং দুশ্চিন্তা গ্রাস করে। ভারত পাকিস্তানের দ্বন্দ্বের চাকায় প্রায় আশি বছর ধরে এভাবে পিষ্ট হচ্ছে সীমান্ত এলাকার নিরপরাধ মানুষ।

কাশ্মীর ইস্যুই ভারত পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বন্দ্বের মূল কারণ। কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের মাঝেই তাই দেশ দুটির মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসনের মূল চাবিকাঠি নিহিত রয়েছে। তাদের উচিত দ্বন্দ্ব, সংঘাত এবং শত্রুতা জিইয়ে না রেখে তা সমাধান করে স্থায়ীভাবে শান্তি, সম্প্রীতি এবং বন্ধুত্বের পথে চলা। তার জন্য কাশ্মীরের ভাগ্য কাশ্মীরী জনগণের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে। কাশ্মীরী জনগণ ভারতের সাথে থাকবে, নাকি পাকিস্তানের সাথে থাকবে, নাকি আলাদা স্বাধীন দেশ হিসাবে থাকবে, তা কাশ্মীরী জনগণের ওপর ছেড়ে দেয়া হোক। এটা তাদের ন্যায্য এবং বৈধ অধিকার। জাতিসংঘ ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকার সনদে এ অধিকারের স্বীকৃত দেয়া হয়েছে। কাশ্মীরে গণভোটের আয়োজন করে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হউক। গণভোটের আয়োজন করে পৃথিবীর অনেক ভূখণ্ডের অধিবাসীরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেছে। পূর্ব তীমুরে ১৯৯৯ সালের ৩০ আগস্ট স্বাধীনতার জন্য গণভোট অনুষ্ঠিত হয় যাতে জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়। ভোটের ফলাফল অনুসারে পূর্ব তীমুর ইন্দোনেশিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং বর্তমানে পূর্ব তীমুর স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এর মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়া এবং পূর্ব তীমুর উভয় ভূখণ্ডে শান্তি ফিরে এসেছে। দক্ষিণ সুদানে ২০১১ সালের ০৯-১৫ জানুয়ারী স্বাধীনতার জন্য গণভোট অনুষ্ঠিত হয় যাতে জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়। ভোটের ফলাফল অনুযায়ী দক্ষিণ সুদান, সুদান থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং বর্তমানে দক্ষিণ সুদান স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। এর মাধ্যমে এতদঞ্চলে শান্তি ফিরে এসেছে।

স্কটল্যান্ডে ২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর স্বাধীনতার জন্য গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু স্কটল্যান্ডের বেশির ভাগ জনগণ স্বাধীন না হয়ে বৃটেনের সাথে থাকার পক্ষেই ভোট দিয়েছে। ফলে স্বটল্যান্ড বৃটেনের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ গণভোটের মাধ্যমে স্কটল্যান্ডের জণগণের অমিমাংসিত বিষয়ের সমাধান হয়েছে। ফলে স্কটল্যান্ডেও শান্তি ফিরে এসেছে। পূর্ব তীমুর, দক্ষিণ সুদান এবং স্কটল্যান্ডের মত কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের বিষয়টিও কাশ্মীরী জনগণের ওপর ছেড়ে দেয়া হউক। এর মাধ্যমে কাশ্মীর বিষয়ে স্থায়ী সমাধান বেরিয়ে আসবে। ভারতকে এ বাস্তবতা মানতেই হবে। ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে পুরো উপমহাদেশের মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং সার্ক অকার্যকর সংস্থায় পরিণত হয়েছে। এ দ্বন্দ্বকে চিরতরে বন্ধ করে শান্তির সুবাতাস সূচিত করতে হবে। মানবজাতির শান্তির জন্যই তা একান্ত প্রয়োজন।

লেখক : ব্যাংকার।