কলাম
রোজা ও উপবাসের পার্থক্য
অনেককেই দেখা যায়, রোজা রাখা সত্ত্বেও নামায পড়ে না, কুরআন তিলাওয়াত করে না; বরং ঘণ্টার পর ঘন্টা মোবাইল ফোন, টেলিভিশন ও গল্প-গুজবের মাধ্যমে পার করে দেন। তারা হয়তো রোজা রাখা বলতে উপবাস থাকাকেই মনে করেন।
Printed Edition
অনেককেই দেখা যায়, রোজা রাখা সত্ত্বেও নামায পড়ে না, কুরআন তিলাওয়াত করে না; বরং ঘণ্টার পর ঘন্টা মোবাইল ফোন, টেলিভিশন ও গল্প-গুজবের মাধ্যমে পার করে দেন। তারা হয়তো রোজা রাখা বলতে উপবাস থাকাকেই মনে করেন। অথচ, রোজা শুধু উপবাস নয়। উপবাস হল একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কিছু নির্দিষ্ট বা সব ধরনের খাদ্য বা পানীয় অথবা সব ধরনের পানাহার থেকে বিরত থাকা, যার উদ্দেশ্য কিছু স্বাস্থ্যগত উপকার লাভ করা। অন্যদিকে রোজা হলো-সুবহে সাদিক বা ফজর নামাজের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব ধরনের পানাহার ও যৌনাচারসহ সব ধরনের অনৈতিক ও দুষ্কৃতি বা পাপাচার থেকে বিরত থাকা। এর মূল উদ্দেশ্য আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহ’র সন্তুষ্টি অর্জন এবং ক্ষমা লাভ; যা শুধু উপবাসের মাধ্যমে অর্জিত হয় না। পবিত্র কুরআন মজিদে রোজার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার।” তাক্বওয়া বলতে বুঝায় পাপ বা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা বা পরহেজ করা। কুপ্রবৃত্তি বা নফসের খাহেশাত থেকে আত্মরক্ষা করে বিবেকবোধের উপর, সততা ও ঈমানদারির অটল-অবিচল থাকার সক্ষমতা বা সক্রিয়তা।
সুতরাং রোজা রাখা মানে শুধু না খেয়ে থাকা নয়; বরং রোজা হলো মনকে নিয়ন্ত্রণ করা। মন ভালো ভালো খাবার খেয়ে রসনা তৃপ্ত করতে চায়, ভোগ-বিলাস করতে চায়, রোজা রেখে অলস সময় কাটাতে চায়, সিনেমা, খেলা, গান-বাজনা, ফেসবুক ইত্যাদির মধ্যে ডুবে থেকে সময় পার করতে চায়। আবার কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলা, মানুষকে হয়রানি কিংবা মিথ্যা, প্রতারণা, শঠতা, সুদ, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, খেয়ানত, চাঁদাবাজি, অনৈতিক সুবিধা আদায় বা প্রদানের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ-বিত্তের মালিক হতে চায়। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল ও প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করে লোক দেখানো দান-সদকাও করতে চায়। রোজাদারকে এসব অবস্থায় নিজের মনের লাগাম টেনে ধরতে হয়। কুপ্রবৃত্তির উপর সুপ্রবৃত্তি বা বিবেকবোধ ও ঈমানিয়াতের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হয়। যদিও এটা সহজ কাজ নয়। এর জন্য রীতিমতো সাধনা করতে হয়। এ কারণেই রোজাকে বলা হয় সিয়াম সাধনা বা আত্মশুদ্ধির সংগ্রাম।
ইসলামের পরিভাষায় এ সংগ্রামকেই বলা হয় জিহাদে আকবর বা বড় জিহাদ। আর এর পুরস্কারও তেমনি বড় - “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত একটি হাদীসে রসূল (স:) বলেছেন, আদম সন্তানের প্রতিটি নেক কাজের ফলাফল দশগুণ হতে সাতশত গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করে দেয়া হবে। কিন্তু রোযার ব্যাপারে এর ব্যতিক্রম হবে। কেননা আল্লাহ স্বয়ং বলেন, “বান্দাহ আমার সন্তুষ্টি বিধানের জন্যে রোযা রেখেছে এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দিব। সে তো আমার কথা মতই খানা-পিনা ও কামনা-বাসনা ত্যাগ করেছে।’ রোযাদারের জন্যে আনন্দের সময় হলো দু’টি। একটি হলো ইফতারের সময়, অপরটি হলো (বেহেশতে) আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময়। আর রোজাদারের মুখের ঘ্রাণ আল্লাহর নিকট মেসকের চেয়েও উত্তম। রোযা হলো (শয়তানের হামলা হতে বাঁচার জন্যে) ঢাল স্বরূপ। সুতরাং তোমরা যখন রোজা রাখবে, তখন অশ্লীল কথা বলবে না এবং ঝগড়া-ফাসাদও করবে না। হাঁ কেউ যদি রোজাদারকে গালি দেয়, কিংবা তার সাথে ঝগড়া-ফাসাদ করে তাহলে তার এ বলে জওয়াব দেয়া উচিত যে, আমি রোজাদার।” (বুখারী, মুসলিম)
