কলাম
আনুষ্ঠানিক ইবাদতের প্রাসঙ্গিকতা
ইসলাম আল্লাহর মনোনীত পূর্ণাঙ্গ একটি জীবন ব্যবস্থা। এর অর্গানন বা নীতিমালা মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। দার্শনিক মানদণ্ডে কুরআনের মূল বিষয় হলো- তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত। তাকওয়া, তামান্না
Printed Edition

অধ্যক্ষ ডা. মিজানুর রহমান
ইসলাম আল্লাহর মনোনীত পূর্ণাঙ্গ একটি জীবন ব্যবস্থা। এর অর্গানন বা নীতিমালা মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। দার্শনিক মানদণ্ডে কুরআনের মূল বিষয় হলো- তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত। তাকওয়া, তামান্না, জান্নাত ও জাহান্নাম এর অলংকার। ঈমান, সালাত, সাউম, হজ¦, যাকাত এগুলো মৌলিক আনুষ্ঠানিক ইবাদাত তথা উপাসনা। এসব ইবাদতের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য হলো ওহীর বিধানের তাঁবেদারী করা।
ইসলামের দৃষ্টিতে সর্বক্ষেত্রে প্রচলিত মানবরচিত মতবাদ পরিত্যাগ করে ওহীর তাঁবেদারী করার জন্য শান্তিময় নিরাপদ পরিবেশ ও একটি সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা। যে সমাজে ও রাষ্ট্রে উপরোল্লিখিত অনুকুল পরিবেশ বিদ্যমান নেই, সে সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলামী পরিবেশ কায়েম করার জন্য ইসলামিক রাজনীতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জিহাদ অত্যাবশ্যক। ইসলামের দৃষ্টিতে সকল আনুষ্ঠানিক ইবাদতের জন্যই একটি নির্দিষ্ট সময় রয়েছে, কিন্তু জিহাদ এমন একটি ইবাদত যা সার্বক্ষণিকভাবে অত্যাবশ্যক।
জিহাদ এমন একটি ইবাদত, যেটা সব ফরযের বড় ফরয। এ ফরয সম্পাদনে নিয়োজিত মুসলমানরা হলেন এক একজন আল্লাহর সৈনিক বা হিজবুল্লাহ। আর এসব সৈনিকদের সমন্বয়ে গঠিত হয় আল্লাহর সেনাবাহিনী। যারা হিজবুস শয়তানের বিরুদ্ধে সর্বদা লড়াইয়ে অগ্রপথিক। ইসলাম এ প্রকৃতির সৈনিকদের আত্মিক, মানসিক, দৈহিক এবং সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য নানা রকম ইবাদতের বিধান নির্ধারণ করেছে। যাতে করে তারা চিন্তা চেতনায় ইনসানে কামিল বা পরিপূর্ণ সফল মানুষ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন। দেহ, মন ও আত্মার সামগ্রিক উন্নতি সাধনের জন্য বিবেককে শানিত করে আল্লাহর রঙ্গে রঙ্গিন হয়ে আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত কলাকৌশল শিক্ষা দিয়েছেন আল কুরআন। যে শিক্ষার চূড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো- আল্লাহর জমিনে সর্বস্তরে কুরআনের বিধান কায়েমের মাধ্যমে একটি কল্যাণময় বিশ্ব বিনির্মাণ করে সৃষ্টিকর্তার স্বপ্ন পূরণ করা।
এ গুরুত্বপূর্ণ মিশনটি বাস্তবায়নের প্রধান অন্তরায় হলো শয়তানের ঘড়যন্ত্রের চ্যালেঞ্জ এবং মানুষরূপি শয়তানের গভীর চক্রান্ত ও বিরোধিতা। শয়তান নিজে শয়তানী করে না, পক্ষান্তরে শয়তান মানুষকে দিয়ে শয়তানী করিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। আর শয়তানের নানা কূটকৌশল আর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে এক শ্রেণির মানুষ শয়তানীতে লিপ্ত হয়। আর যারা শয়তানের তাঁবেদারী করে তারা স্বভাবতই ইসলামের চিরশত্রু তাগুত বা অপশক্তির তাঁবেদার। ইসলামের দৃষ্টিতে তাগুত ও তাগুতের তাঁবেদারীরা জাহান্নামী। আর যারা এর বিপরীত তথা ওহীর বিধানের অনুসরণ করে জীবন যাপন ও সময় অতিবাহিত করে তারা হলেন- জান্নাতের অধিকারী। অতএব বুঝা গেল ইসলামের চির শত্রু হরো ১. শয়তান ও ২. তাগুত। যারা শয়তান ও তাগুতের সাথে জিহাদ বা লড়াই করে রবের কর্তৃত্ব সার্বভৌমত্ব কায়েম করার চেষ্টা করে দ্বীন ইসলাম কায়েমের চেষ্টা করেন, তারা দুনিয়া ও আখিরাতে মর্যাদাবান মানুষ হিসেবে পরিগণিত হবেন। তাদের কারণেই পৃথিবী টিকে থাকবে।
