প্রফেসর ড. মো. আব্দুল্লাহেল বাকী
মানুষ সৃষ্টির সেরা। তা সত্ত্বেও তার মৌলিক সমস্যা হলো সে ভুলে যায়, ভুল করে। ভুলের গোড়ার কথা লোভ, মোহ, আকর্ষণ, টান। লোভ, মোহ, আকর্ষণ, টানের কারণেই মানুষের প্রকাশ্য শত্রু ইবলিস সম্পূর্ণ ভুল তথ্য দিয়ে, মিথ্যাচারের মাধ্যমে প্রথম মানব-মানবীকে জান্নাতে নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করিয়ে পৃথিবীতে নেমে আসার ব্যবস্থা করেছিল। সে সূত্র ধরে মানুষ-ইবলিস দ্বন্দ্ব চলছে-চলবে পৃথিবী ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত।
ইবলিসের প্ররোচনায় ভুলে ভরা জীবনের স্রোতধারাকে পরিবর্তন করে মানুষের ভুল সংশোধন এবং সঠিক পথ প্রাপ্তির অবিস্মরণীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছেন পরম দয়ালু অসীম কৃপাময় সুমহান আল্লাহ তায়ালা। তিনি মানুষকে ইবলিসের প্ররোচনা থেকে বাঁচানোর নানা কৌশল করেছেন। ইবলিস যেন সবসময় মানুষকে তার ফাঁদে আটকে ফেলতে না পারে সেজন্যে তিনি নামাযের মাধ্যমে দিনে পাঁচ বার মানুষকে তাঁর সান্নিধ্যে নিয়ে আসেন। বছরে রমযানের এক মাস ইবলিসকে বন্দী রাখেন, মানুষকে সংশোধনের সুযোগ দেন, ক্ষমা করেন। একইভাবে বাৎসরিক হজ¦ পালনের মাধ্যমে এক সুবিশাল মানবগোষ্ঠীকে ইবলিসের বিরুদ্ধে পাথর নিক্ষেপসহ নানাবিধ কার্যাবলীর আওতায় নিয়ে আসেন। পৃথিবী ইবলিসমুক্ত হয়, মানুষ বিজয়ী হয়।
সে সূত্র ধরে ২০২৫ সালের রমযান অতিক্রম করে আমরা এখন হজে¦ আনুষ্ঠানিকতার দিকে ধাবিত হচ্ছি। পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ১৮৩-১৮৮ আয়াতের আলোকে রমযান সাফল্যের ৮টি সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা অনুযায়ী আন্তরিক দোয়া, বিশুদ্ধ নামায, সঠিকভাবে রোজা পালন, শক্তভাবে কুরআন ধরা, সফল ইতিকাফ, আল্লাহর বাণী প্রচার এবং স্বচ্ছ আর্থিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রমযান সফলকারীরা এখন হজ¦ সাফল্যে মনোযোগী হবে।
রমযান আবহের সফল একদল মানুষ পরিধান করবে ইহরামের পোশাক, যপবে তালবিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ শ্লোগান, প্রবেশ করবে পৃথিবীর একমাত্র হারাম এলাকায়। এক পর্যায়ে হাজিকে নেওয়া হবে পৃথিবীর সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিস্থিতিতে-মিনা-আরাফা-মুজদালিফায়। একেবারে অগতানুগতিক, একবারে ভিন্ন কিছু প্রদানের জন্যে। যেন তারা সত্যিই এক ভিন্নতর মানুষে পরিণত হয়, হয় মহামানব-কুরআনের ভাষায় মুহসিন। ক্রমান্বয়ে হাজি অগ্রসর হবে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মসজিদুল হারামে, ধীরে ধীরে পৌঁছে যাবে পৃথিবীর প্রথম গৃহ, হেদায়েতের উৎস, মানবজাতির সম্মেলন কেন্দ্র, আল্লাহর ঘর কাবা-এর চত্বরে। পাবে অভাবনীয় সম্মামনা, গ্রহণ করবে বিশেষ দায়িত্ব। হজ¦ আনুষ্ঠানিকতার সেরা সময়, সেরা স্থান, সেরা ইবাদতের পরশে হাজি সেরা মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখবে।
