আফসানা আক্তার আফসানা
ঢাকার ফুটপাত-নামেই বোঝায় পথচারীদের হাঁটার জায়গা। কিন্তু আজ সে ফুটপাতই যেন পথচারীদের নয়, দোকানি আর দখলদারদের সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ রাজধানী ঢাকায় সড়ক আছে, ফুটপাত আছে-কিন্তু নেই হাঁটার পরিবেশ। বাংলাদেশের রাজধানীর ব্যস্ত সড়কগুলোতে এখন ফুটপাতের চেয়ে বেশি দেখা যায় অবৈধ দোকান, হকার, পণ্য রাখার র্যাক বা নির্মাণ সামগ্রী। শহরের সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় হাঁটে, আর তাতে প্রতিদিনই ঘটে দুর্ঘটনা। নগর জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ যেন আটকে আছে ফুটপাত দখলের বেআইনি বাস্তবতায়।
সেগুনবাগিচা থেকে বায়তুল মোকাররম, জিরো পয়েন্ট, গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, নিউমার্কেট, সায়েন্স ল্যাব, মিরপুর-১০ থেকে ১৪ নম্বর পর্যন্ত প্রায় সব জায়গাতেই একই দৃশ্য। গুলিস্তানের বিভিন্ন ফুটপাতের ৯৫ শতাংশই পথচারীদের চলাচলের অনুপযোগী। মিরপুর ১০ থেকে ১৪ নম্বর এলাকার প্রায় এক কিলোমিটার ফুটপাত পুরোপুরি বেদখল। হকারদের দখলে থাকা এসব দোকান সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চালু থাকে। অনেক জায়গায় সড়ক পর্যন্ত দখল হয়ে গেছে। কলম, খেলনা, কাপড়, ব্যাগসহ নানা পণ্য এ পথে বিক্রি হলেও পথচারীর হাঁটার কোনো জায়গা নেই। অধিকাংশ জায়গাতেই পাঁচ ফুটের ফুটপাতের দু’পাশে দোকান বসিয়ে মাঝখানে এক থেকে দেড় ফুট জায়গা রেখেই চলছে পথচারীদের পারাপার। কোথাও আবার পথচারীদের চলাচলের জন্য একটুও ফাঁকা জায়গা রাখা হয়নি। আবার অনেক জায়গায় গড়ে উঠেছে ইটের গাঁথা স্থায়ী দোকান। আবার কোথাও কোথাও নার্সারি, বিদ্যুৎ বা টেলিফোনের খুঁটি, ফুট ওভারব্রিজের সিঁড়ি, পুলিশ বক্স স্থাপন করে সংকীর্ণ করা হয়েছে সাধারণ মানুষের যাতায়াতের জন্য তৈরি করা ফুটপাতকে। আবার কলাবাগান শিশু পার্কের সামনে ফুটপাতের ওপর ময়লাবাহী ভ্যান, আবর্জনার স্তূপ ও ডিএসসিসির বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্রের দুর্গন্ধ পথচারীদের চলাচলকে অসম্ভব করে তুলেছে।
সিটি করপোরেশনের পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীর ১০৮ কিলোমিটার ফুটপাত বিভিন্ন প্রভাবশালীর দখলে। ২ হাজার ২৯০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৫৭২ কিলোমিটারে চলে পণ্যের পসরা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) তথ্য মতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ২৩৬টি উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে ২১৫টি মামলায় ৪৫৯ ব্যক্তিকে দণ্ডিত করা হয়েছে এবং জরিমানা আদায় হয়েছে ছয় লাখ ৫৯ হাজার ৬০০ টাকা। এ সময় ২ হাজার ১৭০টি অস্থায়ী এবং ৫২টি স্থায়ী অবকাঠামো উচ্ছেদ করে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার এলাকা দখলমুক্ত করা হয়েছে।
তবুও ডিএনসিসির ২২৩ কিলোমিটার ফুটপাতের বেশির ভাগ এখনো বেদখল।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকার অবস্থা আরো খারাপ। গত ১২ মাসে (আগস্ট ২০২৪ থেকে আগস্ট ২০২৫) ৭০টি অভিযানে ৭৮টি মামলা দিয়ে মাত্র এক লাখ ৭৬ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