কিন্তু যারা নফস বা প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হবে তারা রোজার ফযিলত থেকে বঞ্চিত হবে। হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত একটি হাদীসে মহানবী (স:) বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কাজ পরিত্যাগ করতে পারলো না তার শুধু উপবাস থাকায় আল্লাহ’র কোন প্রয়োজন নেই।’ (বুখারী)
হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত আরেকটি হাদীসে মহানবী (স:) বলেছেন-এমন বহু রোজাদার আছে, যাদের রোজা উপবাস ছাড়া আর কিছু নয়। আবার এমন অনেক নামাযী আছে যাদের নামায নিছক রাত্রী জাগরণ ছাড়া আর কিছু নয়।”
রমযানের প্রথম দশ দিন রহমত, দ্বিতীয় দশ দিন বরকত আর তৃতীয় দশ দিনে রয়েছে মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে নাজাত বা মুক্তি লাভের সুযোগ। এ সময়গুলোতে আল্লাহ’র রহমত, বরকত ও মাগফিরাত লাভের আশায় রোজা রেখে একদিকে যেমন গুনাহ থেকে পরহেজ বা বেঁচে থাকতে হয়, তেমনি এ পবিত্র মাসে বেশি বেশি করে নেক আমল বা সওয়াবের কাজ করতে হয়। এক কথায়, পবিত্র রমযান মাসের প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। এ সময়ের একটি নফল আমল অন্য সময়ের ফরজ আমলের সমান। আর এ মাসে একটি ফরজ আমল অন্য সময়ের সত্তরটি ফরজ আমলের সমান মূল্যবান। তাই এ পবিত্র মাসে যত বেশি সম্ভব আগে আগে মসজিদে যেয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামায়াতে পড়ার ব্যাপারে যত্নবান হওয়া উচিত। যেমন-ফরজ নামাযের পাশাপাশি বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন, নফল নামায পড়া (ফরজ নামাযের আগে ও পরে অতিরিক্ত নামায, তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ), বেশি দান-সদকা (বাধ্যতামূলক দান যাকাত ও ফিতরা ছাড়াও অতিরিক্ত দান-সদকা ও উপহার প্রদান) করা, বেশি বেশি তসবিহ তাহলিল ও জিকির আজকার করা, হাদীস পাঠ ও ইসলামী বইপত্র পড়া। এছাড়া যথাসময়ে ও যত্নের সাথে নামায আদায় করার চেষ্টা করা। একটু আগে আগেই মসজিদে চলে যাওয়া, যাতে সুন্নত ও নফল নামাযও মিস না হয়। মসজিদে যেয়ে প্রথমে দুই রাকাত নামায পড়ে নেয়া উচিত। আল্লাহ‘র রসূল এ আমলটি নিয়মিত করতেন এবং সাহাবীদেরকেও করার জন্য উৎসাহিত করতেন।
আর এ মাসে এমন একটি মহিমান্বিত রাত রয়েছে, যে রাতের মর্যাদা সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।’ স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন পবিত্র কুরআন মজিদের একাধিক সূরায় এ রাতের মর্যাদার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি এ বরকতপূর্ণ রাতের নামে একটি স্বতন্ত্র সূরাও নাযিল করেছেন। বলাবাহুল্য, সে রাতটির নাম ‘লাইলাতুল কদর’ বা কদরের রাত। আল্লাহ’র রসূল (স:) জানিয়েছেন, আল্লাহ এই বরকতপূর্ণ রাতটিকে রমযান মাসের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন। তিনি এ বেজোড় রাতগুলোর মধ্যেই ক্বদরের সন্ধান করার নির্দেশ দিয়েছেন। ক্বদর অর্থ ফায়সালা বা সিদ্ধান্ত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ’লা এ মহিমান্বিত রাতেই মানুষের ভাগ্যের এবং সৃষ্টির কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ফায়সালা করেন। এছাড়া ঈমানদারদের জন্য ক্ষমা ও জাহান্নাম থেকে নাজাতের ফায়সালাও করেন। একারণে আল্লাহ’র রাসূল রমযানের শেষ দশ দিন এতেকাফ করতেন। তাঁর অনুসরণে সাহাবীগণও প্রতি রমযানে ইতিকাফ করতেন এবং এখনও আল্লাহ’র প্রিয় বান্দাগণ মাগফিরাত ও নাজাত লাভের আশায় ইতিকাফে বসেন যাতে নিরবচ্ছিনভাবে আল্লাহ‘র স্মরণ ও ইবাদত- বন্দেগীর মধ্যে মশগুল থাকা যায়। আর যারা ইতিকাফে বসার সুযোগ হয় না তাদেরও উচিত যথাসম্ভব নেক আমল ও কল্যাণকর কাজের মধ্যে সম্পৃক্ত থাকার চেষ্টা করা যাতে এ পবিত্র মাসে আল্লাহ’র রহমত, বরকত ও মাগফিরাত লাভের সুযোগ হাতছাড়া না হয়। হযরত আবু হোরায়রা