জাফর আহমাদ
মুসলিম হোক বা অমুসলিম, মু’মিন হোক বা কাফির, আপনার বাড়ি বা অফিসের পরিচ্ছন্ন কর্মী হোক, আপনার অফিসের পিয়ন হোক, হোক সে রাস্তার ঝাড়ুদার বা ময়লা সাফকারী কাউকে তুচ্ছজ্ঞান ও হেয় প্রতিপন্ন করবেন না। সমাজের নিম্নস্তরের কুলি, মুজুরসহ সকল পেশাদার বা অপেশাদার মানুষকে কখনো তুচ্ছজ্ঞান করা যাবে না। কারণ তাকে ঘৃণা করার অপরাধ থেকেও বড় অপরাধ হলো, আপনার অহংকার। আপনার মধ্যে অহংকার আছে বলেই এদেরকে তুচ্ছজ্ঞান করেন। কোন নিরহংকারী ব্যক্তি কোনদিন অন্যকে তুচ্ছজ্ঞান করেন না। মনে রাখবেন, অহংকারের অনধিকারচর্চা প্রথম করেছিল ইবলিস শয়তান। ফলে সে চিরকালের জন্য ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। আপনি বাড়ির মালিক, অফিসের বড় কর্তা, সমাজের বড় নেতা, দেশের সর্বোচ্চ চাকুরে, এলাকার মাতাব্বর, অভিজাত এলাকার বাসিন্দা এগুলো মর্যাদার মাপকাঠি নয়। বরং মর্যাদার মাপকাঠি হলো, আপনার তাকওয়া। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে অধিক মুত্তাকী সে-ই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাবান।” (সুরা হুজরাত : ১৩)
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) বলেন, নবী (সা:) বলেছেন: যার অন্তরে অণুপরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এক ব্যক্তি জিজ্ঞাস করলো, মানুষ চায়, তার পোশাক সুন্দর হোক, তার জুতা সুন্দর হোক, এ-ও কি অহংকার? রাসুলুল্লাহ (সা:) বললেন: আল্লাহ সুন্দর, তিনি সুন্দরকে ভালোবাসেন। প্রকৃতপক্ষে অকংকার হচ্ছে দম্ভভরে সত্য ও ন্যায়কে অস্বীকার করা এবং মানুষকে ঘৃণা করা।(মুসলিম: ১৬৬ আন্ত: নাম্বার ৯১, কিতাবুল ঈমান, বাবু তাহরিমিল কিবরি ও বায়ানিহি, ইফা:১৬৭, ই.সে: ১৭৩)
হযরত আব্দুল্লাহ (রা:) হতে বর্ণিত। নবী (সা:) বলেছেন: যে ব্যক্তির অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকারও আছে সে জান্নাতে যেতে পারবে না। আর যে ব্যক্তির অন্তরে অণূ পরিমাণ ঈমানও আছে সে জাহান্নামে যাবে না। তখন একজন বলল, আমার নিকট এটা তো খুবই পছন্দনীয় যে, আমার জামা-কাপড় সুন্দর হোক এবং জুতা জোড়াও সুন্দর হোক। তিনি বললেন: আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। কোন ব্যক্তির সদর্পে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করাই হলো অহংকার। (তিরমিযি : ১৯৯৯, কিতাবুল বিররি ওয়াস সিলাহ আন রাসুলিল্লাহ (সা:), বাবু মা জা’আ ফিল কিবরে, আবু ঈশা বলেন, এ হাদিসটি হাসান সহীহ, গারীব)
