অ্যাডভোকেট সাবিকুন্নাহার মুন্নী

▪ ‘প্রফেসর জ্যোৎস্না ইদ্রিস’ একটি নাম, একটি প্রতিষ্ঠান। আমরা দেখেছি একজন স্বপ্নদ্রষ্টাকে যিনি নিজে স্বপ্ন দেখতেন এবং অপরকেও স্বপ্ন দেখাতেন। তিনি ছিলেন একাধারে একজন কর্মজীবী যোদ্ধা, সাহসী নারী, একজন উদ্দমী মানুষ পাশাপাশি একজন স্নেহময়ী ও আদর্শ মা। আমরা যারা তার বয়সে ছোট তাদের প্রতি ছিল তার অকৃতিম ভালোবাসা ও স্নেহপূর্ণ একটি হৃদয়। পেশাজীবী ফোরামের সভানেত্রী হিসেবে ফোরাম নিয়ে আপার অনেক স্বপ্ন ছিল। ফোরামকে কীভাবে নারী সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল ও জোরালো কণ্ঠস্বর করা যায় সে ব্যাপারে ছিল তার নিরন্তর প্রচেষ্টা।

▪ আমাদের অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানাতে হচ্ছে যে, গত ২৬ অক্টোবর বুধবার ভোরেÑ বিশিষ্ট এ শিক্ষাবিদ, ইসলামী আন্দোলনের নিবেদিত প্রাণ মহিয়সী নারী, যিনি ছিলেন বহু গুনে গুনান্বিতা, সদালাপী, মিশুক, সদা হাস্যজ্জ্বোল মিষ্টি চেহারা ও অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী একজন মানুষ, আমাদের সকলের প্রিয় আপা, পেশাজীবী ফোরামের সভানেত্রী প্রফেসর জোসনা ইদ্রীস দীর্ঘদিন যাবৎ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে শ্যামলীর একটি হসপিটালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল প্রায় ৭৬ বছর। আপার বর্নাঢ্য জীবনে সরকারী চাকুরীর সুবাদে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। আপা মুমিন্নুন্নেসা মহিলা কলেজ, বদরুন্নেসা ও ইডেন মহিলা কলেজে জিওগ্রাফি সাবজেক্ট এ অত্যন্ত দায়িত্বশীলতা ও সফলতার সাথে অধ্যাপনা করেছেন। প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রতিটি ছাত্রীর কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

▪ বদরুন্নেসা কলেজে পড়াকালীন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে পরিচিত হন এবং পরবর্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনার্স ফাইনাল পড়া পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের সাথে জড়িত ছিলেন। অতঃপর ইসলামের দাওয়াত পেয়ে সত্যের আলোয় মুগ্ধ হয়ে দ্বীনের পথে আসেন। আমৃত্যু তিনি এ পথেই সক্রিয় ছিলেন। পারিবারিক জীবনেও তিনি ছিলেন সফল একজন মানুষ। জীবন সঙ্গী থেকে শুরু করে পরিবারের ২ মেয়ে ও ৪ ছেলে সকলেই দ্বীনের পথের অনুসারী। সারাদেশে আপার হাজার হাজার ছাত্রী দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। তার চরিত্রের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য ছিল তার অমায়িক ব্যবহার। প্রিয় রাসূল (সা.) বলেছেন- তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম, যে চরিত্রের দিক থেকে উত্তম। আপা সে সর্বোত্তম ব্যক্তিদের একজন ছিলেন। পেশাজীবী কমিটিতে থাকাকালীন আপাকে খুব কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। খুব দায়িত্ববান, স্মার্ট একজন অনুপম ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি, যা ছোট বড় সবাইকে খুব কাছে টানতো।

আপার চরিত্র একটি প্রিয় গানেই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে-

‘অমায়িক ব্যবহার যার মুখে আছে

পৃথিবীও ঋণী হয় ঠিক তার কাছে।

ব্যবহার জয় করে মানুষের মন

পরাজিত হয়ে যায় অস্ত্র তখন

বিনয়ের অফুরান শক্তি আছে।’

আচরণ ভালো যার সেই তো ভালো

যার কাছে গেলে বাড়ে মনের আলো

যে মানুষ সৎ নিজে নিজের কাছে।

▪ আপার সংস্পর্শে বাংলার হাজারো ছাত্রী আলোকিত হয়েছিল, যেমন আলোকিত হয়েছিলাম আমরা। তার মুখের মিষ্টি সম্বোধন আজো কানে বাজে। সৃষ্টিশীল মনের অধিকারী আপা নারী সমাজকে নিয়ে অনেক বেশী ভাবতেন, স্বপ্ন দেখতেন। তাদের জন্য অনেক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল। সমাজের একজন সচেতন মানুষ হিসেবে তিনি আগামী জেনারেশানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে অবসরকালীন সময়ে নিজ হাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। সদা কর্মচঞ্চল এ মানুষটি কাজের মধ্যে থেকেই দুনিয়া থেকে চিরদিনের মত অবসর গ্রহন করলেন।

মৃত্যুকালে তিনি বহুল প্রচারিত পত্রিকা- ‘রমযান বার্তা’র প্রাক্তন সম্পাদক এবং পরবর্তিতে প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও উপদেষ্টা ছিলেন। রমযান বার্তায় নিয়মিত দারসুল কুরআন লিখতেন। মৃত্যুর পরও যেন তার ঠোঁটে সদা মুচকি হাসিটুকু লেগেছিল। মহান আল্লাহ আপার সারা জীবনব্যাপী সকল নেক আমলকে সদাকায়ে জারিয়ার কাজ হিসেবে কবুল করুন। সকল গুনাহখাতা মাফ করে দিন, তাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করুন। শোক সন্তপ্ত পরিবারকে ধৈর্য ধারণ করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : আইনজীবী ও প্রাবন্ধিক