জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদের জাতীয় জীবনের অন্যতম ও মহামূল্যবান অর্জন। মূলত, এ অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই গত বছরের ৫ আগস্ট দেশ ও জাতি দীর্ঘদিনের আওয়ামী স্বৈরাচারি ও ফ্যাসিবাদী অপশাসন-দুঃশাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে। প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে আওয়ামী-বাকশালীরা পরিকল্পিতভাবে দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংস করে দিয়েছিলো। বিচারবিভাগ, গণপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও শিক্ষাপ্রশাসন সহ রাষ্ট্রের সকল অঙ্গ প্রতিষ্ঠানকে করা হয়েছিলো নিলর্জ্জ দলীয়করণ। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে নির্বাচনগুলোকে রীতিমত প্রহসনে পরিণত করা হয়েছিলো। কখনো বিনা ভোটের একদলীয় নির্বাচন, কখনো দিনের ভোট রাতে, আবার কখনো ‘আমি ও ডামী’ নির্বাচন করার গুরুতর অভিযোগ ছিলো তাদের বিরুদ্ধে। সাংবিধানিকভাবে আমাদের দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র স্বীকৃত হলেও আওয়ামী শাসনামলে বিরোধীদলগুলো স্বাভাবিকভাবে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম বা কর্মসূচি পরিচালনা করার সুযোগ পায়নি বরং তাদের ওপর দীর্ঘ পরিসরে জুলুম-নির্যাতন চালানো হয়েছিলো।

কথিত বিচারের নামে প্রহসন করে জাতীয় নেতাদের একের পর এক হত্যা করে পুরো দেশকেই বধ্যভূমিতে পরিণত করা হয়েছিলো। এমতাবস্থায় একটা সর্বাত্মক বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলো। তাই এক অনিবার্য বাস্তবতায় গত বছরের ৩৬ জুলাই তথা ৫ আগস্ট ঐতিহাসিক বিপ্লবের মাধ্যমে দেশ এক নতুন যুগে পদার্পন করতে সক্ষম হয়েছে। মূলত, এ অর্জনটাও মোটেই সহজসাধ্য ছিলো না বরং এজন্য প্রায় ২ হাজার বনী আদমকে রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতে হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। অনেকেই হাত-পা-চোখ হারিয়ে স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। আর এসব ত্যাগের বিনিময়েই জাতির ঘাড় থেকে নেমেছিলো স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের জগদ্দল পাথর।

মূলত, ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে ১৬ বছরের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ও চরম অহংকারী স্বৈরশাসক হাসিনা শাসনের অবসান ঘটে। ৩৬ দিনের এ সর্বাত্মক গণআন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি যে হাসিনার পতন ডেকে আনবে তা ৫ আগস্টের আগের দিনও কেউ উপলব্ধিই করতে পারেনি। এমনকি খোদ শেখ হাসিনা নিজেও বুঝতে পারেননি যে তাকে চরম বেইজ্জতির সাথে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়তে হবে। আমাদের দেশের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এর আগে কোনো সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্র প্রধানকে এমন অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়নি নি। তবে একথাও ঠিক যে, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে হাসিনার মতো এতো স্বেচ্ছাচারি, অত্যাচারি, স্বৈরাচারি, অপরিণামদর্শী ও অহংকারী শাসককে আমরা কখনো প্রত্যক্ষ করিনি। তাই তাকে এখন পাপের প্রায়াশ্চিত্যই করতে হচ্ছে।

আওয়ামী-বাকশালী শাসনামলে দেশের প্রচলিত আইন ও রাষ্ট্রীয় সংবিধানকে ঠুটো জগন্নাতে পরিণত করা হয়েছিলো। শেখ হাসিনা যা বলতেন সেটাই ছিলো আইন। তাই তা লঙ্ঘন করা কারো সাধ্যের আওতার মধ্যে ছিল না। তার প্রায় ১৬ বছরের শাসনামল সাজানো ছিল সীমাহীন হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, গুম, অপহরণ, গুপ্তহত্যা, অত্যাচার ও নিপীড়নে পরিপূর্ণ। দেশে বাকস্বাধীনতা বলতে কিছুই ছিলো না। এমনকি জনগণকে সকল প্রকার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিলো। অধিকার বলতে যা ছিলো তা শেখ হাসিনা ও তার দলের লোকদের। এ কারণে শুধু আওয়ামীবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা নয়, বরং শেখ হাসিনা সাধারণ মানুষের কাছে ‘লেডি হিটলার’ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। অতীতে আমাদের দেশে এমন অপবিশেষণে কোন শাসককে বিশেষিত করা হয়নি। আর ভবিষ্যতের সে সম্ভবনা খুবই কম।