বর্ণিত এবং বুখারী মুসলিম শরীফে সংকলিত হাদীসে নবী করীম (স:) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের (আত্মবিচার/আত্মসমালোচনা) সাথে রমযানের রোযা রাখবে, তার পূর্বকৃত যাবতীয় গুনাহ মাফ করা হবে এবং যে রমযানের রাতে ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে নামায আদায় করবে, তার অতীতের গুনাহসমূহ মাফ করা হবে। আর যে কদরের রাতে ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে ইবাদাত করবে, তার পূর্বকৃত যাবতীয় গুনাহ মাফ করা হবে।” সুতরাং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী প্রত্যেক মানুষের উচিত রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের এই পবিত্র মাসের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানো।
আর এ মাসের ব্যাপারে যারা উদাসীন তাদের উদ্দেশে মহানবী (স:) বলেছেন- “ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি, যে রমযান মাস পেলো, অথচ নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারলো না।” - (তিরমিজি : ৩৫৪৫). সুতরাং, শুধু উপবাস নয়, খোদাভীতি ও আত্মার উন্নয়ন সাধনার মধ্যেই নিহিত রয়েছে রোজার আসল ফযিলত।
কিন্তু রোজাদারকে এ ফযিলত থেকে বিচ্যুত করে ডিজিটাল আসক্তি। বিশেষ করে এর সহজ শিকার হচ্ছে তরুণরা। ডিজিটাল আসক্তি তরুণদের ইচ্ছাশক্তি ও কর্মোদ্দীপনাকে নষ্ট করার পাশাপাশি তাদের মধ্যে অলসতা, অপরিপক্বতা (রসসধঃঁৎরঃু) এবং বিষণ্নতা বৃদ্ধি করছে। এর ফলে শুধু সিয়াম সাধনাই নয়; পড়াশোনা, চিন্তাভাবনা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনাসহ সকল ইতিবাচক ও গঠনমূলক কাজের প্রতি অনাগ্রহ ও অনীহা তৈরি করছে। অথচ অধ্যবসায় ও আত্মগঠনের সবচেয়ে সুন্দর ও উপযুক্ত সময় হল তরুণ-যৌবন কাল। এ সময়টা হল মানব জীবনের সবচেয়ে উত্তম সময়। এ সময়টাতে মানুষের যে কর্মস্পৃহা, উদ্দীপনা ও কর্মক্ষমতা বা শক্তি-সামর্থ্য থাকে তা অন্য সময়ে থাকে না। তরুণ বয়সে যত বেশি ও যত স্বাচ্ছন্দ্যে ইবাদত বন্দেগী বা নেক আমল করা যায় তা অন্য সময়ে করা যায় না।
অথচ এ মূল্যবান সময়টার প্রতিই সবচেয়ে অবহেলা ও অপচয় করা হয়। এ অপচয় আসলে একটা মারাত্মক খেয়ানত। কারণ, তারুণ্য ও যৌবনের এ মূল্যবান সম্পদ মানুষের প্রতি আল্লাহ’র দেয়া এক বিরাট নেয়ামত। আর প্রতিটি নেয়ামত একেকটি আমানত। আল্লাহ কিয়ামতের কঠিন সময়ে প্রতিটি নেয়ামতের হিসাব নেবেন।
রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, ‘হাশরের ময়দানে মানুষকে পাঁচটি বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে-তার মধ্যে একটি প্রশ্ন করা হবে যৌবনকাল কিভাবে কাটিয়েছ সে বিষয়ে’। (বুখারি শরীফ)। প্রিয়নবী (স) আরো বলেছেন, ৫টি জিনিসকে ৫টি জিনিসের পূর্বে গুরুত্বপূর্ণ মনে কর। তার মধ্যে একটি হলো বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনকে।’-(তিরমিজি শরিফ)।
তারুণ্যের আমানতকে ক্ষয়িষ্ণুতার হাত থেকে রক্ষা করতে হলে ডিজিটাল আসক্তি বা অপব্যবহার থেকে মুক্ত হতে হবে। বিশেষ করে স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তি এখন মাদকাসক্তির মতই একটি ভয়াবহ অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই ডিজিটাল ফাস্টিং করার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এসব থেকে বিরত থাকা। এর ফলে ‘আসক্তি’ কাটিয়ে ওঠা সহজ হয়। আর এ ফাস্টিং’র ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে পবিত রমযান মাস।
ডিজিটাল উপবাস বেছে নেয়, যেখানে তারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সমস্ত প্রযুক্তি থেকে বিরত থাকে। অন্যরা তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার সীমিত করতে বেছে নিতে পারে, যেমন শুধুমাত্র জরুরি অবস্থার জন্য স্মার্টফোন ব্যবহার করা অথবা প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে ইমেল চেক না করা।
লেখক : সাংবাদিক।