বিশ্বের প্রতিটি দেশের রয়েছে নিজস্ব ভাষা। আমাদের ভাষা বাংলা, যা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রদত্ত এক মহা নিয়ামত। কারণ ভাষাই মানুষকে দিয়েছে ভাব প্রকাশ, যোগাযোগ ও জ্ঞান আহরণের শক্তি। বাংলা শেখা যেমন অপরাধ নয়, তেমনি ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষা শেখাও কোনো অপরাধ নয়। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজি আজ বিশ্বের জনপ্রিয় ভাষায় পরিণত হয়েছে। বিশ্বের প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ ইংরেজিতে কথা বলে। অথচ আমাদের দেশে ইংরেজি শিক্ষার মান মোটেও সন্তোষজনক নয়! সুইডেনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘এডুকেশন ফাস্ট’ প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী মানুষের দক্ষতার মান নির্ধারণ করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমেই নিম্নমুখী। গত ৭ অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলো শিরোনাম করেছেÑ মাধ্যমিক শিক্ষা-২ : ইংরেজি-গণিতে দুর্বল শিক্ষার্থী বেড়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) গবেষণা বলছে, ২০১৯ সালে অষ্টম শ্রেণিতে গণিতে দুর্বল শিক্ষার্থীর হার ছিল ২২ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে বেড়ে ৪৭ শতাংশে পৌঁছেছে। ইংরেজিতেও পরিস্থিতি একই রকম। দেশের ৯৯৯টি বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ৬০ হাজার শিক্ষার্থীর ওপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্যসূচি অনুযায়ী শেখার কথা থাকলেও তা পারছে না। শিক্ষাজীবনে ১২ বছরের বেশি ইংরেজি পড়েও অনেকে ভাষাটি সাধারণ কথোপকথন চালাতে পারে না। সাধারণ বাক্য গঠনে হিমশিম খায়। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফল বিপর্যয় হলে ইংরেজি বিষয়কে মূল কারণ হিসেবে ধরা হয়। তারপরও ইংরেজি শিক্ষার মান বাড়ানোর বিষয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ চোখে পড়ে না।

পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল, শিক্ষা খাতে বাস্তব পরিবর্তন আসবে। আলু, ডাল বা খিচুড়ি রান্না শেখানোর মতো তুচ্ছ বিষয়ের বদলে বাস্তবধর্মী ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের সন্তানরা আলোকিত নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তেমন কিছুই হয়নি, বরং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। অথচ একটি দেশের জনশক্তিকে প্রকৃত জনসম্পদে পরিণত করতে মানসম্মত শিক্ষার বিকল্প নেই। মানসম্মত শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি কখনোই উন্নত জাতিতে পরিণত হতে পারে না। আজকের আধুনিক সভ্যতায় যারা সুপার পাওয়ার হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তারা সকলেই শিক্ষা ক্ষেত্রে অত্যন্ত অগ্রসর। কিন্তু আমরা এক হতভাগ্য জাতিÑ শিক্ষার উন্নয়ন তো দূরের কথা, এখনো পর্যন্ত ইংরেজিভীতি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আমাদের স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ভয় পায় ইংরেজি বিষয়ে। কেন তারা ভয় পায়, বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য আর যোগ্য ও সুনাগরিক তৈরি করা নয়, বরং তা ক্রমেই বাণিজ্যিকীকরণের পথে ধাবিত হচ্ছে। অথচ শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। স্বাধীনতার পর থেকে আশির দশক পর্যন্ত যারা পড়াশোনা করেছেন, তাদের অধিকাংশই কোনো প্রাইভেট টিউটর ছাড়াই লেখাপড়া করেছেন। তারা নিজের যোগ্যতায় ভালো ইংরেজি শিখেছিলেন। তখন শিক্ষকতা ছিল এক মহৎ পেশাÑ বাণিজ্য নয়। কিন্তু এখন শিক্ষা পরিণত হয়েছে বাণিজ্যের পণ্যে। শিশুশ্রেণি থেকে শুরু করে মাস্টার্স পর্যন্ত প্রাইভেট টিউশন ছাড়া টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। যেখানে একসময় স্কুলের ক্লাস ছিল শিক্ষার মূল ভরসা, সেখানে এখন প্রাইভেট কোচিংই হয়ে উঠেছে শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু।

পাঠ্যপুস্তকের বদলে নোট-গাইড বই এখন মাধ্যমিক শিক্ষার প্রধান ভরসা। একশ্রেণির কিছু শিক্ষক প্রকাশনী বাণিজ্যের সঙ্গে যোগসাজশ করে শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট নোট-গাইড কিনতে বাধ্য করেন। প্রতি বছর ইংরেজি বই পরিবর্তনের এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। সব স্কুলে একই ধরনের গ্রামার বইও পড়ানো হয় না। অথচ সরকার চাইলে কঠোরভাবে নির্দেশনা দিয়ে সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই মানসম্পন্ন গ্রামার বই পড়ানোর ব্যবস্থা করতে পারে। প্রয়োজনে আংশিক পরিবর্তন আনা যেতে পারে, কিন্তু প্রতি বছর বই পরিবর্তনের এ অযৌক্তিক প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। স্বাধীনতার পর একাধিক শিক্ষা কমিশন গঠিত হলেও শিক্ষার মানোন্নয়নে কার্যকর পরিবর্তন আসেনি। এখন সময় এসেছে একটি ‘ইংরেজি দক্ষতা উন্নয়ন কমিশন’ গঠনের, যা প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত ইরেজি শিক্ষার মানোন্নয়নে বাস্তবধর্মী নীতি প্রণয়ন করবে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে মাস্টার্স পর্যন্ত সব স্তরে ইংরেজি বই বাধ্যতামূলক করতে হবে। পাশাপাশি গল্প, কবিতা, ছড়া ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সহায়ক কার্টুন ও মুভির মাধ্যমে ইংরেজি শিক্ষাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। সব শ্রেণিতে উপযুক্ত শব্দভাণ্ডার শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে, যেন শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে ভাষার ভীত মজবুত করতে পারে। ইংরেজি ভাষাকে কঠিন করে নয়, বরং সহজ, প্রাঞ্জল ও আনন্দ দায়কভাবে পাঠদান নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি।

আমাদের দেশে বিদ্যমান নানা সমস্যার মধ্যে শিক্ষার সংকট অন্যতম। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই শিক্ষার মানোন্নয়নে বড় ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে ভয়াবহ বৈষম্য দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। গরিব পরিবারের সন্তানরা ভালো মানের শিক্ষা থেকে ক্রমেই বঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৯ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৮১ লাখের বেশি শিক্ষার্র্থী অধ্যয়ন করছে। কিন্তু পাঠদানের মান সর্বত্র সমান নয়। শহর ও গ্রামের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক গভীর পার্থক্য বিদ্যমান। শহরের শিক্ষার্থীরা যেখানে কোচিং সেন্টার ও গৃহশিক্ষকের সুবিধা পাচ্ছে, সেখানে গ্রামের শিক্ষার্থীরা তা থেকে বঞ্চিত। ফলে আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা এগিয়ে যাচ্ছে আর দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে। এর পরও শিক্ষা ব্যয় লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবারের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে প্রাথমিক পর্যায়ে ২৫ শতাংশ ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার বড় অংশই কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনের খরচ। জাতিসংঘের শিক্ষা সংস্থা ইউনেসকোর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে মোট ব্যয়ের প্রায় ৭১ শতাংশই বহন করছে সাধারণ পরিবারগুলো। অথচ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সর্বাধিক ব্যয় করা উচিত সরকারেরই। গণসাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণায় আরও জানা গেছে, ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৪ মাসে স্কুল বন্ধ ছিল ৪২৭ দিনের মধ্যে ২৭৯ দিন। অর্থাৎ বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাস পায়নি। এই দীর্ঘ অচলাবস্থা শিক্ষার মানকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফলে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষাভিত্তিক রোবটে পরিণত হচ্ছে। তারা ভালো নম্বর তুলতে পারলেও বাস্তব জ্ঞান বা ভাষার দক্ষতা অর্জনে ক্রমেই অক্ষম হয়ে পড়ছে।