শেখ হাসিনার শাসনামল ছিলো অপশাসন-দুঃশাসনে ভরা। তার প্রায় ১৬ বছরের শাসনামল পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তার শাসনামলে দেশের কিছু উন্নয়ন কার্যক্রম হয়েছে। এমনকি পদ্মাসেতু ও মেট্রোরেলসহ বেশ কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে সে সময়। এ নিয়ে তার অহংকারের কোন সীমা-পরিসীমা ছিলো না বা এখনো নেই। ভাবটা এমন যে, তিনি নিজের টাকায় এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। কিন্তু এসব উন্নয়ন কাজে যে লাগামহীন দুর্নীতি ও লুটপাট ছিলো তা কারো কাছেই অজানা নয়। মূলত, নানাবিধ প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে দেশীয় অর্থ হরিলুটের মাধ্যমে বিদেশী বিশাল অর্থ-বিত্তের পাহাড় বানিয়েছিলো আওয়ামী লীগের নেতারা। এমনকি কানাডায় বেগম পাড়াও তাদেরই সৃষ্টি।

২০০৮ সালে সাজানো, পাতানো ও সমঝোতার নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি দ্বিতীয় বারের মত ক্ষমতাসীন হোন। আর নির্বাচনটি যে সমঝোতার ছিলো তা সে বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুল জলিলের আত্মস্বীকৃতিও রয়েছে। সে সংসদে আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতাও ছিলো। কিন্তু এ সংখ্যাগরিষ্ঠা শেখ হাসিনা জনগণের কল্যাণে ব্যবহার না করে রীতিমত স্বৈরাচারি ও ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠেছেন। আসলে আওয়ামী লীগের কোন মেজরিটিই কখনোই জনগণের কল্যাণে কাজে লাগানো হয়নি বরং তা বরাবরই গণনিগ্রহের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। অতীতে এ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর ব্যবহার করেই সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একদলীয় বাকশালী শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো। আর বিগত প্রায় ১৬ বছরে জাতীয় সংসদের ৩ টি তামাশা ও ভাঁওতাবাজীর নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিচালনা করে দেশকে অপরাধ ও অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিলো। অপশাসন-দুঃশাসন ও দুর্নীতিকে বলতে গেলে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছিলো।

পিলখানা হত্যাযজ্ঞ, শাপলা চত্বর গণহত্যা, মাওলানা সাঈদীর রায়ের দিন (২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩) এবং পরের দিন নির্বিচারে গণহত্যা, প্রতিনিয়ত গুম, খুন, বিএনপি জামায়াতসহ বিরোধী নেতাকর্মীদেরকে সীমাহীন নিপীড়ন-নির্যাতন জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল হাসিনার স্বৈরাচারী রাজত্বকালে। কিন্তু এ পরিস্থিতি থেকে বাঁচারও কোনো উপায় ছিল না সাধারণ মানুষের। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছিলো শেখ হাসিনার সরকার। এক্ষেত্রে আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রাখা হয়েছিলো। কোন কোন বিচারকও এক্ষেত্রে বিবেক বিরুদ্ধ কাজ করেছেন। ফলে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার বলতে আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে পরিণত করা হয়েছিলো এক নির্মম ও নিষ্ঠুর প্রহসনে। যা ছিলো বৈশ্বিক গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক ন্যক্কারজনক ঘটনা।

শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ২০১৪ সালের ভোটবিহীন একতরফা নির্বাচন করা হয়েছিলো। কথিত সে নির্বাচনে সংসদ বিনা ভোটেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলো। ২০১৮ সালের নৈশকালীন নির্বাচন, ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচন-শেখ হাসিনাকে টানা চারবার প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়েছে ঠিকই, কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে জনবিচ্ছিন্ন করে হাসিনাকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত করেছে। পরিণতিতে ২০২৪ সালে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে হাজার হাজার প্রাণের বিনিময়ে ইতিহাসের এ নিকৃষ্ট স্বৈরাচারের পতন ঘটে। যা ছিলো ইতিহাসের এক নির্মম বাস্তবতা।

