রফিকল ইসলাম

মোঃ আহনাফ আবীর আশরাফুল্লাহ, একজন সাধারণ যুবক, যার জীবন ছিল অসাধারণ অধ্যবসায়, সততা ও নৈতিকতায় পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি। তিনি কোন রাজনীতিবিদ বা নেতা ছিলেন না, তবুও ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচারীর বুলেটের আঘাতে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। কারণ তিনি অন্যায়ের সামনে মাথা নিচু করেননি, বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছেন দেশের প্রয়োজনে ।

মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার বাসুদিয়া নামক ছায়া সুনিবিড়ির গ্রামে সকালের স্নিগ্ধ আলো ভেদ করে এক ভাগ্যবতী মায়ের ছোট্ট ঘর আলোকিত করে ২৩ অক্টোবর ১৯৯৫ জন্ম নেয়, মোঃ আহনাফ আবীর আশরাফুল্লাহ। তার জন্ম মুন্সিগঞ্জে হলেও ১ বছর বয়সেই পুরো পরিবার টাঙ্গাইলে চলে আসে। শৈশব থেকেই আহনাফ ছিলেন শান্তশিষ্ট, চুপচাপ স্বভাবের। দেলদুয়ার মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ভর্তি হন দেলদুয়ার সৈয়দ আব্দুল জাব্বার বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে। প্রযুক্তির প্রতি ছোট বেলা থেকেই ছিল তার প্রবল আকর্ষণ। ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে থাকতেই মোবাইল প্রযুক্তি আয়ত্বে নেন। আশপাশের সকল গ্রামের মানুষ তাকে “ছোট্ট টেক ডাক্তার” বলে ডাকত। গ্রামের কেউ ফোন, ল্যাপটপ বা সার্কিট নিয়ে সমস্যায় পড়লে সরাসরি আহনাফের কাছে চলে আসত। সেও ছিল কাজ পাগল এক যুবক। কেউ সমস্যায় পড়ে তাকে যে কোন সময় ডাকলেই তাদের বাড়ি গিয়ে হাজির হতেন। এমনকি তার বড় বোনেরা যদি বলতেন যাদের সমস্যা তারা তোর কাছে আসবে, ডাকলেই রাত দিন সমান করে কেন যেতে হবে? সে মৃদু হেসে, তেমন জবাব না দিয়ে পরোপকারী হৃদয় নিয়ে ছুটে যেতে অন্যের সমস্যা সমাধানে।

অনেকের মত আহনাফের জীবনে সহজ কিছু ছিল না। পাখির কলকাকলিতে পূর্ণ গ্রামের ছোট্ট সুখি সংসারে ছিল না আর্থিক স্বচ্ছলতা। আর্থিক অসচ্ছলতার মাঝে বাবা-মার পাশাপাশি আহনাফকেও শৈশব থেকেই লড়তে হয়েছে। দেলদুয়ার সৈয়দ আব্দুল জাব্বার বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১১ সালে এস. এস-সি পরীক্ষায় ৪.৬৯ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। দ্রুত পরিবারের হাল ধরতে হবে, এ কারণে পলিটেকনিকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং সফলতার সাথে মুন্সিগঞ্জ পলিটেকনিকে চান্স পান। পড়াশোনার খরচের জন্য দরিদ্র বাবা মার কাছ থেকে খুব সামান্য অর্থ পেতেন। এজন্য তাকে প্রচণ্ড আর্থিক কষ্টের মাঝে পড়াশোনা করতে হয়েছে। এমনকি তিনি কিছু টাকা সেভ করার জন্য মুন্সিগঞ্জ রিক্যাবি বাজার থেকে নারায়নগঞ্জ রেলস্টেশন পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার পথ হেটে আসতেন। এরপর ট্রেনে করে ঢাকা আসতেন। ১৫০০-২০০০ টাকা দিয়ে তাকে মাসের সকল খরচ মেটাতে হত। এক সময় আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ হওয়ায় তারই চাচাত ভাই আব্দুস সালাম প্রায় ১ বছর পড়াশোনার খরচ দেন।

