ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক এক গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতন হয়। দলটির দলকানা নেতাকর্মী-সমর্থক ছাড়া পুরো জাতি এ অর্জনে ঐক্যবদ্ধ বিজয় উল্লাস উদযাপন করেছে। তবে এ অর্জন এমনি এমনি আসেনি; হাজারো ছাত্র-জনতার রক্তের সিঁড়ি বেয়ে এ স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। আওয়ামী সরকারের পতন হওয়ার পর দেশ যখন মহাসংকটে তখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং জাতির উদ্দেশ্যে ‘‘দেশের সবাইকে শান্ত থাকার পাশাপাশি সব ধরনের সহিংসতা, স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি শিক্ষার্থীসহ দলমত নির্বিশেষে সবার উদ্দেশ্যে বলেছেন, কোনো প্রকার ভুলের কারণে আমাদের বিজয় যেন হাতছাড়া হয়ে না যায়।’’ পুরো দেশবাসী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে স্বাগত জানিয়েছে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী শাসতন্ত্র আন্দোলন, খেলাফত মজলিস ও দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করেন এবং সমর্থন জানিয়ে দেশবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার ব্যাপারে সকল রাজনৈতিক দল ঐকমত্য পোষণ করেন। সেদিন কোন রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে কথা বলেননি; বরং সবাই সংস্কারের পক্ষে কথা বলেছেন। কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতে বিএনপির পক্ষ থেকে দ্রুত নির্বাচনের কথা বলা হলেও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে যৌক্তিক সময়ের ভেতর নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দেয়া হয়। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ও সংস্কারের ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করার আহ্বান জানানো হয়। অথচ ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর বিএনপির নয়াপল্টনের সমাবেশে ডিজিটাল প্লাটফর্মে বক্তব্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, সরকারের নজিরবিহীন দুর্নীতি, গণতন্ত্র ধ্বংসের স্তূপের মধ্যে থেকে আমাদের গড়ে তুলতে হবে এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। ছাত্র-তরুণরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। কারণ তরুণরা যে স্বপ্ন নিয়ে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে মেধা যোগ্যতার ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। গড়তে হবে শোষণহীন সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। সব ধর্ম গোত্রের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শান্তি প্রগতি সাম্যের ভিত্তিতে আধুনিক বাংলাদেশ নির্মাণ করি। ধ্বংস নয়, প্রতিশোধ নয়, প্রতিহিংসা নয়, ভালোবাসা ও শান্তির সমাজ গড়ে তুলি।

পৃথিবীর যেকোন দেশের তুলনায় বাংলাদেশের জনগণ ভোটকে উৎসব হিসেবে পালন করে। এটা সত্য। কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থান শুধুমাত্র ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য হয়নি; বরং বৈষম্যমুক্ত, ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে কিশোর, তরুণ, ছাত্র জনতা ও মেহনতি খেটে খাওয়া মানুষ জীবন দিয়েছে কেবলমাত্র নতুন বাংলাদেশ গড়ার তাগিদে। অথচ বিএনপি সংস্কার না করেই দ্রুত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছে। ভোটের পরিবেশ না করেই ভোট চাচ্ছে। ঐক্যের কথা ভুলে গিয়ে বিএনপির কিছু নেতা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আর বিএনপির মধ্যে চির ধরানোর চেষ্টা করছে। জামায়াতে ইসলামী আর বিএনপির ভেতর ফাটল ধরলে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঠেকানো যাবে না, এটা পাগলও বুঝে। অথচ বিএনপির কিছু নেতা এটা অনুধাবন করে না। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী আর বিএনপি জোটবদ্ধ হলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারতো না। সে নির্বাচনের ফলাফলের পর দেখা গেছে অধিকাংশ আসনে জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপির ভোট আলাদা হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে। অথচ সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ফজলুর রহমান জামায়াতে ইসলামীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘দুই পারসেন্ট লোক নেই। পায়ের ওপর পা তুলে কথা বলে। ইউএনও চলে তার কথায়, ডিসি চলে তার কথায়। প্রশাসন চলে তার কথায়। একলা নির্বাচন করলে ৩টা সিট পাবে না, কিন্তু ৩০০ সিটের পাওয়ার দেখাইতেছে এখন। পুরো প্রশাসন দখল করে বসছে। কেন? বাপের বেটা অইলে ইলেকশনে আসো। ইলেকশনে দেখা যাবে বাংলাদেশের মানুষ কারে দায়িত্ব দেয়। তখন বেটাগিরি করো। মঙ্গলবার রাতে কিশোরগঞ্জের ইটনায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের আয়োজনে ঈদ পুনর্মিলনী ও পথসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। (সূত্র : ০২ এপ্রিল, ২০২৫, কালের কন্ঠ) জামায়াতে ইসলামীর ভোটের হিসাব না কষে ফজলুর রহমান সাহেবের উচিত নিজের ভোটের হিসাব জাতির সামনে উন্মোচন করা।

