শেষ কিস্তি
আগেই বলেছি ইস্তাম্বুলে বাংলাদেশী ছাত্রদের ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনান্টাল স্টাডিজ নামে একটি গবেষণা সংস্থা গঠন করে (তুর্কী ভাষায় হাকামের) বাংলাদেশ, ভারত ও পাকস্তিানের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ক্রমবিকাশ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিকাশমান ধারা এবং দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে তাদের পারস্পরিক সহযোগিতা প্রভৃতি বিষয়ে অগ্রাধিকারভিত্তিক বেশ কিছু কাজে হাত দিয়েছে। ইসলামী মূল্যবোধ ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ তরুণ প্রজন্মের আমাদের এ সন্তানরা শিকড় সন্ধান করছেন এবং আদর্শ ও ঐতিহ্যকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে গুঢ় সত্যগুলোর নির্মোহ আলোচনা-পর্যালোচনার উদ্যোগ নিয়েছেন দেখে বুকটা ফুলে উঠলো। তারা আমার কাছ থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, জামায়াত ও ইসলামপন্থী দলগুলোর তৎকালীন ভূমিকা এবং রাজাকার, আলবদর প্রসঙ্গটি সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে জানতে চাইলেন এবং তাদের অনুরোধে আমি প্রায় ঘণ্টাব্যাপী একটি ভিডিও সাক্ষাৎকারে অংশগ্রহণ করি। বলাবাহুল্য, ১৯৭১ সালে আমি তৎকালীন দৈনিক পূর্বদেশের (অবজার্ভার গ্রুপের অন্যতম বাংলা দৈনিক) সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত থাকার পাশাপাশি তৎকাীন কায়েদে আজম কলেজের (বর্তমানে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দি কলেজ) বাণিজ্য বিভাগের একজন অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলাম।
১৯৭২ সালে সরকারি চাকরিতে যোগদানের পূীর্ব পর্যন্ত আমি উভয় পদে কর্মরত ছিলাম। এর আগে ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা শাস্ত্রে এমকম ডিগ্রি নেয়ার অব্যবহিত পর থেকেই প্রথমে কায়েদে আজম কলেজ ও পরে পূর্ব দেশে যোগদান করি। রাজধানীর শিক্ষায়তনগুলোতে পড়ালেখা ও ইসলামী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্তির কারণে ষাটের দশকের সকল রাজনৈতিক তৎপরতা ও সংগ্রামী কর্মসূচিসমূহের বাস্তবায়ন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমি পেয়েছি।
একতাত্তরের রাজনীতিতে রাজাকার প্রসঙ্গটি গত ৫৪ বছর ধরে একটি পীড়াদায়ক অধ্যায়ের সৃষ্টি করে রেখেছে। রাজনীতিতে কাউকে অপছন্দ করলে; বিশেষ করে ইসলামী শক্তিকে দাবিয়ে রাখা বা তাদের উত্থান রোধ করার জন্য স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির দাবিদার আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে দোষারোপ করে আসছে। দাড়ি-টুপিধারী নামাযী মুসল্লিদের রাজাকার নামে গালি দেয়া কিংবা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের রাজাকার বলা একটা ফ্যাসনে পরিণত হয়েছে। পতিত আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা যেমন রাজাকার শব্দটিকে জামায়াত-শিবিরের পরিপূরক শব্দে পরিণত করে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত চব্বিশের মুক্তিযোদ্ধাদের তাড়া খেয়ে পালিয়েছে। এ মুক্তিযোদ্ধারা ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান দিয়ে এ শব্দটিকে নিজেরা ধারণ করে নিয়েছিলেন।
