ইতিহাসে আমাদের মত এতো চড়ামূল্য দিয়ে বিশ্বের অন্যকোন জাতিই স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জন করেনি। মূলত, ঊনিশ শ একাত্তর সালে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা এক ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করেছি। আমরাই সে গৌরবান্বিত জাতি,যে জাতি ২৪ বছরের রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের পর রণাঙ্গনে শত্রুপক্ষকে পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছে।কিন্তু জাতীয় শ্রেণি বিশেষের অবৈধ ক্ষমতালিপ্সা, রাজনৈতিক বিভাজন, অনৈক্য, অস্থিতিশীলতা ও নেতিবাচক রাজনীতির কারণে আমাদের বিজয়ের স্বপ্নগুলো আজও অনেকটাই অধরা রয়ে গেছে। ফলে স্বাধীনতার সুফলগুলো আমার পুরোপুরি ঘরে তুলতে পারিনি।
আমাদের স্বাধীনতা এখন অর্ধশতাব্দীর গণ্ডি পেরিয়েছে। যা খুব দীর্ঘ সময় না হলেও একটি জাতির উন্নয়ন-অগ্রগতির জন্য এটি নেহায়েত কম সময় নয়। কিন্তু যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, তা কতটা অর্জিত হয়েছে-সে প্রশ্নের আজও মিমাংসা করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য ছিল সব ধরনের অধীনতা থেকে মুক্তি এবং সমাজে গণতন্ত্র, ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠা। কিন্তু স্বাধীনতা ও মহান বিজয়ের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় সে লক্ষ্যে পৌঁছতে খুব একটা সফলতা দেখাতে পারিনি। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রতিষ্ঠিত সংসদীয় ব্যবস্থাকেও আমরা সংহত করতে পরিনি। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ আর্থসামাজিক সূচকে আমরা কিছুটা এগিয়ে গেলেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসেনি আমাদের দেশে।
বস্তুত, যেসব কারণে আমরা পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ি এবং সে অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মুক্তিসংগ্রামে অবতীর্ণ হই মূলত সেগুলোই হচ্ছে স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। কিন্তু আমাদের ক্ষয়িষ্ণু ও গন্তব্যহীন রাজনীতির কারণেই এতে বিচ্যুতি ঘটেছে। এখন শ্রেণি বিশেষের স্বার্থ রক্ষার অনুসঙ্গগুলোকে স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে একাকার করে ফেলা হয়েছে। যা আমাদের মহান বিজয়ের অর্জনগুলোকে ম্লান করে দিচ্ছে।
স্বাধীনতার চেতনার ক্ষেত্রে প্রথম যা বিবেচ্য তা হচ্ছে আমাদের নিজস্ব স্বাতন্ত্র রক্ষার প্রশ্ন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের আত্মত্যাগ এবং উর্দুর সমান্তরালে বাংলা ভাষাকেও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি আদায় এর দৃশ্যমান উদাহরণ। বস্তুত ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই আমাদের স্বাধীকারের চেতনার উম্মেষ ঘটে এবং ১৯৭১ সালে তা ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়ে মুক্তিসংগ্রাম এবং বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পথকে সুগম করেছে।
স্বাধীনতার উন্নতম চেতনার একটি হলো বৈষম্যের অবসান। পশ্চিমী শাসকচক্র আমাদেরকে সরকারি দায়িত্বপূর্ণ পদ ও কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন করেছে শুরু থেকেই। তাদের পক্ষপাতমূলক আচরণ, অবিচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ ও বঞ্চনার ফলশ্রুতিতেই আমাদের স্বাধীনতার চেতনার উম্মেষ ঘটে। ফলে পূর্ব পাকিস্তানীদের মধ্যে একটা গণঅসন্তষ্টির সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতা অনিবার্য হয়ে উঠে। ১৯৭১ সালের মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে তা সফলতা লাভ করে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ ও লালন করে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুরাষ্ট্রের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। অর্থাৎ বাংলাদেশের জনগণের নিজেদের শাসন করার অধিকারসহ একটি সার্বভৌম ভূখণ্ড, যেখানে বাংলাদেশীরা নিজেদের বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা নিয়ে সব ধরনের বৈষম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচার পরিপন্থী কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও তার ভিত্তিতে সৃষ্ট বাংলাদেশের দু’টি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-
প্রথম, বাংলাদেশ হবে জনগণের এবং জনগণের দ্বারা পরিচালিত দেশ। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ হবে সব ধরনের বৈষম্যমুক্ত, অন্যায়, অবিচার ও শোষণমুক্ত; অর্থাৎ সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আমাদের সংবিধানেও এ চেতনার উপস্থিতিও বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। সংবিধানের প্রস্তাবনার তৃতীয় প্যারায় বলা হয়েছে, ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে’। অনুচ্ছেদ ১-এ বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যাহা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হইবে। ৭ অনুচ্ছেদের দফা-১ এ বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্ব কার্যকর হইবে।’
সাংবিধানিকভাবেই বাংলাদেশ জনগণের রাষ্ট্র; জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক; তারা নিজের দেশ নিজেরাই শাসন করার অধিকার সংরক্ষণ করে। তাই সংবিধান অনুযায়ী জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করার বিষয়ে ক্ষমতাবান। এ প্রতিনিধিদের একটি অংশ তাদের হয়ে ক্ষমতা প্রয়োগ করে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে। অন্য অংশ জনগণের হয়ে সংসদের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার কার্যক্রমের ভুলত্রুটি তুলে ধরে শাসকদের জবাবদিহির আওতায় আনবে। জনগণ এ প্রক্রিয়া শুধু সরকার গঠনে নয়, তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণে সক্ষম হবে।
এ পদ্ধতিকে কার্যকর ও ফলপ্রসূত করার জন্য অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হলো অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি নির্বাচন। এর পরপরই প্রয়োজন কার্যকর সংসদ; যেখানে একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতির আবশ্যকতাও অনস্বীকার্য। বস্তুত, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রাধান্য লাভ করে এবং সম্পদের সুষম বণ্টন; অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নিষ্পেষণ হ্রাস পায়; মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থানটা একেবারেই তলানীতে।
গণতন্ত্রকে সুসংহত করে একটি শোষণ ও বঞ্চনামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা। কিন্তু একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা বাঞ্চনীয় অনেক ক্ষেত্রেই তার বিচ্যুতিটা রীতিমত চোখে পড়ার মত। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে শাসনকার্যে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগের বিষয়টি এখনও প্রশ্নমুক্ত হয়নি। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে আমাদের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তো বিকশিত হতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য বৈষম্যমুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নিষ্পেষণমুক্ত সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক বাংলাদেশ। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আমাদের তেমন অর্জন নেই। এমনকি পতিত আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনে এর শেষ নিশানাটুকুও ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ফলে মুক্তিসংগ্রাম ও মহান বিজয়ের সুফলগুলো আমরা পুরোপুরি করায়ত্ব করতে পারিনি।