তবে অতীব পরিতাপের বিষয় যে, ফ্যাসিবাদ পতনের এক বছর অতিক্রান্ত হলেও আন্দোলনের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য এখনও অর্জিত হয়নি। যে বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট নোবেলবিজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে সে স্বপ্ন এখনও অনেকটাই অধরাই রয়ে গেছে। তবে একথা সত্য, প্রত্যাশা পূরণে ইউনূস সরকারের অনেক ব্যর্থতা বা সীমাবদ্ধতা থাকলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে সফলতাও রয়েছে। অতি সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আরোপ নিয়ে দর কষাকষিতে সফলতা অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। তবে গত এক বছরেও ব্যবসা-বাণিজ্যর স্থবিরতা কাটিয়ে না উঠা, সাধারণ ব্যবসায়ীদের মাঝে স্বস্তি ফিরে না আসা সরকারের সীমাবদ্ধতাকেই চিহ্নিত করে। এছাড়া চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য এবং কোন কোন উপদেষ্টার নেতিবাচক কর্মকাণ্ডও সরকারের সার্বিক কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তবে আমাদের মনে রাখা দরকার অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে একের পর এক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়া পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজানোসহ প্রশাসনিক পুনর্গঠনে সরকারকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। সরকার গঠনের এক মাসের মাথায় আনসার বিদ্রোহ, শ্রমিক আন্দোলন, বিভিন্ন কলেজের ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন ধরনের উসকানি মোকাবেলায় সরকারকে অনেকটা ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্যের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর অনাকাক্সিক্ষত অনৈক্য। দেশে ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তারা একমত হতে পারছেন না বরং ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ও দলীয় স্বার্থ তাদেরকে অনেকটাই আড়ষ্ট করে ফেলেছে। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে বৈরিতা ও অসহযোগিতার অভিযোগও উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। ফলে রাষ্ট্রীয় সংস্কার, গণহত্যার বিচার, জুলাই ঘোষণা ও সনদ সহ নানা ক্ষেত্রে খানিকটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যা জুলাই বিপ্লব চেতনার পুরোপুরি পরিপন্থী।

মূলত, ফ্যাসিবাদ-বিরোধী চেতনায় সব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য দেখা গেলেও পরবর্তীতে নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে মতানৈক্য দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা জন্ম দিয়েছে। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনুপস্থিতি রাজনৈতিক সংকটকে আরো ঘনীভূত করে। লন্ডনে ড. ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার বিষয়টি একটু দূর হলেও জনমনে পুরোপুরি আস্থার পরিবেশ তৈরি হয়নি। ফলে ক্ষমতায় যাওয়ার দাবিদার রাজনৈতিক দলগুলো এখন পরস্পর কাদা ছোঁড়াছোঁড়ির মধ্যেই ব্যস্ত রয়েছে।

শেখ হাসিনা তার শাসন আমলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে চেতনা ব্যবসা করে গেছেন। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, আইনের শাসন, সাম্য ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ গড়ে তোলাই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা। এদিক থেকে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানও বৈষম্যবিরোধী চেতনায় সাম্য ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশের গণআকাক্সক্ষাকেই তুলে ধরে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে মহান স্বপ্নকে সামনে রেখে আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ হাজার হাজার ছাত্র-জনতা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অকাতরে জীবন দিল, অনেকেই চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেল, সে স্বপ্নই এখন উপেক্ষার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতা ও জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ করে গণতন্ত্র ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে প্রথমত, জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা দরকার। আর দেশে নির্বাচনী সহিংসতা, পেশীশক্তির মহড়া এবং চর দখলের নির্বাচন বন্ধ করতে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনও সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি হলেও এ দাবির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যমতে পৌঁছতে পারেনি। ফলে জুলাই বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এখন হুমকির মুখে পড়েছে। কারণ, ভোট চুরির ছিদ্রপথ বন্ধ না করেই অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান কোনভাবেই সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সদিচ্ছা, আস্থা ও মতৈক্য খুবই জরুরি। এমতাবস্থায় দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই মতৈক্যের ভিত্তিতে এমন কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা দরকার যা ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদ বিরোধী ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। আমাদের মনে রাখা দরকার অন্যায়ের জবাব অন্যায় দিয়ে নয় বরং বাংলাদেশের মতো বহুত্ববাদী সমাজে সকলের সমান ও ন্যায় অধিকার নিশ্চিত করা সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। কথায় কথায় নানাবিধ চটকদার রাজনৈতিক ট্যাগ লাগিয়ে নির্দোষ ও নিরীহ কাউকে হয়রানি বা সম্মানহানি করা কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। যা জুলাই চেতনা বিরোধী এবং জাতিকে বহুধাবিভক্ত করার ক্ষেত্রে মোক্ষম হাতিয়ারে পরিণত হতে পারে। মূলত, জুলাই গণঅভ্যুত্থান তখনই অর্থবহ ও সফল হয়ে উঠবে যখন আমরা এমন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবো যেখানে সবার জন্য থাকবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, মত প্রকাশের অধিকার এবং অন্যান্য সর্ব ন্যায়সঙ্গত অধিকার।