দেশের মানুষ গণতন্ত্রকে ভালোবাসে বলেই প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনে ভোট দিতে কখনো পিছপা হয়নি। সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র এসেছিল এদেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করার জন্য। কিন্তু কোনো সরকারই মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করেনি; বরং নিজেদের আখের গুছিয়েছে। ফলে গণতন্ত্র বার বার হোঁচট খেয়েছে। সুতরাং এবার সময় এসেছে রাষ্ট্র মেরামত তথা গণতন্ত্র রক্ষা করার সংস্কার করার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণতন্ত্রের টেকসই সুরক্ষার স্বার্থে সংস্কার করে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করবে, এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা। ভোটের অধিকার শুধু নির্বাচন দিলেই নিশ্চিত হবে, বিষয়টি এমন নয়! ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের শাসকের কাছ থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচন আমরা আদায় করে নিয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের! স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ভোট কিন্তু কালিমামুক্ত ছিল না। অথচ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন ও গণতন্ত্র হরণ আর শোষণের বিরুদ্ধে যে শেখ মুজিবুর রহমান লড়াই করেছিলেন তিনিই আবার ক্ষমতার মোহে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারিতে বাকশাল গঠন করে গণতন্ত্র হরণ করেছিলেন। একইভাবে মুজিব কন্যা ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করে একদলীয় ৩টি নির্বাচন করেছিলেন। তার শাসনামলে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন একটিও বির্তকমুক্ত ছিল না। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদই সর্বপ্রথম বাংলাদেশের জনগণকে শান্তিপূর্ণ ভোট দেয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ২০০১ সালের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল। স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে হ্যাঁ না ভোটের পুনরাবৃত্তি এ জাতিকে আবারো আওয়ামী লীগ দেখিয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিনাভোটে আওয়ামী লীগের ১৫৪ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর দিনের ভোট রাতে করে নিয়েছিল। আর ২০২৪ সালে আমি আর ডামি নির্বাচন জাতিকে উপহার দিয়েছিল। বর্ণিত তিনটি নির্বাচনে শাসক নির্বাচনের জন্য জনগণের ভোটের প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার অশেষ মেহেরবাণীতে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসকের পতন হয়।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলন পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল গণতন্ত্র সুরক্ষার প্রয়াসে। কিন্তু গণতন্ত্র সুরক্ষিত হয়নি! কারণ রাজনৈতিক দলগুলো যখন বিরোধীদলে থাকে তখন গণতন্ত্রের কথা বলে, আবার যখন ক্ষমতায় যায় তখন ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠে। যার প্রমাণ তো আওয়ামী সরকার। ফলে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা নির্লোভ একজন শাসক খুঁজে পাইনি। কিন্তু পতিত ফ্যাসিস্ট বিতাড়িত হওয়ার পর নির্লোভ একজন শাসকের দেখা পেয়েছে বাংলাদেশ। সুতরাং দেশ গড়ার এ সুযোগকে কাজে লাগাতে না পারলে ফ্যাসিবাদের উত্থান কিছুতেই ঠেকানো যাবে না। দেশের সকল রাজনৈতিক দল ফ্যাসিস্ট বিতাড়িত হওয়ার পর যে ঐক্যের বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছিল সে ঐক্য যে কোন মূল্যে অটুট রাখতে হবে। না হলে ২৪ গণঅভ্যুত্থানে জীবন দেয়া ছাত্র জনতা, আহত-পুঙ্গত্ববরণকারী ও মেহনতি মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। ছাত্র জনতা ও মেহনতি মানুষ কেউই শুধুমাত্র একদিনের ভোটের জন্য জীবন দেয়নি; বরং বৈষম্যমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, শোষণমুক্ত ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে জীবন দিয়েছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক