কলাম
রাজধানীতে মশার উপদ্রব
শীত বিদায় নিয়ে সবে উষ্ণতা ছড়াতে শুরু করেছে প্রকৃতিতে। এর মধ্যেই রাজধানী ঢাকায় সম্প্রতি মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই বাড়তে থাকে মশার উপদ্রব। গবেষণা বলছে, গত বছরের তুলনায় এবার মশা বেড়েছে ১২ গুণ।
Printed Edition
॥ নাদিরা হক অর্পা ॥
শীত বিদায় নিয়ে সবে উষ্ণতা ছড়াতে শুরু করেছে প্রকৃতিতে। এর মধ্যেই রাজধানী ঢাকায় সম্প্রতি মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই বাড়তে থাকে মশার উপদ্রব। গবেষণা বলছে, গত বছরের তুলনায় এবার মশা বেড়েছে ১২ গুণ। গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু সংক্রমণ ভুগিয়েছে দেশবাসীকে। সিটি করপোরেশনগুলোতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার ছিল বেশি। ডেঙ্গুর সংক্রমণ একটু কমতে শুরু করলেই সদর্পে হাজির হয় কিউলেক্স মশা। মশার উপদ্রব এত বেড়েছে যে তা অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলছে খোদ সিটি করপোরেশন। বিশেষ করে কিউলেক্স মশার সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে নগরবাসী। মশার এ উপদ্রবে শুধু ঘুমের ব্যাঘাতই হচ্ছে না; ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও চিকুনগুনিয়ার মতো রোগের ঝুঁকিও বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে।
আবার, খানাখন্দে ভরা পুরান ঢাকার রাস্তাঘাট সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেই। স্ট্রিট লাইট জ্বলে না, জলাবদ্ধতা ও নালা-নর্দমা এবং ড্রেনের নোংরা পানি কে দূর করবে। সিটি করপোরেশনের ডিপ ড্রেনভর্তি মশা কিলবিল করছে। মশার ওষুধের কোনো খবর নেই। মশার যন্ত্রণায় ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো ঘরে বসে লেখাপড়া করতে পারছে না। মশার কয়েল স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক। প্রতিনিয়ত ডেঙ্গু প্রতিরোধে মহল্লা বা বাসিন্দাদের চিন্তা দূর হচ্ছে না। পুরান ঢাকায় প্রতিবছরই মশাবাহিত রোগের প্রকোপ লেগেই আছে। প্রশাসনিক প্রচেষ্টার অভাবে ঢাকাবাসীর দুর্ভোগ লেগেই আছে।
মশক নিধন কার্যক্রম কখনোই খুব শক্তিশালী ছিল না ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে। কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও তাই এর সুফল সেভাবে পায় না নগরবাসী। প্রতি বছর মশা নিয়ন্ত্রণে নানা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ কম।ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃক মশার ওষুধ নিয়মিত ছিটানো হয় না বা মশা নিধনে কার্যকর কোনো ভূমিকা না থাকার কারণে মশা এখন আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। দিন দিন মশার উপদ্রব বাড়ছে। আগে নগরীতে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হতো। মশার জন্মরোধের ব্যবস্থা ও মশার উপদ্রব নিবারণের জন্য সর্বোত্তম যা যা করণীয়, তা এখনই জরুরিভাবে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনকে করতে হবে।কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগ পর্যন্ত মশক নিধন কার্যক্রম ঠিকমতোই চলছিল। তবে তার পর থেকে মেয়র বা কাউন্সিলর না থাকায় এই কার্যক্রম স্থবির পড়ে। এখন যারা মশার ওষুধ ছিটান, তাদের তেমন কোনো জবাবদিহি নেই। ফলে ডেঙ্গুর পাশাপাশি কিউলেক্স মশাও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে সারাদেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হন ১ লাখ ১,২১৪ জন। বছরজুড়ে এ রোগে প্রাণ হারান ৫৭৫ জন। দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার অনেক বেশি।
সম্প্রতি মশার বাড়বাড়ন্ত নিয়ে নগরবাসীর অভিযোগ, কিউলেক্স মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন তারা। মশা নিধনে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কেউ। আগে সপ্তাহে একবার মশার ওষুধ ছিটালেও এখন এক মাসেও তাদের দেখা মেলা ভার। ফলে দিন-রাত বাসাবাড়িতে মশায় কামড়ায়। সারাদিন বাসায় কয়েল জ্বালিয়ে বা মশারি টানিয়ে রাখতে হয়।
তবে এসব অভিযোগ পাশ কাটিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) দাবি, মশা নিধনে তারা প্রতিদিনই ওষুধ ছিটায় এবং এ বিষয়ে বিভিন্ন অভিযানও অব্যাহত আছে। এমনকি মানুষকে সচেতন করতে নানা সময় জরিমানাও করা হচ্ছে, কিন্তু যে হারে মশার উপদ্রব বাড়ছে, তা নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে দাবি তাদের। আবার, এডিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে বছরব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বলে জানিয়েছে ডিএসসিসি। তাদের দাবি, সে অনুযায়ী কার্যক্রমও চলছে। তারপরও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এজন্য ২০ থেকে ৩১ জানুয়ারি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করেছে তারা।
ডিএসসিসি সূত্র জানায়, মশা নিধনে ডিএসসিসি চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রেখেছে ৪৪ কোটি টাকা। তবে প্রয়োজনে বরাদ্ধ আরও বাড়ানো হবে। মশা নিধনে ডিএসসিসির কার্যক্রম অব্যাহত আছে জানানো হলেও বাস্তবে তেমন কোনো কর্মকা- চোখে পড়েনি। ৫ আগস্টের পর থেকে মশক নিধন অভিযান চললেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন,“জানুয়ারি মাসের শুরু থেকে নগরীতে কিউলেক্স মশা বাড়ছে। এভাবে আগামী মার্চ পর্যন্ত মশা বাড়বে। মশা বৃদ্ধি পাওয়ায় নগরবাসীর কষ্ট সহজেই অনুমান করা যায়। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে দুই সিটি কর্পোরেশনের উচিত ডেঙ্গুর মতো কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণেও পদক্ষেপ নেওয়া। তা-না করলে এ বছর রোগীর সংখ্যাও বাড়বে।”
মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে নগরবাসী বারবার প্রশ্ন তুললেও এ বিষয়ে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। এ অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পেতে নগরবাসীর নিজেদেরই সচেতন হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তবে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় এবং নগরবাসীকে সঙ্গে নিয়ে সরকার ও সিটি কর্পোরেশন সম্মিলিত উদ্যোগ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করলেই মিলবে সত্যিকারের সমাধান। আর এমন কিছুরই আশায় দিন-রাত মশার কামড় সহ্য করে চলেছে রাজধানীতে বসবাসরত বিপুল জনগোষ্ঠী।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।