আর্থিক অনটন থাকলেও বুকের গহীনে সেই ছোট বেলা স্বপ্ন লালন করতে থাকেন। টেকনোলজির দুনিয়ায় কিছু একটা করতেই হবে, নাম লেখাতে হবে অবদান রাখাদের তালিকায়। অবশেষে মুন্সিগঞ্জ পলিটেকনিক থেকে ২০১৬ সালে ৩.২১ (৪.০০ স্কেলে) পেয়ে ডিপ্লোমা শেষ করেন। ২৩ জানুয়ারি ২০১৭ যোগদান করেন thyssenkrupp Elevator (BD) pvt. Ltd. নামক প্রতিষ্ঠানে। এরপর InGen, মেঘনা গ্রুপ, ANTIK, RINGSHIN সহ বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেন। টেকনোলজির দুনিয়ায় কিছু করতে হলে উচ্চ শিক্ষা আবশ্যক। এজন্য তিনি “সিটি লিফট” কোম্পানিতে পার্ট টাইম জবের পাশাপাশি ২০২২ সালে ভর্তি হন মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে। পড়াশোনার পাশাপাশি স্বপ্নাতুর এই যুবক ২০২৩ সালে আশুলিয়ায় “ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল সার্কিট সল্যুশন” নামে নিজের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। পড়াশোনার খরচের পাশাপাশি দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত বাবা-মাকে পর্যাপ্ত টাকা পাঠাতেন, যেন বাবা মাকে তেমন কষ্ট পেতে না হয়।

খুব ছোট বেলা থেকেই আহনাফ ছিলেন ধার্মিক, দায়িত্বশীল, এবং সততায় পরিপূর্ণ। ইসলামের প্রতি ছিল তার প্রবল আগ্রহ। বারো পাখি গ্রামের মসজিদ নির্মাণের একদম শুরু থেক সবকিছুতেই ছিল তার অংশগ্রহণ। এ মসজিদের মাটি, বালি কাধে করে নিয়ে আসা সহ সবকিছুই করেছেন। যেন এ মসজিদের প্রতিটি ইট, বালি আহনাফের স্মৃতি বহন করছে। ছোট বেলা থেকে রোজা রাখতেন। কোন রোযা না রাখা তার কাছে ছিল অকল্পনীয়, অসংখ্য রোযা রেখেছেন শুধু মরিচ ভেজে পান্তা খেয়ে। একাকী থাকার সময় যদি সাহরীতে না উঠতে পারতেন তাহলে কিছু না খেয়েই রোযা রাখতেন, তুবও রোযা ভাঙতেন না । হোটেলে খেতে হলে সব সময় সে গোশতের আইটেম খেতেন না, কারণ তিনি নিশ্চিত নন যে গরু/মুরগী জবেহ করার সময় বিসমিল্লাহ বলেছে কিনা।

আহনাফ স্বপ্ন দেখতেন প্রযুক্তিকে কাজে কিভাবে দেশের শিল্পকারখানায় বিপ্লব ঘটানো যায়। মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে B.Sc. শেষ করে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য দেশের বাইরে যাবার স্বপ্ন দেখতেন। প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগিয়ে নিজে যোগ্য, দক্ষ নাগরিকে পরিণত করা ছিল জীবনের ব্রত। ভবিষ্যতের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে যুব উন্নয়ন ও বিকেটিটিসি থেকে ট্রেনিং,নিয়েছেন। আত্নরক্ষার জন্য কারাতে ট্রেনিং এমনকি ড্রাইভিং লাইসেন্সও নিয়েছেন।

জুলাই আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি বিভিন্নভাবে পরিবারকে না জানিয়েই আন্দোলনে যোগ দেন। ৪ আগস্ট, তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে আন্দোলনে যোগ দেন, তা প্রথম তার দুলাভাইকে জানান। ঠিক সে রাতেই তার বড় বোন সাইয়েদার সাথে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলেন। ৪ আগষ্ট রাতে আহনাফকে সাইয়েদা আপু আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কারফিউ সহ চারিদিকের পরিবেশের কারণে সাইয়েদা আপুর অনেক খারাপ লাগছিল। সাইয়েদা আপু বলেন ৩ তারিখ থেকেই তার শরীর ভাল লাগছিল না, আহনাফের জন্য তার খুব টেনশন হচ্ছিল, ঘুমাতে পারছিলেন না। এমনকি ৪ তারিখ রাতে তাকে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হয়। এ যেন শহীদের বোনের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্ব ইংগিত।

