বর্বর ইসরাইলী বাহিনী পুরো গাজা শহরটাকে শিশুদের কবরে পরিণত করেছে। যেদিকেই তাকানো যায় ধ্বংসস্তূপ আর সারি সারি শিশুদের কবর। খবরের কাগজ আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খুললেই গাজায় নারী ও শিশু হত্যার খবর চোখের সামনে আসে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খুললেই শিশুদের কবর দেওয়ার ভিডিও সামনে আসে। নাড়ি ছ্ঁেড়া ধনকে নিজের হাতে কবরস্থ করার পর মায়ের যে আর্তচিৎকার আর গগণবিধারী কান্না কানে ভেসে আসে; তা সকল মর্মান্তিকতাকে ছাড়িয়ে যায়। কোন রকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যুদ্ধনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তারা নারী ও শিশুদের হত্যা করছে প্রতিদিন। তাদের আক্রমণের ধরন দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায় একটি প্রজন্মকে তারা নিঃশ্বেষ করে ফেলতে চায়। তারা চায়, গাজার মুসলিমদের শেষ করে দিতে। তারা চায় গাজাতে যেন আর একজন প্রতিবাদী মানুষ না থাকে। যারা সেখানে থাকবে তারা ইসরাইলী ইহুদিবাদীদের গোলাম হয়ে থাকবে। মুসলমানদের বায়তুল মোকাদ্দাস থাকবে তাদের দখলে। অথচ আল্লাহ এই স্থানটি সৃষ্টি করেছেন মুসলমানদের ইবাদতের জন্য।
বর্বর ইসরাইলীদের দখলদারিত্বের ধরন দেখলে বোঝা যায়, তারা চায় না গাজাতে আর কোন মা শিশু জন্ম দিক। আর কোন শিশু যেন হামাসের পতাকাতলে না আসতে পারে। আর একটা শিশু যেন অন্যায়ের প্রতিবাদের দীক্ষা না পায়। এজন্য ইসরাইলী সেনারা হাসপাতাল থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ যত আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে সবখানে একের পর এক হামলা করে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করছে। আর তাতে শত শত হাজার হাজার লাশের সারি পড়ছে নারী ও শিশুদের। কারণ যুদ্ধের সময় নারী ও শিশুরা দুর্বল হওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্রে আসে। আর যারা প্রতিবাদী তারা যুদ্ধের ময়দানে যায়। গাজার শিশুরা যেহেতু যুদ্ধ দেখতে দেখতে বড় হয়, তারা ছোটবেলা থেকেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। ইসরাইল বিরোধী হয়ে ওঠে। তারা লাশ দেখতে দেখতে বড় হয়। তাই মৃত্যুকে পরোয়া করে না।
বাস্তবতা হলো একটু বড় হলেই গাজার মায়েরা সন্তানদের পাঠায় বর্বর ইসরাইলীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। এজন্য গাজার মায়েদের সন্তান যাতে বড় হতে না পারে, সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ইসরাইলী সেনারা সকল মানবাধিকারকে উপেক্ষা করে নির্বিচারে হত্যা করছে গাজার শিশুদের।
৫ এপ্রিল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গাজায় ইসরাইলী আগ্রাসনে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে শিশুরা। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ১৭ হাজারেরও বেশি শিশুকে হত্যা করেছে ইসরাইলী সেনাবাহিনী। ৫ এপ্রিল শনিবার ফিলিস্তিনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে। তুরস্কভিত্তিক নিউজ এজেন্সীর খবরে বলা হয়েছে, প্রতি বছর ৫ এপ্রিল পালিত হওয়া ফিলিস্তিনী শিশু দিবস উপলক্ষে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘ফিলিস্তিনে, বিশেষ করে গাজায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ইসরাইলী দখলদার বাহিনীর সরাসরি আক্রমণের শিকার হচ্ছে। সেনারা স্কুল ধ্বংস করে দিচ্ছে এবং শিশুদের নিরাপদ শিক্ষা পরিবেশে প্রবেশ করতে বাধা দিচ্ছে।
