॥ শাহেদ শফিক ॥

দক্ষিণ এশিয়ার হিমালয় কন্যা নেপাল আবারও প্রবল রাজনৈতিক ঝড়ের মুখে। মাত্র কয়েক দিনের বিক্ষোভ, অস্থিরতা এবং সহিংসতার পর প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। এই ঘটনার পেছনে ছিল এক অনন্য শক্তির উত্থান-নেপালের তরুণ প্রজন্ম, যারা নিজেদের পরিচিতি দিয়েছে ‘জেন-জি আন্দোলন’ নামে। প্রথমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে রাস্তায় নামা এই তরুণরা দ্রুত দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং রাষ্ট্রীয় অভিজাতদের বিলাসী জীবনের বিরুদ্ধে জনঅসন্তোষের মুখপাত্র হয়ে ওঠে। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তারা যে অভূতপূর্ব জনশক্তির প্রদর্শন করল, তা কেবল সরকারের পতনই নয়, বরং নেপালের রাজনৈতিক ভবিষ্যতকেও অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিল।

সবকিছুর সূচনা হয়েছিল সরকারের সিদ্ধান্ত থেকে। গত সপ্তাহে ক্ষমতাসীন জোট সরকার ২৬টি জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করে দেয়। ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, এক্স (টুইটার)-এসব প্ল্যাটফর্ম নেপালের তরুণদের প্রতিদিনের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সরকারের দাবি ছিল, এসব প্ল্যাটফর্ম নিবন্ধিত নয় এবং ভুয়া তথ্য প্রচার ও অনলাইন প্রতারণার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু তরুণরা একে সরাসরি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত হিসেবে দেখল। অনেক সমালোচকও বললেন, সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো দুর্নীতি এবং বিলাসবহুল জীবনযাপনের সমালোচনা রোধ করা, ভিন্নমত দমন করা। ঠিক তখনই শুরু হয় তরুণদের বিস্ফোরণ।

নেপালের তরুণ প্রজন্ম, বিশেষত শহুরে শিক্ষার্থী এবং তরুণ পেশাজীবীরা দীর্ঘদিন ধরে বেকারত্ব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং দারিদ্র্যের শিকার। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করছিল দুর্নীতি প্রকাশ, আন্দোলন সংগঠিত এবং ভিন্নমত জানানোর মাধ্যম হিসেবে। প্ল্যাটফর্মগুলো বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মনে হলো, সরকার তাদের কণ্ঠস্বর কেড়ে নিতে চাইছে। সোমবার সকালে হাজার হাজার তরুণ কাঠমান্ডুর রাস্তায় নেমে আসেন। হাতে প্ল্যাকার্ড, তাতে লেখা-“দুর্নীতি বন্ধ করো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নয়।” এই স্লোগান মুহূর্তেই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। পোখারা, বুটওয়াল, ভৈরাহাওয়া, ভরতপুর, ইতাহারি, দামাক—প্রায় সব বড় শহরই বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। আন্দোলনের নাম দেওয়া হয়-‘জেন-জি বিপ্লব’।

শুরুতে শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলন দ্রুত সহিংস রূপ নেয়। বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভবন ঘিরে ফেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিরাপত্তা বাহিনী টিয়ারগ্যাস, জলকামান এমনকি গুলীও চালায়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, প্রথম দিনেই প্রাণ হারায় অন্তত ২০ জন, আহত হয় ২৫০ জনের বেশি। মঙ্গলবারও সংঘর্ষে নিহত হয় আরও একজন। পুলিশের কঠোর অবস্থান তরুণদের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দেয়। তারা সংসদ ভবনে প্রবেশ করে ভাঙচুর চালায়, নেতাদের বাসভবনে হামলা করে এবং কয়েকটি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করে। এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মালিকানাধীন একটি স্কুলও বিক্ষোভকারীরা পুড়িয়ে দেয়।

অবস্থা এতটাই ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে রাজধানী কাঠমান্ডুসহ বিভিন্ন শহরে অনির্দিষ্টকালের কারফিউ জারি করা হয়। সেনাবাহিনীকে হেলিকপ্টারে করে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হয়। ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়। তবুও আন্দোলন থেমে থাকেনি। কারফিউ ভেঙে তরুণরা রাস্তায় নেমে এসেছে, তারা স্লোগান দিয়েছে-“সরকারি খুনিদের শাস্তি দাও”, “শিশু হত্যা বন্ধ করো।”

এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী অলি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি শান্ত থাকার আহ্বান জানান এবং তদন্ত কমিটি গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসার ঘোষণা দেন। কিন্তু তখন আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার সুযোগ ছিল না। সেনাপ্রধান আশোক রাজ সিগদেল সোজাসাপ্টা বলে দেন-শুধু পদত্যাগের মাধ্যমেই পরিস্থিতি শান্ত করা সম্ভব। শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় অলি প্রেসিডেন্টের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় তার চতুর্থ মেয়াদ।