কাউকে তুচ্ছজ্ঞান করা সুস্পষ্ট গোমরাহী। এ ধরনের ব্যক্তিরা সমাজের জন্য অকল্যাণকর ও অনাচার সৃষ্টিকারী। এরা বংশ, বর্ণ, ভাষা, দেশ এবং জাতীয়তার সংকীর্ণ অলিগলির অধিবাসী। গোঁড়ামী ও সংকীর্ণতাই হলো এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রাচীনকাল থেকে প্রত্যেক যুগে মানুষ সাধারণ মানবতাকে উপেক্ষা করে তাদের চারপাশে কিছু ছোট ছোট বৃত্ত টেনেছে। এ বৃত্তের মধ্যে জন্মগ্রহণকারীদের সে তার আপনজন এবং বাইরে জন্মগ্রহণকারীদের পর বলে মনে করেছে। কোন যৌক্তিক বা নৈতিক ভিত্তির ওপর নির্ভর করে এ বৃত্ত টানা হয়নি বরং টানা হয়েছে জন্মের ভিত্তিতে যা একটি অনিচ্ছাকৃত ব্যাপার মাত্র। কোথাও এর ভিত্তি একই খান্দান, গোত্র ও গোষ্ঠিতে জন্মগ্রহণ করা এবং কোথাও একই ভৌগলিক এলাকায় কিংবা এক বিশেষ বর্ণ অথবা একটি বিশেষ ভাষাভাষী জাতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করা। তাছাড়া এসব ভিত্তির ওপর নির্ভর করে আপন ও পরের বিভেদ রেখা টানা হয়েছে। এ মানদণ্ডে যাদেরকে আপন বলে মনে করা হয়েছে পরদের তুলনায় তাদের কেবল অধিক ভালবাসা বা সহযোগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং এ বিভেদনীতি ঘৃণ্য, শত্রুতা, তাচ্ছিল্য ও অবমাননা এবং জুলুম ও নির্যাতনের জঘন্যতম রূপ পরিগ্রহ করেছে। এমনকি তাদের ওপর সুপকিল্পিতভাবে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে।
এমন ভেদনীতির সমর্থনে দর্শন রচনা করা হয়েছে। মত ও বিশ্বাস আবিস্কার করা হয়েছে। আইন তৈরি করা হয়েছে। নৈতিক নীতিমালা রচনা করা হয়েছে। বিভিন্ন জাতি ও রাষ্ট্র এটিকে তাদের স্থায়ী ও স্বতন্ত্র বিধান হিসেবে গ্রহণ করে বাস্তবে অনুসরণ করেছে। এরই ভিত্তিতে ইহুদীরা নিজেদেরকে আল্লাহর মনোনীত সৃষ্টি বলে মনে করেছে এবং তাদের বিধি-বিধানে পর্যন্ত অইসরাঈলীদের অধিকার ও মর্যাদা ইসরাঈলীদের চেয়ে নিম্ন পর্যায়ে রেখেছে। এ ভেদনীতিই হিন্দুদের মধ্যে বর্ণাশ্রমের জন্ম দিয়েছে যার ভিত্তিতে ব্রাহ্মাণদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এবং শুদ্রদের চরম লাঞ্চনার গভীর খাদে নিক্ষপ করা হয়েছে। কালো ও সাদার মধ্যে পার্থক্য টেনে আফ্রিকা ও আমেরিকায় কৃষ্ণাংগদের ওপর যে অত্যাচার চালানো হয়েছে তা ইতিহাসের পাতায় অনুসন্ধান করার প্রয়োজন নেই বরং প্রায়শই খবরের কাগজে নিজ চোখে দেখতে পাওয়া যায়। ইউরোপ-আমেরিকা এশিয়া ও আফ্রিকার সাথে যে ধরনের আচরণ করে তাতে এটা ভাবা স্বাভাবিক যে, তাদের গণ্ডির বাইরে জন্মগ্রহণকারীদের জান-মাল তাদের জন্য হালাল এবং ঠুনকো অজুহাতে একটি দেশের সার্বভৌম সীমানা তছনছ ঢুকে পড়া তাদের জন্য খুব্ই সহজ ব্যপার। তাদেরকে লুট করা, ক্রীতদাস বানানো এবং প্রয়োজনে পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার অধিকার তাদের আছে।
সমাজ ভাঙনের কার্যকরী ভূমিকা পালনকারী এ সমস্ত গোমরাহী দুর করার জন্য আল কুরআন পথনির্দেশনা দান করেছে। কুরআন বলছে মর্যাদার যে বৃত্ত তোমরা গড়ে তুলেছো, তা সঠিক নয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে মানবজাতি, তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দিয়েছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো। তোমাদের মধ্যে যে অধিক আল্লাহভীরু বা মুত্তাকী সে-ই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদার অধিকারী। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও সবকিছু সম্পর্কে অবহিত।” (সুরা হুজরাত: ১৩)