রমযান-হজ¦ সম্পর্ক : রমযানের রোজা ফরজ, জিলহজ¦ মাসের ১ম ৯ দিন রোজা রাখা উত্তম। কী অদ্ভুত বিস্ময়কর- হজ¦ পালনরত হাজিদের জন্যে আরাফাত দিবসে রোজা নেই। রমযানে নামাযের কত বাড়তি চাপ। অথচ হজে¦র মূল অনুষ্ঠানের ৮-১২/১৩ জিলহজ¦ নামায কসর, এমনকি জামাত বা একত্রিকরণ বাধ্যতামূলক। রমযানে ইতিকাফ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। মূল শব্দ অকুফ। হজে¦র অন্যতম প্রধান কার্যকলাপ-অকুফে মিনা, আরাফা, মুজদালিফা। রমযানের লাইলাতুল কদর-এক রাত হাযার মাসের চেয়ে উত্তম। একইভাবে ৯ জিলহজ¦ হজে¦র দিন, বছরের সেরা দিন। অন্যদিকে কুরআনে সূরা ফজরে ১-১০ জিলহজ¦ দশ রাতের কথা উল্লেখ রয়েছে। বছরের সেরা মাস রমযান। বানাবে সেরা মানুষ মুত্তাকী, আলিম, রাশেদ, কৃতজ্ঞ। ২ মাস ৭ দিন পরে এদের মধ্য থেকে বাছাই করা কিছু লোককে নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে অবিস্মরণীয় এক অনুষ্ঠান-ইসলামের অন্যতম এক স্তম্ভ হজ¦-সৃষ্টি করবে সেরাদের সেরা-মুহসিন।
হজে¦র সফর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সফর : যে সফরে ইহরাম বেঁধে তালবিয়া পাঠ করার সুযোগ হয়, এক সুনির্দিষ্ট মিকাত অতিক্রম করা হয়, শুধু বিশ্বাসীদের এলাকায় প্রবেশ করা হয়, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মসজিদে অবস্থান করা হয়, পৃথিবীর প্রথম গৃহ কল্যাণ ও বরকতের কেন্দ্র এবং মানুষের সম্মেলনস্থল কাবার তওয়াফ করা হয়, যে সফরে জান্নাতি পাথর স্পর্র্শ করা হয়, কুরআনে উল্লেখিত আল্লাহতায়ালার গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন মাকামে ইবরাহীমে ইবাদত করা হয়, যে সফরে ইসমাঈল (আ.) এর জমজম পান করা হয়, সাফা-মারওয়াতে সায়ী করা হয়, পৃথিবীর একটি নির্দিষ্ট অংশ মিনায় নির্দিষ্ট দিনে বিশেষ ইবাদতের সুযোগ হয়, যে সফরে জামারায় পাথর নিক্ষেপ করা হয়, কুরবানি করা হয়, পৃথিবীর একটি নির্দিষ্ট অংশ আরাফায় একটি নির্দিষ্ট দিনে বিশেষ ইবাদতের সুযোগ হয়, পৃথিবীর একটি নির্দিষ্ট অংশ মুযদালিফায় একটি নির্দিষ্ট রাতে বিশেষ ইবাদতের সুযোগ হয়, যে সফরে মাথা মুণ্ডানো বা চুল কাটা হয়, পৃথিবীর তৃতীয় সর্বশ্রেষ্ঠ মসজিদ মসজিদে নববীতে ইবাদত করা হয়, সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের রওজা মুবারকে সালাম দেওয়া হয়, আসহাবে সুফ্ফা, পৃথিবীতে থাকা অবস্থাতেই বেহেশতের স্বাদ আস্বাদন করা হয় রিয়াজুল জান্নায় অবস্থান করে, বাবে জীব্রাঈল-সর্বশ্রেষ্ঠ কবরস্থান জান্নাতুল বাকী জিয়ারত করা হয়, জান্নাতুল মুয়াল্লা, গারে সুর, গারে হেরা, ওহুদ, খন্দক, দর্শনের সৌভাগ্য হয়। যে সফরে কুবা-কিবলাতাঈনসহ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ মসজিদে ইবাদত করার সুযোগ হয়।
