সোহেল মো. ফখরুদ-দীন
চট্টগ্রামের ইতিহাসে কালজয়ী মহাপুরুষ মাহবুব উল আলম। ইতিহাস রচনায়, সাংবাদিকতা, সাহিত্যে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। সাহিত্যের ইতিহাসেও ব্যতিক্রমী ও বহুমাত্রিক প্রতিভা ছিলেন মাহবুব-উল আলম। কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, সৈনিক, রম্যরচয়িতাÑএমন নানা পরিচয়ের বাইরে যেটি তাঁকে একটি স্থায়ী স্বীকৃতি দেয়, তা হলো একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে তাঁর অবদান। বিশেষত তিন খণ্ডে রচিত ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’ তাঁকে বাংলার আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার অগ্রদূতদের কাতারে স্থান দিয়েছে। ৭ আগস্ট ২০২৫, তাঁর ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা গভীর শ্রদ্ধা জানাই এ ইতিহাসস্রষ্টা সাহিত্যিককে, যিনি তাঁর কলমে নির্মাণ করেছেন ইতিহাস ও সাহিত্যের সংমিশ্রিত এক অনন্য পাঠভুবন।
মাহবুব-উল আলমের ইতিহাসচর্চা ছিল গভীর অনুসন্ধানভিত্তিক এবং প্রামাণ্য। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ইতিহাসগ্রন্থ চট্টগ্রামের ইতিহাস (প্রথম খণ্ড প্রকাশিত ১৯৪৭, পরবর্তী দুটি খণ্ড ১৯৫০ সালের মধ্যে) একাধারে দলিলভিত্তিক, ভাষাগতভাবে সাবলীল এবং পাঠযোগ্য। এ রচনায় তিনি শুধুমাত্র রাজনৈতিক বা বর্ণনামূলক ইতিহাস তুলে ধরেননি; তিনি তুলে ধরেছেন চট্টগ্রামের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্মীয় রীতিনীতি, বাণিজ্য, কৃষি, মানুষের জীবনধারা এবং স্থানীয় ইতিহাসের উপেক্ষিত অধ্যায়সমূহ। বাংলা ভাষায় আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এ এক বিরল উদাহরণ। উপমহাদেশে যখন ইতিহাস চর্চা ছিল রাজনীতি ও উপনিবেশবাদকেন্দ্রিক, তখন মাহবুব-উল আলম একজন স্থানিক ইতিহাসবিদ হিসেবে চট্টগ্রামের আদি-ঐতিহ্য, সামাজিক রূপান্তর এবং বাঙালির আত্মপরিচয়ের ভিত্তিগুলো তুলে ধরেন নিখুঁত অনুসন্ধান ও প্রাঞ্জল ভাষার মাধ্যমে। মাহবুব-উল আলমের ইতিহাস রচনার পদ্ধতি ছিল আধুনিক গবেষণার নিরিখে যথেষ্ট অগ্রসর। তিনি ইতিহাসকে শুধুমাত্র অতীতের ঘটনাবলি হিসেবে দেখেননি, বরং ইতিহাসকে সমাজ ও জাতির আত্ম-পরিচয়ের ধারক হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তিনি ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে প্রাচীন দলিল, স্থানীয় জনশ্রুতি, বিদেশি পর্যটকের বিবরণ এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন জনপদের মৌখিক ইতিহাসকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর লেখা থেকে বোঝা যায় যে তিনি কেবল তথ্য উপস্থাপন করেননি, বরং তথ্য বিশ্লেষণ করে ইতিহাসের গভীর অর্থ খোঁজার চেষ্টা করেছেন। এ দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে একজন ঐতিহাসিক নির্মাতা হিসেবে স্থান দিয়েছে।
যেহেতু মাহবুব-উল আলম প্রথমত একজন কথাসাহিত্যিক, তাই তাঁর ইতিহাসচর্চাও একধরনের সাহিত্যমূল্য অর্জন করেছে। তাঁর বর্ণনা কাঠামো ছিল সহজ, প্রাঞ্জল এবং গল্পের মতো করে সাজানো। পাঠক কখনো ক্লান্ত বোধ করেন না, বরং ইতিহাসের পাতায় পাতায় এক ধরনের সাহিত্যিক সৌন্দর্য আবিষ্কার করেন। ফলে চট্টগ্রামের ইতিহাস শুধু গবেষকদের জন্য নয়, সাধারণ পাঠকের কাছেও আকর্ষণীয় ও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। চট্টগ্রামের ইতিহাস রচনার পাশাপাশি মাহবুব-উল আলম ইতিহাসকে বৃহত্তর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দেখতে চেয়েছেন। স্বাধীনতার পর তিনি শুরু করেন বিশাল আকারের গবেষণা প্রকল্পÑবাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্তÑযেখানে তিনি সরেজমিন তথ্য সংগ্রহ করে ৪ খণ্ডে মুক্তিযুদ্ধের একটি দালিলিক ইতিহাস নির্মাণ করেন। এমন ইতিহাসপ্রেম ও গবেষণায় নিষ্ঠা তাঁকে ইতিহাসবিদ হিসেবে অসাধারণ মর্যাদা দিয়েছে। এছাড়াও ইউনেস্কোর কমিশনপ্রাপ্ত বইগুলো যেমনÑবার্মা, সিলোন, তুর্কী, সৌদি আরব প্রভৃতি তাঁকে আন্তর্জাতিক ইতিহাসচর্চার সাথেও যুক্ত করে। ইতিহাসচর্চা ও সাহিত্যে অসাধারণ অবদানের জন্য মাহবুব-উল আলম অর্জন করেন একাধিক পুরস্কার। এর মধ্যে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৫), প্রধানমন্ত্রী সম্মাননা (১৯৬৫) এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি একুশে পদক (১৯৭৮) অন্যতম। তবে এসব সম্মানের বাইরে, একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হলো-বাঙালি পাঠককে নিজের আঞ্চলিক ইতিহাসের প্রতি আগ্রহী করে তোলা। মহান এই মনীষী আজকের দিনে, ৭ আগস্ট ১৯৮১ সালে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেও তাঁর কলমের লেখা বইপত্র আজও ইতিহাসের পাতায় জ্যোতির্ময়। চট্টগ্রামের সর্বজনশ্রদ্ধেয়, হাটহাজারীর আলম পরিবারের গৌরব মাহবুব-উল আলম ছিলেন ইতিহাসের গল্পকার, সত্যের সাধক। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক : প্রাবন্ধিক।