এ আয়াতের আলোকে মর্যাদার প্রকৃত মাপকাঠি হচ্ছে, আল্লাহর ভয়। যারা আল্লাহকে বেশী ভয় করে, তারাই প্রকৃত মর্যাদাশীল ব্যক্তি। তার অর্থ জন্মগত সকল মানুষ সমান। মানুষের মধ্যে মর্য়াদা ও শ্রেষ্ঠত্বের বুনিয়াদ যদি কিছু থেকে থাকে তা হচ্ছে নৈতিক মর্যাদা। মানুষের সৃষ্টিকর্তা এক, তাদের সৃষ্টির উপাদান ও সৃষ্টির নিয়ম-পদ্ধতিও এক ও অভিন্ন, সকলের বংশধারা একই পিতা-মাতা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। কোন ব্যক্তির কোন বিশেষ দেশ, জাতি অথবা বিভিন্ন বংশ ও গোষ্ঠীতে জন্মলাভ করা একটি কাকতালীয় ব্যাপার মাত্র। এতে তার ইচ্ছা,পছন্দ বা বিশেষ চেষ্টা-সাধনা কোন কার্যকর অংশগ্রহণ ছিল না। এমনকি তার পিতা-মাতাও জানতো না তার গর্ভে বা ঔরষে কে আসছে। সুতরাং এ দিক দিয়ে কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তির ওপর মর্যাদার প্রাধান্য লাভের যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ থাকতে পারে না।
সবার মূল উৎস এক। একমাত্র পুরুষ এবং একমাত্র নারী থেকে আমাদের গোটা মানবজাতি অস্তিত্ব লাভ করেছে। পৃথিবীতে যত বংশধারা দেখা যায় প্রকৃতপক্ষে তা একটি মাত্র প্রাথমিক বংশধারার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা যা একজন মা ও একজন বাবা থেকে শুরু হয়েছিল। এ সৃষ্টিধারার কোথাও এ বিভেদ এবং উচ্চ নীচের কোন ভিত্তি নেই। কিন্তু আমরা বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণায় লিপ্ত আছি। আমাদের প্রত্যেকের স্রষ্টা আল্লাহ তা’আলা। এমন নয় যে, বিভিন্ন মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন রব সৃষ্টি করেছেন। একই সৃষ্টি উপকরণ দিয়ে আমাদের প্রত্যেককে সৃষ্টি করা হয়েছে। এমন নয় যে, মানুষের মধ্যে কিছু লোককে মূল্যবান কোন বিশেষ উপাদান বা পবিত্র কোন উপাদান দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে আর অপর কিছু লোককে অপবিত্র নিম্নমানের উপাদান দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। একই নিয়ম পদ্ধতিতে সকলেই জন্মলাভ করেছে।
মূল উৎস এক হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত হওয়া ছিল একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু প্রকৃতিগত এ পার্থক্য ও ভিন্নতার দাবি এ নয় যে, এর ভিত্তিতে উচ্চ ও নীচ, ভদ্র ও অভদ্র এবং শ্রেষ্ঠ ও নিকৃষ্ট হওয়ার ভেদাভেদ সৃষ্টি হবে, একটি বংশধারা আরেকটি বংশধারার ওপর কৌলিন্যের দাবি করবে, এক বর্ণের লোক অন্য বর্ণের লোকদের হেয় ও নীচ মনে করবে, এক জাতি অন্য জাতির ওপর নিজের শ্রেষ্টত্ব ও আভিজাত্য প্রতিষ্ঠা করবে এবং মানবাধিকারের ক্ষেত্রে এক জাতি অন্য জাতির ওপর অগ্রাধিকার লাভ করবে। যে কারণে মহান সৃষ্টিকর্তা মানবগোষ্ঠীসমূহকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রের আকারে বিন্যস্ত করেছিলেন তা হচ্ছে, তাদের মধ্যে পারস্পরিক জানা শোনা ও সহযোগীতার জন্য একটি সম্মিলিত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠে এবং জীবনের বিভিন্ন ব্যাপারে একে অপরের সাহায্যকারী হতে পারে। তাদের প্রত্যেকে একে অপরকে সম্মান করবে। কেউ কাউকে তুচ্ছজ্ঞান বা হেয় প্রতিপন্ন করবে না। কিন্তু আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টি প্রকৃতি যেসব জিনিসকে পারস্পরিক পরিচয়ের উপায় বানিয়েছিল শুধু শয়তানী মূঢ়তা ও মূর্খতা সে জিনিসকে গর্ব-অহংকার ও ঘৃণার উপকরণ বানিয়ে নিয়েছে এবং বিষয়টিকে অত্যাচার ও সীমালংঘনের পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়েছে।
যে মূল জিনিসের ভিত্তিতে এক ব্যক্তি অপর সব ব্যক্তিদের ওপর মর্যাদা লাভ করতে পারে তা হচ্ছে, সে অন্য সবার তুলনায় অধিক আল্লাহ ভীরু, মন্দ ও অকল্যাণ থেকে দূরে অবস্থানকারী এবং নেকী ও পবিত্রতার পথ অনুগমনকারী। এরূপ ব্যক্তি যে কোন জাতি এবং যে কোন দেশেরই হোক না কেন সে তার ব্যক্তিগত গুণাবলীর কারণে সম্মান ও মর্যাদার পাত্র। যার অবস্থা এর বিপরীত সর্বাবস্থায় সে একজন নিকৃষ্টতর মানুষ। সে কৃষ্ণাঙ্গ বা শ্বেতাঙ্গ হোক এবং প্রাচ্যে জন্মলাভ করে থাকুক বা পাশ্চাত্যে তাতে কিছু যায় আসে না।
ইবনে উমর (রা:) থেকে বর্ণিত যে, মক্কা বিজয়ের দিন রাসুলুল্লাহ (সা:) লোকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। বললেন: হে লোক সকল! আল্লাহ তা’আলা জাহেলী যুগের অন্ধ অহমিকা এবং পিতৃপুরুষদের নিয়ে গর্ব করার প্রথা ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন। মানুষ হল দু’ধরনের। এক প্রকার হল সৎ, পরহেজগার এবং আল্লাহর নিকট মর্যাদাবান। আরেক প্রকার হল অসৎ, দূরাচার এবং আল্লাহর নিকট নিকৃষ্ট। মানুষ হল আদম-এর সন্তান। আল্লাহ তা’আলা আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। (তিরমিযি:৩২৭০, কিতাবুত তাফসীরুল কুরআন আন রাসুলিল্লাহ (সা:), বাবু ওয়া মিন সুরাতিল হুজরাত, সহীহা:২৭০০)
আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক চাল-চলন ও বিত্ত-বৈভবের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না; বরং তিনি দৃষ্টি দিয়ে থাকেন তোমাদের অন্তর ও আমলের প্রতি।(মুসলিম:৬৪৩৭, আন্ত; নাম্বার: ২৫৬৪, কিতাবুল বিররি ওয়াস সিলাহ ওয়াল আদব, বাবু তাহরিমি জুলমিল মুসলিম...., ই. সে:৬৩৬০, ইফা:৬৩১১, ইবনে মাযাহ: ৪১৪৩)
সুতরাং আসুন, মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান নয় বরং ভালবাসতে শিখুন। সকল ভেদাভেদ ভুলে তাকওয়ার ভিত্তিতে মানুষের মর্যাদা দিন।
লেখক : ব্যাংকার।