অলির পদত্যাগ নেপালের রাজনীতিতে নতুন অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছে। ক্ষমতাসীন জোট সরকারের ভাঙন এখন নিশ্চিত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী, পানি সম্পদমন্ত্রী-একাধিক মন্ত্রী ইতোমধ্যেই পদত্যাগ করেছেন। বিরোধী দলগুলো জোট থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করছে। নেপালি কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ নেতা শেখর কৈরালা সমর্থকদের পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। মাওবাদী সেন্টারও হুমকি দিয়েছে, তারা জোট ছাড়বে। অন্যদিকে ন্যাশনাল ইনডিপেনডেন্ট পার্টির ২১ জন এমপি একসঙ্গে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছে। এতে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। নতুন সরকার গঠন বা আগাম নির্বাচন-দুটোর একটি ছাড়া বিকল্প নেই।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই আন্দোলন ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম বলছে, নেপালের তরুণ প্রজন্ম কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জন্য লড়াই করছে না, তারা দুর্নীতি, বৈষম্য এবং রাজনৈতিক অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেওয়া সন্তানেরা যখন বিলাসবহুল জীবনে মেতে উঠছে, তখন বেকার তরুণদের সামনে চলে আসে অন্ধকার ভবিষ্যৎ। এই বৈপরীত্যই আন্দোলনের জ্বালানি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘নেপো কিডস’ নামে পরিচিত রাজনীতিক পরিবারের সন্তানদের অঢেল ভোগবিলাস নেপালের রাস্তায় ক্ষুব্ধ স্লোগানে পরিণত হয়েছে।

এই আন্দোলন স্পষ্ট করে দিল, তথ্যপ্রবাহ থামিয়ে তরুণদের কণ্ঠস্বর বন্ধ করা যায় না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কেবল প্রযুক্তির হাতিয়ার নয়, এটি হয়ে উঠেছে তরুণদের অস্তিত্বের অংশ। সেটি বন্ধ করার মানে তাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। আর এই অস্বীকৃতিই তরুণদের রাস্তায় নামিয়ে এনেছে। তাদের এই শক্তি নেপালের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে নতুন পথে ঠেলে দিতে পারে। প্রশ্ন হলো, নতুন সরকার কি তাদের দাবি শুনবে? নাকি আবারও দমননীতির আশ্রয় নেবে?

অলি সরকারের পতন নিঃসন্দেহে একটি বড় রাজনৈতিক পরাজয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় বিষয় হলো, এই ঘটনা প্রমাণ করেছে তরুণদের শক্তি কতটা প্রবল হতে পারে। ডিজিটাল প্রজন্ম যেকোনও সময়ে নিজেদের সংগঠিত করতে পারে, যেকোনও রাষ্ট্রক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। নেপালের এই অভিজ্ঞতা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশকেও ভাবিয়ে তুলবে। যেখানে তরুণ জনসংখ্যা বেশি, যেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই প্রধান জনমত তৈরির জায়গা-সেখানে এই ধরনের আন্দোলন আরও দেখা যেতে পারে।

আজ নেপালের সামনে বড় প্রশ্ন হলোÑতারা কি কেবল সরকার পতনের মধ্যেই আন্দোলনের সফলতা দেখবে, নাকি এর ভেতর থেকে এক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলবে? অস্থায়ী সরকার গঠনের আলোচনা চলছে। বিরোধীরা আগাম নির্বাচনের দাবি তুলছে। সেনাবাহিনী আপাতত ক্ষমতা নেওয়ার পথে হাঁটছে না। কিন্তু যদি রাজনৈতিক শূন্যতা দীর্ঘ হয়, তবে সামরিক প্রভাব বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।

জেন-জি আন্দোলন তাই কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য একটি লড়াই নয়, এটি একটি প্রজন্মের হতাশা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। তারা নতুন নেতৃত্ব, স্বচ্ছতা, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি চায়। পুরনো রাজনীতির গ-ি ভেঙে নতুন প্রজন্ম কি এগিয়ে আসবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে নেপালের তরুণরা ইতোমধ্যেই দেখিয়ে দিয়েছে-তাদের উপেক্ষা করা যাবে না। তারা এখন আর দর্শক নয়, বরং পরিবর্তনের চালিকাশক্তি।

নেপালের এই আন্দোলন ইতিহাসে লিখিত থাকবে জেন-জি প্রজন্মের বিদ্রোহ হিসেবে। এটি প্রমাণ করেছে, প্রযুক্তি-নির্ভর প্রজন্মের শক্তি সীমাহীন। সরকারের পতন শুধু শুরু, সামনে অপেক্ষা করছে আরও বড় প্রশ্ন-গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা আর যুবশক্তির দাবি পূরণ হবে কি না। নেপালের রাজনীতি তাই নতুন মোড়ে দাঁড়িয়ে। হয়তো এই বিপর্যয় এক নতুন সূচনার দরজা খুলে দেবে। আর সেই সূচনার রূপকার হবে তরুণরা-যারা নিজেদের কণ্ঠস্বর বন্ধ হতে দেয়নি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক, লন্ডন, যুক্তরাজ্য।