স্বাধীনতা অর্জন কোন ক্ষেত্রেই তা সহজলভ্য হয় না। কিন্তু স্থান, কাল ও পাত্রভেদে এ অর্জনের প্রেক্ষাপটটা আলাদা হয়ে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফলস্বরূপ অটোমান সাম্রাজ্য এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সম্রাজ্য থেকে ৭০ টি নতুন রাষ্ট্র স্বাধীনতা পায়। ফরাসি বিপ্লব ও আমেরিকান বিপ্লবের একই পরিণতি দেখা গেছে। ফরাসিরা রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে সাম্য-মৈত্রী-ভ্রাতৃত্বের আদর্শের ভিত্তিতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি। অল্প দিনের মধ্যেই দেখা গেছে পরাজিত ফরাসি সামন্তবাদী শক্তি ও কায়েমী স্বার্থবাদীরা আবার রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে প্রজাতন্ত্র নামের আড়ালেই। নেপোলিয়ন তো ক্ষমতা দখলের পর নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেছিলেন। আমেরিকার স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল ‘জনগণের জন্য জনগণ কর্তৃক সরকার’ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ট্রুম্যান, বুশ, ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেনের সরকার ব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে মনে হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে স্থির থাকতে পারেনি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের বিচ্যুতিটা অপরাপর জাতি-রাষ্ট্রের তুলনায় শুধু প্রবলই নয় বরং রীতিমত উদ্বেগজনক।
বস্তুত, ব্যক্তিস্বাধীনতায় রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতাকে অর্থবহ ও ছন্দময় করে তোলে। কোন দেশের নাগরিকরা যখন নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ভোগ করেন তখন রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতাও মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। এক্ষেত্রে নাগরিকরাই স্বাধীনতা সচেতন ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার রক্ষক হয়ে ওঠে। আর ব্যক্তিস্বাধীনতা (Civil liberty) হল ব্যক্তিগত অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা যা সরকার সাধারণত নির্ধারিত প্রক্রিয়া ব্যতীত আইন বা বিচারিক প্রক্রিয়া প্রয়োগ করে খর্ব করতে পারে না। যদিও ব্যাক্তিস্বাধীনতার ব্যাপ্তি রাষ্ট্রভেদে ভিন্ন হতে পারে।
তবুও মোটামোটি যে জিনিসগুলো ব্যক্তিস্বাধীনতার আওতায় পড়ে সেগুলো হল, নির্যাতন থেকে বাঁচার অধিকার, বাস্তুচ্যুত হওয়া থেকে বাঁচার অধিকার, আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার, গণমাধ্যমের সহায়তা পাওয়ার অধিকার, নিজ নিজ ধর্ম পালন ও প্রচারের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার অধিকার, নিজস্ব গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার, আইনের সুবিধা লাভের অধিকার, নিরপেক্ষ আদালতে বিচার পাবার অধিকার এবং জীবন বাঁচানোর অধিকার। অধ্যাপক লাস্কি স্বাধীনতার সংজ্ঞা দিয়ে বলেন, ‘By liberty I mean the eager maintenance of the atmosphere in which men have the opportunity to be their best selves.’ অর্থাৎ স্বাধীনতা বলতে আমি সে পরিবেশের সাগ্রহ সংরক্ষণ বুুঝি, যা দ্বারা মানুষ তার শ্রেষ্ঠ সত্তা উপলদ্ধি করার সুযোগ পায়।
বস্তুত, স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হলো একটি অবস্তুগত বৈধ সত্ত্বা, যা একটি সরকার কর্তৃক শাসিত এবং যার একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে সার্বভৌমত্ব বিদ্যমান। যেখানে নাগরিকের সকল মৌলিক অধিকারের নিশ্চিয়তা প্রধান করা হয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ি, একটি স্থায়ী জনগোষ্ঠীর নির্দিষ্ট সীমানা, সরকার এবং অপর কোন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের যোগ্যতা থাকলে তাকে সার্বভৌম রাষ্ট্র বলা হয়। বস্তুত রাষ্ট্রের উদ্ভব তখনই ঘটে যখন মানুষ ধীরে ধীরে তাদের আনুগত্য কোনো ব্যক্তিক সার্বভৌমত্ব থেকে রাষ্ট্র নামক একটি অস্পৃশ্য কিন্তু স্থানিক রাজনৈতিক সত্তার প্রতি স্থানান্তরিত করে। আর সে রাজনৈতিক স্বত্ত্বা রাষ্ট্রের অখন্ডতা, নিরাপত্তা ও নাগরিকের সকল বৈধ ও সঙ্গত অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করতে সমর্থ হয়।