ফুটপাত দখলের পেছনে রয়েছে বহুস্তরীয় কারণ। প্রথমত, নগর কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও নিয়মিত তদারকির অভাব। মাঝে মাঝে হকার উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলেও, কয়েকদিন পরই তারা ফিরে আসে আগের জায়গায়। দ্বিতীয়ত, নিম্নবিত্ত শ্রেণির জীবিকার সংকটও একটি বড় কারণ। অনেকেই বিকল্প আয়ের পথ না পেয়ে ফুটপাতেই দোকান বসান। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও ঘুষের সংস্কৃতি এ দখলবাজিকে আরও শক্তিশালী করেছে। স্থানীয় প্রভাবশালী মহল থেকে শুরু করে কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-সবাই মিলে ফুটপাত দখলের এই চক্রকে টিকিয়ে রেখেছে। এর পাশাপাশি, নগর পরিকল্পনার দুর্বলতা এবং বিকল্প বাজার স্থাপনের অভাবও পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। যেসব স্থানে হকারদের জন্য নির্দিষ্ট মার্কেট করার কথা ছিল, সেগুলো এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। ফলাফল ফুটপাতের উপরই বেচাকেনা, আর মানুষ হাঁটে মূল রাস্তায়।
ফুটপাত দখল থেকে ঢাকাকে মুক্ত করতে হলে সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, সরকারের পক্ষ থেকে একটি টেকসই পুনর্বাসন পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি। হকারদের জোর করে উচ্ছেদ না করে, তাদের জন্য আলাদা নির্দিষ্ট মার্কেট বা সময়ভিত্তিক বিক্রির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেমন ব্যস্ত সময়ের বাইরে নির্দিষ্ট এলাকায় দোকান বসানোর অনুমতি দেওয়া। দ্বিতীয়ত, নগর কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত তদারকি ও মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে, যাতে উচ্ছেদ অভিযানের পর দখলকারীরা আবার ফিরে না আসে। সিসিটিভি নজরদারি, ডিজিটাল ম্যাপিং এবং নাগরিক অভিযোগ গ্রহণের ব্যবস্থা চালু করলে অনেক অনিয়ম ধরা পড়বে। তৃতীয়ত, নাগরিক সচেতনতা বাড়ানোও অপরিহার্য। মানুষকে বুঝতে হবে যে ফুটপাত শুধু হাঁটার জায়গা নয়, এটি নগরের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার প্রতীক। পথচারীদের চলাচল সহজ না হলে যানজট ও দুর্ঘটনা বাড়বেই। চতুর্থত, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনো দখলদার বা হকার যাতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আবার জায়গা না নিতে পারে, সেদিকে কর্তৃপক্ষকে কঠোর নজর রাখতে হবে। সবশেষে, শহর পরিকল্পনায় “ওয়াকওয়ে সংস্কৃতি” চালু করতে হবে—যেখানে প্রতিটি এলাকায় নির্দিষ্ট দূরত্বে পর্যাপ্ত ফুটপাত থাকবে, গাছপালা ও আলো থাকবে, যাতে মানুষ হাঁটাকে নিরাপদ ও আরামদায়ক মনে করে।
ফুটপাত কেবল হাঁটার জায়গা নয়-এটি এক শহরের সভ্যতার প্রতীক। যে শহরের মানুষ নিজের পথে হাঁটার অধিকার হারায়, সে শহর ধীরে ধীরে মানুষ হারায়। ঢাকাকে আমরা আধুনিক শহরে রূপ দিতে চাই, কিন্তু আধুনিকতা আসে না শুধু উঁচু বিল্ডিং আর ফ্লাইওভার দিয়ে; আসে নাগরিক শৃঙ্খলা, দায়বদ্ধতা ও মানবিক পরিকল্পনার মাধ্যমে। ফুটপাত ফিরে পেলে ঢাকা হাঁটতে শিখবে আবার আর যখন মানুষ হাঁটে, তখনই শহর বাঁচে।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।