জামায়াত মানে দালাল, রাজাকার। এ প্রজন্মের মানুষ জানে না ১৯৭০-৭১ সালে জামায়াতের ক্ষমতা বা শক্তি বলতে কী ছিল। জামায়াত কি পাকিস্তান অথবা তার অঙ্গীভূত কোনো প্রদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল? পূর্ব পাকিস্তান, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধু প্রদেশ নিয়ে ছিল পাকিস্তানের গঠন। তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ছিল মুসলিম লীগ (তিন গ্রুপ), জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি, আওয়ামী লীগ (দুই গ্রুপ), ওলামায়ে পাকিস্তান, পাকিস্তন ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ন্যাপ (দুই গ্রুপ), জাতীয় কংগ্রেস, জাতীয় দল, কৃষক শ্রমিক পার্টি (কেএসপি), পাকিস্তান দরদী সংঘ (এ.টি সাদী), ইত্তেহাদুল উম্মাহ এবং জামায়াতে ইসলামী। পাকিস্তানের ২৪ বছর মেয়াদের মধ্যে কেন্দ্রে এবং প্রদেশসমূহে যারা শাসন করেছেন তাদের মধ্যে এক নম্বরে রয়েছে মুসলিম লীগ, দু’নম্বরে আওয়ামী লীগ এবং তিন নম্বরে নেজামে ইসলাম পার্টি। আওয়ামী লীগ নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে সর্বদা স্বায়ত্তশাসনের জন্য সোচ্চার এ দলটির প্রধানমন্ত্রীত্বকালে জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত শাসন সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানকে আটানব্বই ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়ে গেছে, আর দুই ভাগ দিলে দেশ থাকবে না।
যা আমি বলছিলাম, পাকিস্তান আমলে জামায়াতে ইসলামী এ অঞ্চলে অতি ক্ষুদ্র একটি দল ছিল। আমার যতদূর মনে পড়ে ঐ সময়ে জামায়াতের রুকন সংখ্যা ছিল অনূর্ধ্ব ৩০০ এবং মুত্তাফিক বা সহযোগী সদস্য সংখ্যা ছিল ১০/১১ হাজারের মতো। তখন এ অঞ্চলে জেলার সংখ্যা ছিল ১৬টি। এ ষোলটি জেলার মধ্যে ৭টি জেলাতেই জামায়াতের কোনো অফিস ছিল না। জামায়াতের ছিল আদর্শিক ও ঈমানী শক্তি। যার তিন দফা দাওয়াত ও চার দফা কর্মসূচি সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টিতে সমাজে গুরুত্বপূণর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং তাগুতি শক্তির বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ-উত্তরকালে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের অত্যাচারে জর্জরিত পাকিস্তান আমলের অপরাপর দলগুলে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জামায়াত টিকে আছে। কথায় আছে দশ চক্রে ভগবান ভুত হয়। জামায়াতকে ভুত বানিয়ে নিশ্চিহ্ন করার জন্য শুধু আওয়ামী লীগ ও তার দোসররাই তৎপর নয়, প্রতিবেশী একটি দেশও তার বিরুদ্ধে তৎপর রয়েছে।
আমি নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের কথা বলছিলাম। এ ইতিহাস রচনার উপাদান সংগ্রহের কাজ খুব কঠিন। ঘটনা ঘটার সাথে সাথে যা লিপিবদ্ধ হয় তাতে আবেগ পক্ষপাতিত্ব ও একদেশদর্শিতার যে প্রভাব পড়ে তা প্রকৃত সত্যকে নানাভাবে আড়াল করে ফেলে। আবার যারা ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন তারা যদি হন প্রতিহিংসাপরায়ণ তাহলে তো কথাই নেই। কথায় বলে ইতিহাস রচিত হয় তরবারির প্রভাবে। তাই ইতিহাসকে তরবারির প্রভাব ও বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করতে হলে নির্মোহ গবেষণার জন্য ধৈর্য্যরে সাথে পর্যাপ্ত সময় পার করতে হয়। এ সময়টির সীমারেখা সাক্ষীদের জীবিত থাকা পর্যন্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। সময়ের পরিক্রমায় বিতর্কের চুলচেরা বিশ্লেষণ থেকে বেরিয়ে আসে প্রয়োজনীয় সত্যটুকু। মোহতাড়িত অর্ধসত্য বা ভেজাল সত্যের বিভ্রান্তির চাইতে নির্মোহ গবেষণালব্ধ প্রকৃত সত্যের স্বল্প পারিসর ক্ষুদ্রতা অনেক বেশি কল্যাণবহ। বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক সত্য চুয়ান্ন বছর ধরে ক্ষমতা ও স্বেচ্ছাচারিতার কবলে নিষ্পেষিত হয়ে আসছে।