এতে বলা হয়েছে, চলমান যুদ্ধের কারণে গাজা, জেরুজালেম এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরের ‘‘এরিয়া সি’’ হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ এলাকার শিক্ষার্থীরা প্রতিদিনই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘গাজায় ১৭ হাজারেরও বেশি শিশু নিহত হয়েছে, যা শিশুদের দুর্দশার গভীরতা প্রতিফলিত করে। প্রতিটি সংখ্যা জীবন, স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতা হারানোর প্রতিনিধিত্ব করে। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয় ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস থেকে গাজায় চলমান হামলায় ফিলিস্তিনী শিশুরা ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। সরকারি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, হতাহতের ৬০ শতাংশের বেশি নারী ও শিশু।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনী শরণার্থী সংস্থার (ইউএনআরডাব্লিউএ) পরিসংখ্যান অনুসারে, গাজায় প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০ জন শিশু নিহত বা আহত হচ্ছে। ইসরাইলী বিমান হামলা তীব্রতর হওয়ার কারণে এমনটা হচ্ছে। এদিকে মানবিক সাহায্য এখনও বন্ধ রয়েছে। ইউএনআরডাব্লিউএ-এর প্রধান লাজ্জারিনি এক্স-এ লিখেছেন, ‘এটা ভয়াবহ। হামলা পুনরায় শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০ জন শিশু নিহত বা আহত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
ইউনিসেফের পরিসংখ্যান অনুসারে, ১৮ মার্চ ইসরাইল তাদের সামরিক অভিযান পুনরায় শুরু করে। ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর এই আক্রমণ পুনরায় শুরু হয়েছে। জাতিসংঘের সংস্থাটি এক বিবৃতিতে বলেছে, গাজার দশ লাখ শিশু ক্রমাগত বোমাবর্ষণ এবং ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকটের শিকার হচ্ছে। ইসরাইলের ছিটমহলে সাহায্যের অব্যাহত অবরোধের ফলে এ সংকট আরো তীব্রতর হচ্ছে।
ফিলিস্তিনের কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে, ১৮ বছরের কম বয়সি শিশুরা ফিলিস্তিনের জনসংখ্যার ৪৩ শতাংশ, পশ্চিম তীরে ৩.৪ মিলিয়ন এবং গাজায় ২.১ মিলিয়ন। এসব শিশুকে ইসরাইলীরা ভবিষৎ যোদ্ধা মনে করে। এরা একদিন তাদের রুখে দিতে পারে এই ভয়ে শিশু অবস্থাতেই এদের শেষ করে দিতে চায়।
যুদ্ধনীতিতে অসহায় নারী ও শিশুদের হত্যা করার কোন সুযোগ নেই। আশ্রয়কেন্দ্রে হামলা করার সুযোগ নেই। হাসপাতালে কিংবা ত্রাণবাহী গাড়িতে হামলা করার কোন নিয়ম যুদ্ধনীতিতে নেই। কোনকিছুর তোয়াক্কা না করেই ইহুদিবাদী সেনারা ত্রানবাহী গাড়ি, ত্রাণকর্মী, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকর্মী, সব কিছুর ওপর বোমা নিক্ষেপ করছে। তাতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে এসবকিছু।
যুদ্ধনীতি ভঙ্গ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে গাজার নারী ও শিশুদের হত্যার প্রতিবাদে সারা দুনিয়াজুড়ে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় বইছে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদে ক্ষোভ প্রদর্শণ করছে। নানা কর্মসূচি পালন করছে। তাতেও কোন তোয়াক্কা নেই বর্বর ইসরাইলীদের। তারা প্রতিদিন হাজার হাজার মায়ের কোল খালি করছে শিশুদের হত্যা করে। লাশের সারি বৃদ্ধি করছে দখলদারির মানসে। প্রতিক্ষণে গগনবিদারী কান্নায় আশপাশের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠছে। পুরো গাজা শহর বিরাণভূমি হওয়ার পাশাপাশি শিশুদের কবরে পরিণত হচ্ছে। কোল থেকে লাশে পরিণত হওয়া শিশুদের কবর দেওয়ার জন্য মানুষ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না গাজা শহরজুড়ে। বাধ্য হয়ে বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন কোমল নরম শিশুর মৃতদেহ মায়েরা নিজেই বুকের সোনা মানিককে নিজেই কবর খুড়ে দাফন করতে বাধ্য হচ্ছে। আমরা সারাবিশ্বজুড়ে এসব দৃশ্য দেখছি অপলক দৃষ্টিতে। মানবতার ধ্বজাধারীরাও একই কাজ করছে। আমরা পারছি না কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিতে। হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে ভাবছি। কি-বা করার আছে আমাদের। কি সান্ত্বনা দেবো গাজার মায়েদের ?