বিশ্বের বহু দেশ ইতোমধ্যেই ইংরেজি শিক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। যেমন- নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, সিঙ্গাপুর, ভারত প্রভৃতি। এসব দেশে ইংরেজিকে ভয় নয়, বরং ভালোবাসা শেখানো হয়। সেখানে পরীক্ষার চাপের বদলে শেখার আনন্দই মুখ্য। ফলে শিশুরা আনন্দের মধ্য দিয়ে ভাষা দক্ষতা অর্জন করে। সুইডেনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘এডুকেশন ফার্স্ট ঊফঁপধঃরড়হ ঋরৎংঃ এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নেদারল্যান্ডস টানা কয়েক বছর ধরে ইংরেজি দক্ষতায় বিশ্বের প্রথম অবস্থানে রয়েছে। এর প্রধান কারণ হলোÑ তারা প্রাথমিক স্তর থেকেই ইংরেজি শেখায় আনন্দমুখরভাবে। চলচ্চিত্র, টিভি অনুষ্ঠান ও অনলাইন কনটেন্ট ডাবিং না করে সাবটাইটেলসহ দেখায়, যাতে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ইংরেজি শব্দ ও উচ্চারণের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে। তাদের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ উচ্চমানসম্পন্ন এবং উচ্চারণে তারা অত্যন্ত দক্ষ। ইউরোপের শীর্ষ ইংরেজিতে দক্ষ দেশগুলোর একটি হচ্ছে ‘সুইডেন’। সেখানে স্কুল পর্যায়ে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক, কিন্তু মুখস্থনির্ভর নয়, বরং বাস্তব প্রয়োগনির্ভর। শিক্ষার্থীরা ছোটবেলা থেকেই ইংরেজি গান, সিনেমা ও অনলাইন কনটেন্ট দেখে শেখে। শিক্ষকরা উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আর শিক্ষাসামগ্রী আধুনিক ও আকর্ষণীয়। আমাদেরও উচিত ইংরেজি শিক্ষাকে আরও সহজ, আনন্দমুখর ও ব্যবহার উপযোগী করে তোলা। এ জন্য প্রয়োজন শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার আমূল সংস্কার। যোগ্য শিক্ষক ছাড়া মানসম্মত পাঠদান সম্ভব নয়।

শিক্ষকতা এক মহৎ বা মহান পেশা, ফলে তাকে বাণিজ্যের কবল থেকে মুক্ত করতে হবে। আমরা প্রায়ই বলি ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’ কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব কমই দেখা যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইংরেজি শেখা মানে নিজের ভাষা বা সংস্কৃতি ভুলে যাওয়া নয়, বরং বিশ্বকে জানার নতুন রুট খোলা। যদি আমাদের সন্তানরা নিজেদের ভাষা ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ইংরেজিতে দক্ষ হয়ে ওঠে, তবে তারা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বৈশ্বিক পরিসরে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পারবে। অতএব, যদি আমরা সত্যিই ইংরেজি শিক্ষার সংকট থেকে মুক্তি চাই, তবে প্রয়োজন শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, যেখানে শিক্ষক হবেন অনুপ্রেরণার বাতিঘর, পাঠ্যবই হবে চিন্তার খোরাক আর শেখা হবে আনন্দের বিষয়, ভয়ের নয়। তবেই আমাদের সন্তানরা একদিন এই দেশকে জ্ঞানের পরাশক্তিতে রূপান্তর করবে- ইনশাআল্লাহ।

লেখক : প্রাবন্ধিক