জিহাদ এমন একটি ইবাদত যা সকল প্রকার ইবাদতের জনক। জিহাদের মতো বড় মর্যাদাবান ইবাদত রবের নিকট আর একটিও নেই। ইসলাম পরিপূর্ণভাবে বিজয়ের অন্যতম একটি বড় ইবাদত হলো জিহাদ বা সংগ্রাম। এই জিহাদ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে আঞ্জাম দেয়ার জন্য যে ধরনের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন তা বাস্তবায়নের জন্য মহান আল্লাহপাক বেশ কিছু আনুষ্ঠানিক ইবাদত বা উপাসনার বিধি-বিধান নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যেমন সালাত, সাউম, যাকাত ও হজ¦। এ সব ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য ও চেতনা হলো ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সকল স্তরে ইসলামী জীবনবিধান বাস্তবায়ন করা। এ ওহীর বিধান বাস্তবায়নের এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, স্বয়ং রাসূল (সা:) নবুয়তী জিন্দেগীতেই তার উপস্থিতিতে সময় ও পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে সালাত কা’যা ও দিনের বেলায় সাউম ভাঙ্গার মতো ঘটনার অবতারণা ঘটেছে। এতে সহজেই অনুমেয় যে, সালাত ও সাউমের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো আল্লাহর মনোনীত ‘দ্বীন’ বা জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জিহাদ বা সংগ্রাম।
মহানবী (সা:) সমগ্র জিন্দেগীটাই জিহাদী বন্দেগীর জীবন। তিনি জন্ম থেকেই নানা প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে জিহাদ বা সংগ্রাম করেই তার ৬৩ বছরের জীবন অতিবাহিত করেছেন। প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করে টিকতে না পেরে হিকমত অবলম্বন করার স্বার্থে মহান আল্লাহর আদেশে অবশেষে নিজ মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করতে হয়েছে বিশ্বনবীকে। এ কৌশল ও ত্যাগের বিনিময়ে মহান আল্লাহপাক বিশ্বনবীকে অল্পদিনের ব্যবধানে আরব জাহানের সালতানাত বা বাদশাহী দান করেছিলেন। যে বাদশাহীর ধারা পরবর্তীকালে ইসলামের ধারক-বাহকদের সংগ্রামের বিনিময়ে অর্ধপৃথিবী আয়ত্তে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। যে মানচিত্রে একটানা পাঁচশ বছর ইসলামী শাসন বা সোনালী ইতিহাস রচনা করতে সক্ষম হয়েছিল।
পৃথিবীর জমিনে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের মূলোৎপাটন করার সংগ্রামকেই জিহাদ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। তবে এর আগে এ জিহাদের অংশ নফসের জিহাদকে ইসলাম যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। সর্বপ্রথম ইসলামের প্রতি পূর্ণবিশ্বাস স্থাপন করার পর যে বিষয়টি গুরুত্ব বহন করে তা হলো ইসলামী বুনিয়াদী জ্ঞানার্জন করা। আর এর সর্বশেষ ধাপ হলো সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বে সত্যের পথে অবিচলভাবে টিকে থাকা। আর এটিই হলো আল্লাহর প্রতিনিধির দায়িত্ব ও কর্তব্য। মহান আল্লাহ এটা ভালভাবেই অবগত আছেন যে, হক আর বাতিলের সাথে সংঘাত অনিবার্য। এতে যারা নিজেদের মাল ও জান দিয়ে সত্যের পথে হকের পথে লড়াই করে নিজেদের জীবনকে জান্নাতের বিনিময়ে বিক্রি করতে পারবে তাদের চেয়ে মর্যাদাবান মানুষ আর হয় না।
জিহাদ এমন এক মহামূল্যবান ইবাদত যার তুলনা অন্য কোন ইবাদত দিয়ে পূরণ হবার নয়। যারা বাতিলের সাথে সংঘাত-নির্যাতন নানা প্রতিকূলতার মাঝেও ইসলামের বিজয় অর্জনে দৃঢ় থেকে জিহাদ করে মৃত্যুবরণ করেন, তাদেরকে আল্লাহপাক মৃত বলতে নিষেধ করেই ক্ষ্যান্ত হননি বরং তারা জীবিত বলে উল্লেখ করেছেন। যে কারণে আল্লাহর সৈনিকেরা সিসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করেন। তাদের জীবন ও অর্থসম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে বিক্রি করেন।
বর্তমান যামানায় জিহাদের প্রচুর অপব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। এর জবাবে বলা যায় বাতিলের সাথে সংঘাতহীন ইবাদতসমূহ ও বাধাহীন কোন ইবাদত জিহাদ হতে পারে না। মূলত জিহাদ এমন একটি পুণ্যময় ইবাদত যার সাথে অন্যকোন উপাসনা বা ইবাদতের তুলনা করা যায় না বিধায় জিহাদ একটি অতুলনীয় ইবাদত। এ ইবাদতের মাধ্যমেই কে বা কারা সত্যিকারের মুমিন মুত্তাকী তা নির্ণয় করা সহজতর হয়।