সার্বভৌমত্ব এমন একটি প্রত্যয় যার প্রায়শই অপব্যবহারও হয়। যেমনটা হচ্ছে আমাদের দেশের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। আমাদের চলমান অসহিষ্ণু ও ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ রাজনীতিই এ জন্য প্রধানত দায়ি। কিন্তু এমনটা কখনোই কাক্সিক্ষত ছিল না। একথা সত্য যে, বিশ্বের কতিপয় মানুষের জীবন ছিল অসভ্য এবং সমাজকাঠামো ছিল অসংগঠিত, এটা নির্ণয়ের জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘সভ্যতার মান’ এর বিচ্ছিন্ন ধারণাটি বিস্তার লাভ করে। ধারণাটি এ বিশ্বাসে গঠিত হয়েছিল যে, হয় তাদের ‘সার্বভৌমত্ব’ সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত ছিল, না হয় ‘সভ্য’ মানুষের তুলনায় একেবারে নিকৃষ্ট ছিল।
লাসা ওপেন হেইমের ভাষায়, ‘সম্ভবত সার্বভৌমত্বের ধারণার মতো বিতর্কিত বিষয় আর কিছু নেই। এটি একটি অকাট্য সত্য যে, ধারণাটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে চালু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এর অর্থ বিষয়ে বিশ্বজনীন ঐকমত্যে পৌছানো সম্ভব হয়নি’। অস্ট্রেলিয়া উচ্চ আদালতের বিচারক এইচ ভি এভাট মত দেন, ‘সার্বভৌমত্ব নীতিগত প্রশ্ন বা আইনগত প্রশ্ন কোনটিই নয় বরং এটি এমন একটি প্রশ্ন যা উত্থিতই হয়না’। আর আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সার্বভৌমত্বের ধারণা ও প্রয়োগ নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা এবং অপপ্রয়োগ রীতিমত উদ্বেগজনক।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই আমাদের স্বাধীকারের মূলমন্ত্র। কিন্তু আমরা তা লালন করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার বৃত্তেই বৃত্তাবদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আজও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি বরং আওয়ামী ফ্যাসিবাদীদের প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পুরোপুরি ধবংস করে দিয়েছে। উদার গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন আমাদের সংবিধানের মৌলিক চেতনা হলেও এসবের বাস্তব প্রয়োগটা ফ্যাসিবাদী আমলে কল্পনার অতীত ছিলো। মূলত, আওয়ামী বাকশালীরা পুরো রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়ে দেশকে প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলো। যা স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও মহান বিজয়ের সাথে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মহাকবি মিল্টনের ভাষায়, ‘স্বাধীনতা মানুষের প্রথম এবং মহান একটি অধিকার’। কিন্তু স্বাধীনতাকে ফলপ্রসূ ও অর্থবহ করতে হলে একটি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক সমাজের আবশ্যকতার বিষয়টি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
থিউডোর পার্কারের ভাষায়, ‘চিন্তার স্বাধীনতা থাকবে, কথা বলার স্বাধীনতা থাকবে এবং উপসনার স্বাধীনতা থাকবে-এসবই গণতন্ত্রের আদর্শ’। কিন্তু মহল বিশেষের আত্মকেন্দ্রীক ও নেতিবাচক রাজনীতির কারণেই আমরা সে গন্তব্যে পৌঁছতে পারিনি। তবে গত বছরের জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে আমরা নতুন করে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। ফ্যাসিবাদী আমলের ধ্বংসস্তুপের ওপর অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে প্রাসাদ নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তুাব বাস্তবায়নের জন্য ইতোমধ্যেই প্রণীত জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছে। আর তা আইনগত ভিত্তি দেওয়ার জন্য গণভোট আয়োজনে গণভোট অধ্যাদেশও জারি করা হয়েছে।
দেশ ও জাতি আশা করছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ এক অধ্যায়ে পদার্পণ করবে। স্বাধীনতা ও বিজয়ের স্বপ্নগুলো আমাদের কাছে অধরা থাকবে না। এক স্বপ্নীল ও সোনালী প্রভাতের আমরা এখন স্বপ্নমগ্ন।
www.syedmasud.com