মূলত, জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভূ-চিত্রই পাল্টে দেয়। দেশ ও জাতির এক সঙ্কটময় সন্ধিক্ষণে প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার সঙ্কট নিরসন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সংস্কারের পথে যাত্রা শুরু করে। এক বছর পর বলা যায়, এ সরকার কিছু মৌলিক ভিত্তি স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। তবে ভবিষ্যতের জন্য তা কতটা টেকসই হবে, তা নির্ভর করবে আসন্ন নির্বাচনের স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণমূলক সংলাপ এবং সংস্কারের আইনি বাধ্যবাধকতার ওপর।

অবশ্য একথা সত্য যে, সরকারের বিভিন্ন অর্জনের তালিকার পাশাপাশি কিছু কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। বিশেষ করে সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো এখনো আইনি বাস্তবায়নের পর্যায়ে আসেনি বা এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এ ছাড়া আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সংবিধান সংস্কার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার আস্থার সঙ্কট নিরসনে আরো কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। নীতির প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারের কোন আপোষ করার সুযোগ নেই। দেশ ও জাতির জন্য যা কল্যাণকর তা-ই করতে হবে তাদেরকে। অবশ্য এক বছর পূর্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার তার ১২টি প্রধান অর্জনের তালিকা প্রকাশ করেছে সম্প্রতি, যা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা থেকে শুরু করে সংস্কার ও বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি নির্দেশ করে।

শান্তি ও স্থিতিশীলতা : এক বছর আগেও দেশের রাজনীতি ছিল অস্থিরতার মধ্যে। সরকার পরিবর্তনের পর সহিংসতা ও দমন-পীড়নের বদলে শান্তিপূর্ণ সংলাপ ও সংযমের পথে হাঁটায় দেশে রাজনৈতিক সহাবস্থানের পরিবেশ খানিকটা সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়, বরং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা চলেছে সর্বাত্মকভাবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সদিচ্ছা থাকলে তা সফল হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও বাজারস্থিতি : অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালে খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি প্রায় অর্ধেকে নেমেছে (প্রায় ৭-৮ শতাংশে)। রফতানি বেড়েছে ৯ শতাংশ, রেমিট্যান্স ছাড়িয়েছে ৩০.৩৩ বিলিয়ন ডলার, যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ। একই সাথে টাকার মান ডলারের তুলনায় শক্তিশালী হয়েছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বেড়েছে। সরকার ঘোষণা দিয়েছে, অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করে ধীরে ধীরে কাঠামোগত পরিবর্তনের পথে এগোচ্ছে বাংলাদেশ।

বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ : সরকারের প্রবাসীবান্ধব ও বিনিয়োগসহায়ক নীতির ফলে বিদেশী বিনিয়োগে (এফডিআই) বড় অগ্রগতি হয়েছে। চীনা প্রতিষ্ঠান হান্ডা গ্রুপ বাংলাদেশে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্পে ২৫ হাজার কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্যনীতি ও ট্যারিফ আলোচনায়ও অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।

‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ ও সংস্কার কমিশন : ২০২৪ সালের আন্দোলনের মূল দাবিগুলোকে ভিত্তি করে ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। এতে ১১টি গণতান্ত্রিক সংস্কার কমিশনের কথা বলা হয়েছে, যা সাংবিধানিক সংস্কার, নির্বাচন, বিচারিক স্বাধীনতা, দুর্নীতি দমন, কোটা সংস্কার ইত্যাদি ক্ষেত্রে সুপারিশ প্রণয়ন করছে। নতুন সমাজচুক্তির ভিত্তি স্থাপনে এ কমিশনগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