এখন রাজাকারের হাকিকত প্রসঙ্গে আসি। রাজাকার শব্দটি ১৯৭১ সালের সামরিক শাসকদের ব্রেইন চাইল্ড ছিল। তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোণা মহকুমায় লে. কর্নেল গোলাম সারওয়ার নামে একজন সাব মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটার ছিলেন। মে মাসের ২৭ তারিখে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় তিনি সর্বপ্রথম বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা বৃদ্ধি, পুল কালভার্ট, সরকারি স্থাপনার ওপর সশস্ত্র হামলা, অগ্নিসংযোগ ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ওপর গুলি এবং বোমা নিক্ষেপের ঘটনা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সভাকে জানান যে, মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র সজ্জিত পক্ষান্তরে স্থাপনা পাহারার কাজে নিয়োজিত আনসাররা অস্ত্রসজ্জিত নয়। তাদেরকে লাঠি দিয়ে অস্ত্রের মোকাবেলা করতে হয়। সভায় উপস্থিত থানাসমূহের সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন)বৃন্দ, পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের কাছে তিনি প্রস্তাব দেন যে, আনসারদের পরিবর্তে যদি রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়, তাদের মাসিক নির্ধারিত হারে বেতন ও রেশন সুবিধাদি এবং অস্ত্রসজ্জিত করা হয় তাহলে পরিস্থিতির মোকাবেলা করা সহজ হবে। তার প্রস্তাবটি ব্যাপকভাবে সমর্থন লাভ করে। স্থির হয় যে, নেত্রকোনার মহকুমা প্রশাসক এবং সাব-মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটার যৌথভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আনসার বাহিনীর স্থলে রাজাকার বাহিনী নিয়োগের একটি আইনি ভিত্তি তৈরির জন্য সরকারকে অনুরোধ করবেন। বলাবাহুল্য, রেজাকার বা রাজাকার শব্দটি ফ্যার্সি, এর অর্থ স্বেচ্ছাসেবক।
যেমন পরিকল্পনা তেমনি কাজ। নেত্রকোনা মহকুমার এ প্রস্তাবটি বিধি অনুযায়ী ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের নিকট প্রেরণ করা হয়। এখানে একটি কথা বলে রাখি, উপমহাদেশে সিভিল প্রশাসনকে সহযোগিতা করার জন্য রাজাকার গঠনের এটাই প্রথম ঘটনা নয়, বরং দ্বিতীয় ঘটনা। ১৯৪৭ সালে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণার সময় দেশ ভাগের নীতিমালা অনুযায়ী দেশীয় রাজ্যগুলোর রাজাদের ওপর হিন্দুস্তান বা পাকিস্তানে যোগদানের অপসন দেয়া হয়েছিল। এ হিসাবে হায়দরাবাদের নিজাম পাকিস্তানে যোগ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় তাদের প্রতিহত করার জন্য তিনি রাজাকার বাহিনী গঠন করেছিলেন।
যাহাক, নেত্রকোণার রাজাকার গঠনের প্রস্তাবটি জেলা প্রশাসকের দফতরে আসার পর জেলা প্রশাসক বিষয়টি পরীক্ষান্তে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে তাকে অবহিত করার জন্য তার দপ্তরে কর্মরত একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (জেনারেল) জনাব মহিউদ্দিন আলমগীরের নিকট প্রেরণ করেন। এডিসি জনাব আলমগীর প্রস্তাবটির সম্ভাব্যতাকে বাস্তব ও সময়োপযোগী মন্তব্য করে রিপোর্ট দেন। রিপোর্টটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করার পর জুন মাসের পয়লা তারিখে এ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অধ্যাদেশ জারি করা হয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব এর আলোকে সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন)কে ঢোল মহরত ও স্থানীয় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে রাজাকার নিয়োগের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। চাকরির অন্যন্য শর্তাবলীর মধ্যে সরকারি স্থাপনা পাহারা, আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণে সরকারকে সহায়তা করা, চৌকিদারি ট্যাক্স, ভূমি উন্নয়নকর ও খাজনা আদায়ে সাহায্য করা এবং জনগণের নিরাপত্তা বিধান প্রভৃতি ছিল তাদের কাজ। তাদের বেতন নির্ধারণ হয় মাসিক ৯,৩.