৫ আগস্ট, আহনাফ যথারীতি ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে শামিল, অবস্থান বাইপাইল। সাইয়েদা আপু সকাল ১০.০০ টা থেকে ফোন দেয়া শুরু করেন, কিন্ত আহনাফ ফোন রিসিভ করছিলেন না। আহনাফ ১২.৪০ এ ফোন রিসিভ করেই রাগত স্বরে বলেন “ কেন বার বার ফোন দিতেছিস, আমি বাইরে, আর ফোন দিবি না”। আহনাফের বড় বোনের অস্থিরতা কিছুতেই কাটে না, সেনাপ্রধান বক্তব্য দেবেন, এজন্য সাইয়েদা আপু তাকে সেফ থাকার পরামর্শ দিতে চান, বারবার ফোন দেন, অবশেষে ১.৪৭ এ ফোন রিসিভ করেন।

কথা বলার পুরো সময়টা আহনাফ দৌড়ে দৌড়ে কথা বলছিল, খুব হৈচৈ হচ্ছিল।

ফ্যাসিবাদের রাণী, খুনি শেখ হাসিনার পতন হয়েছে, চারিদিকে আনন্দের জোয়ার বইছে, সে জোয়ারে বাধাহীনভাবেই উড়তে চেয়েছিল আহনাফ। আহনাফ তার রক্তাক্ত আঙুলের ছবি দিয়ে নিজের ফেসবুকে বিকেল ৩:৪৩ একটি পোষ্ট করেন। ক্যাপশনে লিখেন : দেশ স্বাধীন হবার পরে আত্নসমর্পনের ঘোষণা দিয়েও আশুলিয়া থানার পুলিশ গুলী করেছে ।

সেই পোষ্ট দেখার পর সাইয়েদা আপু আরো বিচলিত হয়ে পড়েন, অনেকবার ফোন দেন, মেসেজ দেন, কোন রিপ্লাই পান না। অবশেষে ছোট ভাইয়ের সাথে জীবনের সর্বশেষ কথা শুরু হয় ৫ আগষ্ট বিকেল ৪:১৩। শেষ বারের মত ফোন রিসিভ করে আহনাফ বলেন “বার বার কল দেস কেন, আমি ঠিক আছি, বার বার কল দিস না”। জাস্ট ৮ সেকেন্ড। ফোন কেটে দেন আহনাফ। পরিবারের সাথে আহনাফের এটাই শেষ কথা।

মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সিএসই ডির্পাটমেন্টের ছাত্র মো: সাদিকুর রহমান দিপু কোটা আন্দোলনের গ্রুপে দেখতে পান, তারই ইউনিভার্সিটির এক ভাই শহীদ হয়েছেন। আশুলিয়ায় অবস্থিত হাবিব হাসপাতালে পৌঁছে দেখেন আহনাফের নিথর দেহ। ফ্যাসিবাদি পুলিশ বাহিনী ঠিক তার লিভারকে তাক করে গুলী বর্ষণ করেছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে আহনাফ শাহাদাতের পেয়ালা পান করেন। আহনাফের ফোন থেকে দিপু আহনাফের দুলাভাইকে ফোন দিয়ে জানান, আহনাফ আবির আশরাফুল্লাহ শহীদ হয়েছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আহনাফ তার নামের সামনে নতুন উপাধি যোগ করলেন, শহীদের মিছিলে যোগ দিলেন, নতুন নামও পেয়ে গেলেন, শহীদ আহনাফ আবির আশরাফুল্লাহ।

সেদিন আহনাফ আবীরদের মতো হাজারো স্বপ্নের রক্তাক্ত উপসংহারের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতনের গল্প লেখা হয়েছিল। এ যেন ইতিহাসের এক রক্তাক্ত অধ্যায়, যেখানে জীবনের চেয়ে মূল্যবান হয়ে দাঁড়ায় প্রতিবাদের অধিকার। ফ্যাসিবাদের পতনের পরেও সেই ঐতিহাসিক ৩৬ জুলাইয়ের স্নিগ্ধ বিকেলে, এক মায়ের কলিজার টুকরো, বোনদের নয়নের আলো, আহনাফ আবির আশরাফুল্লাহ শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করলেন, থেকে গেল বোনদের পৃথিবী। এক স্বপ্নবাজ যুবক পুলিশের গুলীতে নিঃশব্দে ঝরে পড়লেন, জীবনবৃত্তের শেষ বিন্দুটি অংকিত হল। শহীদ আহনাফ আর নেই, কিন্তু তিনি অসংখ্য তরুণের আদর্শ, সততা, সাহসের আলো হয়ে জ্বলছেন। যারা জ্বলে উঠবে, দেশের প্রয়োজনে, অন্যায়ের প্রতিবাদে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। জীবনের বিনময়ে বাতিলকে রুখতে মাথা উচু করে দাঁড়াবে বারংবার।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।