জবাবদিহিমূলক ও নিরপেক্ষ শাসন : প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও মিতব্যয়িতার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি নয়, বরং জনগণের ম্যান্ডেটের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে সরকার পরিচালিত হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে।

পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক সহায়তা : ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ এখন ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সাথে গঠনমূলক সম্পর্ক রক্ষা করছে। একই সাথে সার্ক, বিমসটেক ও আসিয়ানের মতো আঞ্চলিক সংগঠনে সক্রিয় অবস্থান নিয়েছে। ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশের রূপান্তরে অর্থায়ন বৃদ্ধি করেছে।

আন্তর্জাতিক মহলে অধ্যাপক ইউনূসের ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সফট পাওয়ার হিসেবে কাজ করেছে। ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির অংশ হিসেবে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্ক রক্ষায় সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষ করে সীমান্ত হত্যা ও পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের সাথে জটিল আলোচনা চললেও, পাকিস্তান ও চীনের সাথে নতুন অর্থনৈতিক ও কৌশলগত মেরুকরণ পরিলক্ষিত হয়েছে। জাতিসঙ্ঘ, ওআইসি, আইএলওসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এ সরকারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছে সতর্ক আশাবাদ নিয়ে।

রোহিঙ্গা সঙ্কট ও জলবায়ু নীতি : রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। জলবায়ু অভিযোজন ও কার্বন নিরপেক্ষ উন্নয়ন কৌশলে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক জলবায়ু সহায়তার আওতায় নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

সাংস্কৃতিক জাগরণ ও মানবিক রাষ্ট্র নির্মাণ : সরকার শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। জুলাই বিপ্লবের শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ, শহীদ পরিবারকে রাষ্ট্রীয় সম্মান এবং পথশিশু, শ্রমজীবী মানুষ, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মানবিক কল্যাণে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

আইনের শাসন নিয়ে উদ্বেগ : তবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনের উদ্যোগের মাঝেও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। রয়টার্স, এপি, দ্য গার্ডিয়ানসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর মামলায় প্রক্রিয়াগত স্বচ্ছতার ঘাটতি।

রাজনৈতিক আস্থা ও ভবিষ্যৎ নির্বাচনের পথ : অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন রাজনৈতিক আস্থা অর্জন এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন। তবে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সংস্কারের নিশ্চয়তা ছাড়া এখনো নির্বাচনে অংশগ্রহণে অনিচ্ছুক। তারা মনে করে সংস্কার ছাড়া কোন নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য হবে না বরং পতিত স্বৈরাচারের অশুভ বৃত্তেই সবকিছু আটকা পড়বে। সুশীলসমাজ ও আন্তর্জাতিক মহলের মতে, বিশ্বাসযোগ্য, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এখনই রাজনৈতিক সংলাপ, নিরপেক্ষ কমিশন এবং মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে বেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোন অর্জন নেই।

তবে একথা সত্য যে, অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার এক বছরে বেশ কিছু কাঠামোগত ও আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জন করেছে। তবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলার দিক থেকে দৃশ্যমান অগ্রগতি না ঘটলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ধরে রাখা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এক কথায়, এ সরকার এখন এক কঠিন মোড়কে দাঁড়িয়ে-যেখানে আস্থা অর্জনের জন্য বাস্তব পদক্ষেপই ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণ করবে।

জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের পতনের পর আমরা যেভাবে আশান্বিত হয়ে উঠেছিলাম, অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের সে আস্থা পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি। কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারের ঈর্শ্বণীয় সাফল্য থাকলেও রাষ্ট্র সংস্কারের গতি অনেকটাই স্লথ হয়ে পড়েছে। গণহত্যার বিচারেও আহামরি অগ্রগতি নেই। জুলাই ঘোষণা নিয়েও আনাস্থার মুখোমুখি হয়েছে সরকার। তাই সরকারের বছর পূর্তির সালতামামী করতে গেলে তা আশা-নিরাশার চোরাবালিতেই আটকে যায়। তাই দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সরকারকে আরো কঠোর ও জবাবদিহীতামূলক হওয়া উচিত। অন্যথায় আমাদের কোন অর্জনই ফলবতী হবে না।