মুসলমানদের মনে রাখতে হবে, হক আর বাতিলের দ্বন্দ্ব চিরন্তনী প্রক্রিয়া। হকের তাঁবেদারীতে জান্নাত মিলে আর তাগুতের তাঁবেদারীতে মিলে জাহান্নাম। মুসলমানদের জিন্দেগীটাই যেহেতু বন্দেগীর জন্য, সুতরাং বন্দেগীর সর্বোচ্চ মিনার জিহাদের মতো ইবাদতকে এড়িয়ে চলা এবং নিজেকে ঝুঁকিহীন নিরাপদে রাখার মতো ইবাদতকে বেছে নেয়া মানে ইসলামকে স্রেফ ধর্ম হিসেবে মেনে নেয়ার নামান্তর, পক্ষান্তরে ইসলামকে জীবন ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নেয়া নয়। আর ইসলামকে স্রেফ যারা ধর্ম মনে করে যারা শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক ইবাদতে মশগুল থাকেন তারা এখনও পর্যন্ত ইসলামকে পুরোপরি বুঝতে সক্ষম হয়নি। যে কারণে এ ধরনের মুসলমান মুসলমানের ঔরসে জন্ম গ্রহণ করা সত্ত্বেও দ্বীনকে পুরোপুরি না বোঝার কারণে তারা ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী জিহাদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিরোধিতা করেই ক্ষ্যান্ত হয় না বরং প্রতিহত করার সর্বাত্মক চেষ্টাও করে থাকে।
বর্তমান দুনিয়ার মানবজাতি এক মহাক্লান্তিকাল পার করছে। এ কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়কে নানারকম মতানৈক্য দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে ইসলামের বৃহৎ স্বার্থে এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব রক্ষার স¦ার্থেই ইসলামী বিশ্বব্যবস্থা বিনির্মাণের মিশনে অবতীর্ণ হওয়া যুগ ও সময়ের দাবী। ‘দুনিয়া যার -হুকুম চলবে তার’ এ বিশ্বাসের আলোকে খুব কম সংখ্যক বুদ্ধিমান মানুষ এগিয়ে আসেন। যারা হয় জ্ঞানী, মানবতাবাদী, পরিবেশবাদী বিনয়ী, ভদ্র ও আমানতদার। যারা দুনিয়ার মায়া-মহব্বত লোভ হিংসা মোহ ও নফসের তাঁবেদারমুক্ত। সততা আন্তরিকতা মানবপ্রেম তাদের চরিত্রের ভূষণ। তাদের অন্তরে তাকওয়া ও তামান্নার জজবা সর্বসময় বিকশিত থাকে। তারা আল্লাহ ছাড়া কাউকে পরোয়া করেন না। দুনিয়ার চেয়ে আখিরাতকে প্রাধান্য দেন। সব কাজে আল্লাহর বিধি-বিধানকে সর্বাগ্রে বিবেচনায় আনেন। তারা দুনিয়াবী শিক্ষা সনদ ও ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক বৈভবের আশা করেন না।
সাম্প্রতিক সময়ে ৭৫ বছর আগে ইহুদীদের কর্তৃক ছিনিয়ে নেয়া মুসলিম উম্মাহর প্রথম কিবলা বায়তুল আকসা পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম ও যুদ্ধ চলছে। যা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কঠিন দামামা বলে অনুমান করা যায়। হয়ত এ যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলমানরা পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে নতুন করে ইসলামের সালতানাতের পতাকা উড্ডীন করার সুযোগ পাবে। যে পতাকার ছায়াতলে এসে মুসলমানরা আবারও বিশ্ব সভ্যতার রূপকার হিসেবে আবির্ভূত হবে এবং ইসলামী রীতি-নীতির আলোকে দুনিয়াকে পরিচালিত করবে। এর মাধ্যমেই মাশরিক-মাগরিব-শিমাল-জুনুব সবখানে আল কুরআনের আইন বাস্তবায়িত হবে এবং এর মাধ্যমেই মহান আল্লাহতায়ালা দুনিয়া সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন সার্থক করবেন বলে ধারণা করা যায়।
বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ওহীর বিধানের বিপরীত পশ্চিমাদের রীতি-নীতিতে, নৈতিকতা বিবর্জিত আদর্শহীন বিবেক বর্জিত বস্তুবাদী দর্শনে পরিচালিত হওয়ার দরুন যুদ্ধ-বিগ্রহ আর অশান্তির দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে। অপরদিকে অধিকাংশ মুসলমান বিশ্বায়নে কুরআন-চেতনায় রমযান- এ দর্শন থেকে অনেক দূরে সরে গেছে, ফলে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ শোষিত বঞ্চিত হচ্ছে মানবাধিকার থেকে। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো ইসলামের পুনর্জাগরণ ও ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। লেখক: সাংবাদিক