অধ্যক্ষ মো. শাহাবুদ্দিন
দেশের মানুষ শরীয়াহহ আইনের পক্ষে ঝুঁকছে, মুসলিম হিসেবে কথাটি উল্লেখ করতে লজ্জাও লাগে এবং নিজেদের হতভাগ্য ও আল্লাহর কাছে অকৃতজ্ঞ বলেও মনে হয়। মুসলিম পরিবারে জন্ম লাভের সুবাদে আমাদের সৃষ্টি ও এ পৃথিবীতে আগমণের উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ করার সুযোগ পাওয়া গেছে। এটি আল্লাহর এক খাস নিয়ামত। প্রশ্ন হচ্ছে দেশে নতুন করে মানুষকে শরীয়াহহ আইনের পক্ষে ঝুঁকবে কেন? আমাদের জন্ম ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে দেশেতো স্বাভাবিকভাবেই শরীয়াহ আইন চালু থাকার কথা, নেই কেন? বিষয়টি ভাববার। কারণ মুসলিম অর্থই হলো আল্লাহ ও রাসূলের (সা.) পথে জীবনযাপনকারী।
একথা বলা অতিরিক্ত হবে না বলে আমার বিশ্বাস যে, আখেরাতে যারা কল্যাণ লাভ করে আল্লাহর সন্তষ্টির মাধ্যমে জান্নাত লাভ করবে, আমরা জন্মসূত্রে সে বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে পেরেছি। কারণ আল্লাহ বলেন, যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে নিশ্চিতভাবেই তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতের বাগান যার নিম্নদেশে প্রবাহিত হতে থাকবে ঝরণাধারা। এটিই বড় সাফল্য। সূরা : বুরুজ-১০
আয়াত অনুসারে আমরা বলতে পারি মুসলিম ঘরে জন্মলাভ করার কারণে আমরা ঈমান ও ইসলাম বিষয়ে জানার এবং আমল করারও সুযোগ পেয়েছি। বুদ্ধিজ্ঞান লাভ করার শুরু থেকেই আমরা পারিবারিকভাবে ইসলামের বিভিন্ন শিক্ষা জানার সুযোগ পেয়ে থাকি। অন্য ধর্মে জন্ম লাভ করলে এ সুযোগ লাভ করার নিশ্চয়তা ছিল না বলেই মন্তব্য করা যায়।
আমরা আশা এবং বিশ্বাসও করতে পারি যে, আল্লাহ আমাদের পরকালে জান্নাত দিবেন বলেই মুসলিম ঘরে জন্মলাভের অমূল্য ভাগ্যবান করেছেন। এখন আমরা যদি জন্মের পরিচয়ের সুযোগটি আল্লাহর পথে ব্যয় না করে নিজের ইচ্ছামত ব্যয় ব্যবহার করে জীবনযাপন করে থাকি, আল্লাহর অবাধ্য হয়ে নয় শুধু, আল্লাহর বিপক্ষে যদি দাঁড়িয়ে যাই আর তাতে যদি জাহান্নামের মেহমান হই সেটি কি আল্লাহর দোষ না আমাদের?
বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা শরীয়াহ আইনে পরিচালিত নয়। মুসলমানদের সামাজিক অবস্থা শরীয়াহ আইন ছাড়া পরিচালিত হওয়ার কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক কি কোন বিকল্প ব্যবস্থা আছে? নেই। কিন্তু কেন নেই? এ বিষয়ে আলোচনা করলে যা বলতে হয় তাহলো শুধু সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রীয় সংবধিান শরীয়াহ ভিত্তিক না করা। উপরে আমাদের যে পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে শরীয়াহ আইন দেশে চালু করার এমন কি কি বাধা ছিল? যার কারণে দেশে ইসলামী কল্যাণমূলক সমাজব্যবস্থা কায়েম করা সম্ভব হয়নি? পাক-ভারত উপমহাদেশে ৫/৬ শত বছর ইসলাম ও মুসলিম শাসন ব্যবস্থার ইতিহাস বাদ দিলেও প্রায় ২০০ বছর ইংরেজদের অধীনে থেকে ইসলামের তামাদ্দুনিক জীবন ধ্বংস হলেও ইসলাম ও মুসলিম চেতনাবোধ বিদ্যমান ছিল। এর ওপর ভিত্তি করেই দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। মুসলিম লীগ নামক সরকার মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। শরীয়াহ আইন চালু করার মেনডেট থাকলেও সরকার গড়িমশি করে পাশ কাটিয়ে চলার চেষ্টা করে। আলেম সমাজের আন্দোলনে তদানিন্তন সরকার কুরআনের শাসনতন্ত্র তৈরির সুযোগ দেয় যা ১৯৫৬ সালে প্রস্তুত হয়েছিল। অপরদিকে আর একটি মুসলমানের দল আওয়ামী মুসলিম লিগ নামে জন্ম হলেও পরে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ হয়ে যায় এবং ১৯৫৪ সালে যুক্ত ফ্রন্ট নামে নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। কিন্তু স্পিকার শাহেদ আলীকে সংসদ ভবনে হত্যার পর দেশে যা হবার তা হয়ে গেল।
কুরআনের খসড়া শাসনতন্ত্র ঐখানেই ফ্রিজে আটকা পরে গেল। আসলেন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। চালু হলো মার্শাল ল’। পরবর্তীতে আবার মুসলিম লিগ সরকার নামেই দেশ শাসন করলেন আইয়ুব খাঁন। ঐ পথ ধরেই ইয়াহিয়া টিক্কা খাঁনদের রাজত্ব চলে। ’৬৯-এর গণআন্দোলনের পূর্ব পর্যন্ত সরকারের বিরুদ্ধে বহু আন্দোলন হয়। ইসলামপন্থিরা এ থেকে পিছে ছিলনা। আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও তাদের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকও ছিল না। তারা যে জাতীয় সংবিধান তৈরি করল তা জাতির চেতনার পরিপন্থি ছিল। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সংবিধানে ৪ মূলনীতি সংযোজন করা হয়। তাদের ভোটারদের মাঝেও ইসলামের বিরুদ্ধে সংবিধান তৈরির পক্ষে ছিল না। এ ছাড়া আপামর জনগণও এ সংবিধান মেনে নেয়নি।
ইসলামপন্থি দলের জনগণের স্রষ্টা যে আল্লাহ, তাদের ধর্মগ্রন্ত যে আল কুরআন ও পথ প্রদর্শক মুহাম্মাদুর রাসূল (সা.) আওয়ামী মুসলিমরা কি ঐসব পরিচয়ে একই নয়? ঐ ৩টি পরিচয়ের কারণে সকল দলের মুসলিমদের, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতি তথা সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা অর্থাৎ তামাদ্দুনিক জীবন কি এক ও অভিন্ন হওয়ার কথা নয়?
মুসলিম হওয়ার পর আল্লাহর দীনের বিরুদ্ধে জীবনবিধান তৈরি করার এমন কি কোন সুযোগ আছে? ধর্মীয় জীবন ও রাজনৈতিক জীবন কি আলাদা? রাসূল (সা.) এর দেখানো ও শিখানো নামাজ, রোজা, হজ¦, যাকাত, মসজিদ-মাদরাসাসহ বিভিন্ন সৎ আমল করার পর এমন কোন সাহাবী (রা.) কে খুঁজে পাওয়া যাবে কি যিনি রাজনীতির দল করেছেন আবু জেহেলের সাথে? যদি না পাওয়া যায় তাহলে কিয়ামত পর্যন্ত কি কোন মুসলমান এই বৈশিষ্ট হারিয়ে আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে? এ পথ ধরেই জাতীয় পার্টি, বিএনপি তাদের শাসন কার্যক্রম পরিচালনা করে এসেছে। কেউবা রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম আবার কেউবা সংবিধানে বিস্মিল্লাহ ও আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস সংযোজন করলেও জাতীয় সংবিধান শরীয়াহর কাছাকাছিও পৌঁছতে পারেনি। এ কারণেই একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে আল্লাহ, কোরআন ও রাসূল (সা.) বিশ্বাসী মুসলিম হওয়ার পরও জাতীয় চেতনার মূল্যায়ন করে কোন দলই ঈমানের দাবি পূরণ করার নিমিত্তে এ দেশে শরীয়াহ আইন চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। (চলবে)