তামাক এক নীরব ঘাতক, যার পরিণতি কখনোই সুখকর হয় না। এটি ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজÑ সবকিছুকে বিষিয়ে তোলে। তামাক বলতে ধূমপান, জর্দা, গুল, সাদাপাতা, বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা ইত্যাদি বোঝায়। এসব পণ্যে নিকোটিন নামক এক ধরনের নেশাজাতীয় উপাদান থাকে, যা শরীর ও মস্তিষ্ককে আসক্ত করে তোলে। নিয়মিত তামাক সেবনে ফুসফুস, মুখগহ্বর, গলা ও পাকস্থলীর ক্যান্সারসহ হৃদরোগ, স্ট্রোক শ্বাসযন্ত্রের রোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। অথচ বিশ্বজুড়ে তামাক সেবনের সংখ্যা বাড়ছেÑ যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্যানুসারে, প্রতিবছর প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষ তামাকজনিত রোগে মারা যায় এবং প্রায় ১২ লক্ষ মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। স্বাভাবিক মৃত্যু যেখানে মেনে নেয়া সহজ নয় সেখানে তামাকজনিত রোগে মারা যাওয়া কতটা কষ্টেরÑ তা একমাত্র ভুক্তভোগী পরিবারই অনুধাবন করতে পারে। কারণ যার চলে (হারায়) যায় সে-ই বুঝে বিচ্ছেদের কী যন্ত্রণা। তামাক সেবনে বাংলাদেশের অবস্থাও ভয়াবহ। প্রায় ৪ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে তামাক ব্যবহার করে। কর্মক্ষেত্র, পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনে প্রায় ৩ কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন। ফলে প্রতি বছর প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ তামাকজনিত রোগে মারা যায়।

তামাক মানবসভ্যতার এক অভিশাপ। এটি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। তারপরও কিছু মানুষ জেনেশুনে বিষপান করছেÑ তামাক সেবনের মাধ্যমে নিজেদের জীবনকে ধ্বংস করছে। একবার কেউ তামাকে আসক্ত হয়ে পড়লে আর এ অভ্যাস ত্যাগ করতে পারে না। অসুস্থ থাকলেও তামাক সেবন করে। কারও বারণ সে মানে না, কারণ, তামাক শুধু শরীর নয়, একেও বন্দী করে ফেলে। কিছু মানুষ ভাত ছাড়া থাকতে পারলেও তামাক ছাড়া থাকতে পারে না। এটি শুধু স্বাস্থ্য নয়, অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তামাকজনিত রোগের চিকিৎসায় প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়, যা জাতীয় অর্থনীতির ওপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করে। চিকিৎসা ব্যয়, কর্মক্ষমতা হ্রাস ও পরিবেশ দূষণের কারণে জাতীয় উৎপাদনেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। দরিদ্র পরিবারগুলোর আয়ের বড় অংশ তামাক কেনায় ব্যয় হয়। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও টেকসই উন্নয়নে ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে জানানো হয়- বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৪৪২ জন মানুষ তামাকজনিত রোগে মারা যায়। অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো তামাক।

গবেষকরা বলছেন- তামাক নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত অসংক্রামক রোগে মৃত্যু এক তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনা এবং এসডিজির অন্যান্য লক্ষ অর্জন সম্ভব নয়। দেশে তামাক ব্যবহারকারী পরিবারগুলোর মাসিক খরচের ৫ শতাংশ তামাক কিনতে, ১০ শতাংশ তামাকজনিত রোগের চিকিৎসায় ব্যয় হয়। অর্থাৎ তামাকের কারণে স্বাস্থ্যব্যয় প্রায় ৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। গোলটেবিল বৈঠকের তথ্যমতে জানা যায়, দেশে বছরে প্রায় এক লাখ একরের বেশি জমি তামাক চাষে ব্যবহৃত হয়। ফলে খাদ্যনিরাপত্তা ও টেকসই কৃষি হুমকির মুখে। অপরদিকে তামাকপাতা পোড়াতে উজাড় হচ্ছে দেশের ৩০ শতাংশ বনভূমি। বিড়ি ও জর্দা-গুল তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে নারী ও শিশুশ্রম। তামাকপণ্যের মোড়ক, প্লাস্টিক কৌটা ও সিগারেটের অবশিষ্টাংশ প্রকৃতি দূষণ করছে। এভাবে তামাকের উৎপাদন ও ব্যবহার জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার প্রায় সবকটি লক্ষ্য অর্জনে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে- বিশেষ করে সুস্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচন, টেকসই কৃষি ও পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে।

ইদানিং তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেট বা ভ্যাপের ব্যবহার বেড়েছে। রঙিন নকশা, সুগন্ধি ও ফ্লেভারের কারণে এটি এখন নতুন ফ্যাশন হয়ে উঠেছে। অথচ ই-সিগারেট এক ভয়ংকর আসক্তির দরজা। এতে থাকে নিকোটিন-একটি মারাত্মক রাসায়নিক যা মস্তিষ্কে নির্ভরশীলতা সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, কিশোর বয়সে নিকোটিন গ্রহণ মস্তিষ্কের বিকাশে বাধা দেয় এবং মনোযোগ ও শিক্ষাগত সক্ষমতা কমায়। অনেক তরুণ এখন মনে করছে, এটি ধূমপানের নিরাপদ বিকল্প। কিন্তু বাস্তবে এটি শরীর ও এ-দুটিকেই নিঃশব্দে ক্ষয় করছে। তাই ই-সিগারেট দ্রুত নিষিদ্ধ করা জরুরি। এ আসক্তি থেকে তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করতে না পারলে আমরা অসুস্থ জাতিতে পরিণত হবো। আজকের তরুণরা নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে। এজন্য প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি। বিশেষ করে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। একটি দেশ তখনই প্রকৃত উন্নয়নের পথে এগোতে পারে, যখন তার নাগরিকরা সুস্থ, সচেতন ও নেশামুক্ত থাকবে। অথচ কিছু তরুণ তরুণী সিগারেটের ধোঁয়ায় সুখ খোঁজে। কিন্তু তামাক কোনো সুখের প্রতীক নয়! বরং এটি এক ভয়ংকর ফাঁদ। সিগারেটের ধোঁয়া শুধু শরীরকেই নয়, জাতির ভবিষ্যৎকেও ধ্বংস করছে। গ্রামের কথা না হয় বাদই দিলাম। রাজধানীর নামি-দামি স্কুল কলেজের আশপাশে যখন দেখি কিছু শিক্ষার্থী প্রকাশ্যে ধুমপান করছে, তখন মনের ভেতর প্রচন্ড আঘাত লাগে। কিন্তু বলার সাহস পাই না। তারা আইনের তোয়াক্কা করছে না। অথচ প্রকাশ্যে ধুমপান করা অপরাধ। বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করে, যা ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়। এ আইনে জনসমাগমস্থলে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং তামাকপণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচার বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এখনো অনেক জায়গায় এ আইন মানা হচ্ছে না। বাসস্ট্যান্ড, রেসটুরেন্ট, অফিস, পার্ক-সবখানেই ধূমপানের ধোঁয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে। বিশ্বের ১১৮টি দেশ ইতোমধ্যে সিগারেটের খুচরা বিক্রি বন্ধ করেছে। ব্রাজিল ও তুরস্ক কঠোর আইনের মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশেও এ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা জরুরি।

ধূমপান যে অত্যন্ত ক্ষতিকর, এটা কারও অজানা নয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত ধূমপায়ীর আশপাশে থাকে, তাদেরও হৃদরোগ ও ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। তবে শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণি। বাবা-মা বা পরিবারের সদস্যদের ধূমপান তাদের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করে তোলে। অনেক ধূমপায়ী বাবা কলিজারটুকরা সন্তানকে আদর করে চুমু দেন ঠিকই, কিন্তু অজান্তেই সন্তানকে বিষ উপহার দিচ্ছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে-তামাক শুধু সেবনকারী নয়, তার চারপাশের মানুষকেও নিঃশব্দে হত্যা করছে। তামাকের কারণে ব্যক্তি পর্যায়ে যেএ স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে, তেমনি অর্থনীতিরও বিশাল ক্ষতি হয়। তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যায়। প্রতিবছর তামাকজনিত রোগের চিকিৎসায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি তামাক চাষ হয় কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাঙ্গামাটিতে। তবে কুষ্টিয়া অঞ্চলকে বলা হয় ‘তামাকের রাজধানী’। এ জেলাগুলোর কৃষকরা খাদ্যশস্য থেকে সরে ধীরে ধীরে তামাক চাষের দিকে ঝুঁকছেন। ফলে ফসলের বৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে, জমির উর্বরতা কমছে এবং কৃষকরা স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়ছেন। এ ব্যাপারে স্থানীয় কৃষি অধিদপ্তর সচেতনা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে পারে। শুধু আইন করলেই তামাকের ব্যবহার বন্ধ হবে না; রাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। জনগণের ভেতর সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের সেএিার-সিম্পোজিয়াম আয়োজন এবং গণমাধ্যমে তামাকবিরোধী প্রচার চালাতে হবে। গণপরিবহন থেকে শুরু করে কর্মস্থল, হোটেল, রেস্তোরাঁ ও পাবলিক প্লেসে তামাক সেবন নিষিদ্ধ করতে হবে। যে কেউ সেবন করবে, তাকে সঙ্গে সঙ্গে জরিমানার আওতায় আনাতে হবে। পরিবার ও স্কুল কলেজ পর্যায়ে তামাক সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা শিশু-কিশোরদের দিতে হবে। তামাকের কুফল সম্পর্কে তাদের জানাতে হবে। তরুণদের বিকল্প ইতিবাচক ও সুস্থ বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, যেন তারা বিপথগামী না হয়। তরুণ সমাজ বিপথগামী হলে দেশ কখনোই সামনে এগুতে পারবে না। একটি দেশ তখনই কেবল সামনে এগোতে পারে যখন তার নাগরিকরা সুস্থ, সচেতন ও নেশামুক্ত থাকে। আমাদের সবারই মনে রাখা প্রয়োজনÑপ্রতিটি সিগারেটের ধোঁয়া শুধু শরীর নয়, পরিবারের হাসি, অর্থনীতি ও জাতির ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করছে। তামাক হলো এক ধীর বিষ, এক নিঃশব্দ মৃত্যু। এ মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে এখনই আমাদের সচেতন হতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র-সবাইকে একসঙ্গে। সুস্থ, সচেতন ও নেশামুক্ত প্রজন্মই পারে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। তাই আসুন, আজই প্রতিজ্ঞা করিÑতামাককে ‘না’ বলি, জীবনের পক্ষে দাঁড়াই।

লেখক : প্রাবন্ধিক।