হজ¦ আনুষ্ঠানিকতার প্রাপ্তি-অফুরন্ত সওয়াব : হাজীরা আল্লাহর মেহমান। হজ¦ পালনকারীরা আল্লাহর প্রতিনিধি দলের সদস্য। হজ¦ দারিদ্রতা ও গুনাহ মিটিয়ে দেয়। ইসলাম গ্রহণ এবং হিজরত যেভাবে পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মিটিয়ে দেয় একইভাবে হজ¦ও তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মিটিয়ে দেয়। সঠিকভাবে হজ¦ পালনকারী সদ্যপ্রসূত শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ, হাজিরা এমনকি অন্যদের গুনাহমাপের উৎস। হাজির দোয়া কবুল করা হয় এবং তাদের চাহিদা পূরুণ করা হয়। হজে¦র জন্য খরচ আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার মতই, যার সওয়াব সাতশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। মাবরুর হজে¦র বিনিময় জান্নাত। হজ¦ পালনের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পর মৃত্যুবরণ করলে কিয়ামত পর্যন্ত তার হজে¦র সওয়াব লেখা হবে। যেমন জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে কারোও মৃত্যু হল কিয়ামত পর্যন্ত তার জন্য মুজাহিদের সওয়াব লেখা হয়। হজ¦ পালনরত অবস্থায় মারা গেলে কিয়ামতের দিন তাকে তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় উঠানো হবে।
বায়তুল্লাহ্র উদ্দেশে ঘর থেকে বের হলে উটনীর পথ চলার প্রতি কদমে আল্লাহ্ একটি করে নেকী লিখেন এবং একটি করে গুনাহ মিটিয়ে দেন। তাওয়াফের প্রতি কদমে আল্লাহ তার একটি করে গুনাহ মাফ করেন, একটি করে নেকী লেখেন এবং দশটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। বায়তুল্লাহ তাওয়াফ শেষে দুই রাকাত সালাত আদায়কারী একটি গোলাম আযাদ করার সমান সওয়াব পায়। সাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ যেন সত্তরটি দাস মুক্তকরণ। ৯ জিলহজ¦ আরাফার বিকালে আল্লাহ্ পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করে ফিরিশতাদের সাথে গর্ব করে বলেন-আমার বন্দারা ধূলিমলিন বদনে দূর-দূরান্ত থেকে আমার নিকট জান্নাত লাভের আশায় এসেছে তাদের পাপরাশি বালুকনার পরিমাণ অথবা বৃষ্টির ফোঁটার সমান অথবা সাগরের ফেনা পরিমাণ হলেও আমি এগুলো ক্ষমা করে দেব। তারা এবং তারা যাদের জন্য সুপারিশ করে সবাইকে মাফসহ ফিরে যেতে বলেন। প্রতিটি কঙ্কর নিক্ষেপকে একটি মারাত্মক ও কবীরা গুনাহের কাফ্ফারা করা হয়। কুরবানি-এর এত পুণ্য যে সেটা তাদের প্রতিপালকের নিকট সঞ্চিত থাকে। মাথা মোড়ানোতে প্রতিটি চুলের বিনিময় একটি করে পূন্য এবং একটি গুনাহ মিটিয়ে দেওয়া হয়। তারপর বায়তুল্লাহ্র তাওয়াফ এমন হবে যে আর কোন গুণাহই থাকবে না। একজন ফিরিশতা এসে পিঠে হাত রেখে বলে, ভবিষ্যতের জন্য কাজ করে যাও, তোমার অতীতের সব কিছু মাফ করে দেওয়া হয়েছে।
সুনিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করা যায়-পৃথিবীর কোন মানুষ জীবনের কোন সফর থেকে এতকিছু অর্জন করতে পারে না যা একজন মানুষ হজে¦র সফর থেকে অর্জন করে।
লেখক : সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।