০০ টাকা এবং তাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ন্যায় রেশন প্রদান করা হতো। প্রদেশের সুবিধাবঞ্চিত গরিব ও অর্ধশিক্ষিত বেকার যুবকরা এই বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। এদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। এ বাহিনী গঠন ও নিয়োগের সাতে জামায়াত বা অন্য কোনো রাজনৈতক দলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো সম্পর্ক ছিল না। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী সমর্থকরা রাজাকার বাহিনীতে যে যোগদান করেননি তা নয়। বেকারত্ব নিরসন, জনগণ ও সরকারি সম্পত্তির নিরাপত্তার জন্য তা করেছেন। বাহিনীটি যেমন ভালো কাজ করেছে তেমনি খারাপ কাজ যে মোটেই করেনি তা নয়। তবে এর গঠন ও অপকর্মের দায় জামায়াতের ওপর চাপানো অযৌক্তিক ও সম্পূর্ণভাবে অন্যায়। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের প্রথমদিকে খুলনায় অনুষ্ঠিত রাজাকারদের এক প্রশিক্ষণ কর্মশালা উদ্বোধনে তৎকালীন প্রাদেশিক রাজস্বমন্ত্রী মাওলানা একেএম ইউসুফ উপস্থিত ছিলেন। তিনি জামায়াতের একজন সাবেক এমএনএ ছিলেন। এসব ঘটনা তৎকালীন পত্রপত্রিকা ও রেডিও-টেলিভিশনে প্রকাশিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব গাঁথা; বিশেষ করে কোথায় কোন স্থাপনা উড়িয়ে দিয়েছে কাকে হত্যা করেছে, কোন ট্রেন বা যাত্রী ও মালবাহী পরিবহন ধ্বংস করেছে এসবও ব্যাপকভাবে প্রচার করা হতো। মাওলানা ইউসুফের তৎপরতাকে বিকৃত করে রাজাকারের ‘কালিমা’ জামায়াতের ওপর আরোপ করা ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। পক্ষান্তরে রাজাকার বাহিনীতে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীদের অনুপ্রবেশ ছিল ব্যাপক আকারে। এজন্য খুলনার দানবীর নামে কথিত আইয়ুব মন্ত্রিসভার দীর্ঘকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, খান আবদুস সবুর খান ছিলেন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। ’৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করে এর তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে ঐ মাসের ২৪ তারিখে আওয়ামীপন্থী রাজাকারদের অপকর্মের ওপর দৈনিক পূর্ব দেশে তিন পৃষ্ঠাব্যাপী বিরাট একটি সম্পাদকীয় লেখা হয়েছিল।
রাজাকারে আওয়ামী আধিক্যের আরো প্রমাণ ছিল। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তান সংকটের ওপর প্রকাশিত শ্বেতপত্রে আওয়ামী লীগের যে অপরাধগুলো বর্ণনা করা হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম অপরাধ ছিল পদচ্যুত কিছু সামরিক জওয়ান, ইপিআর ও সশস্ত্র রাজাকারদের সংগঠিত করে দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। শেখ হাসিনার আমলে তার মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ১০ হাজর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় দলওয়ারী বিভাজন লক্ষ্য করলেই এ কথাটি সহজে বোঝা যাবে। এতে দেখা যায় যে, ১০ হাজার রাজাকারের মধ্যে ৮৭০০ জনই আওয়ামী লীগের, জামায়াতের মাত্র ৩৭ জন, বাকিরা অন্যান্য দলের। উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর এটি একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
আল বদর, আল সামস ও বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কেও এই প্রজন্মের অনেকেই প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অনেকটা অজ্ঞ। এ প্রেক্ষিতে আগামীতে আমি এ ব্যাপারে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনার আশা রাখি।