॥ ড. মো. আনোয়ার হোসেন ॥

‘আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস’ প্রতি বছর ১ অক্টোবর পালন করা হচ্ছে, যা ১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত একটি সিদ্ধান্ত। এবারও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি আমাদের দেশেও পালিত হয়েছে। দিনটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো প্রবীণদের সুরক্ষা, অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং বার্ধক্যজনিত সমস্যাগুলো সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। দিবসটি প্রবীণদের অধিকার ও সুরক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে, যাতে তারা সমাজে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারেন। আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য হলো- “Older Person Driving Local and Global Action : Our Aspiration, Our Well Being, Our Rights”। প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাংলা প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়- ‘একদিন তুমি পৃথিবী গড়েছ, আজ আমি স্বপ্ন গড়ব, সাথে তোমায় রাখব আগলে।’

২০২৫ সালের প্রবীণ দিবসের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক র‌্যালি, আলোচনা সভা, প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও অধিকার নিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রবীণ নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অসহায় প্রবীণদের জন্য সাংবিধানিক অঙ্গীকার সন্নিবেশিত করা হয়েছে। ‘পিতা-মাতা ভরণপোষণ আইন, ২০১৩’ কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন এবং দারিদ্র্যপীড়িত প্রবীণদের জন্য কৃষি ঋণ বা আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মকা-ে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের মতো পদক্ষেপগুলোও অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি প্রবর্তনের মাধ্যমে প্রবীণদের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে।

বাংলাদেশে প্রবীণরা প্রধানত চারটি নিপিড়নের শিকার হন: মানসিক নির্যাতন, শারীরিক নির্যাতন, আর্থিক নির্যাতন এবং অবহেলার শিকার হন। একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৮৮% প্রবীণ মানসিক নির্যাতনের, ৮৩% অবহেলার, ৫৪% আর্থিক নির্যাতনের এবং ৪০% শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। মানসিক নির্যাতন- প্রবীণদের হেয় করা, অপমান করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা এবং তাদের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা এর অন্তর্ভুক্ত। শারীরিক নির্যাতন-প্রবীণদের শারীরিক কষ্ট দেওয়া বা আঘাত করা। আর্থিক নির্যাতন-প্রবীণদের অর্থ বা সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা বা তাদের আর্থিক সুবিধা থেকে দূরে রাখা। অবহেলা -প্রবীণদের মৌলিক চাহিদা, যেমন খাবার, বস্ত্র, ও চিকিৎসার প্রতি উদাসীন থাকা বা তাদের প্রয়োজনীয় যতœ না নেওয়া।

দুর্ভাগ্যবশত হলেও সত্য অনেক পরিবারেই সন্তানরা তাদের বাবা-মায়ের প্রতি অবহেলা করে থাকেন, যা মানসিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার কারণ হয়। এ অবহেলার মধ্যে রয়েছে বাবা-মাকে বোঝা মনে করা, তাদের প্রতি চরম নিষ্ঠুরতা দেখানো এবং তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া। এ নৈতিক অবক্ষয় সমাজে একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা, যার ফলে অনেক বয়স্ক বাবা-মা তাদের বার্ধক্যে এসে বঞ্চনার শিকার হন। এই সমস্যা প্রতিরোধের উপায় হতে পারে - সমাজ এবং পরিবারে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা উচিত। পরিবার ও সমাজে নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন, যাতে সন্তানরা ছোটবেলা থেকেই বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। বাবা-মা ও সন্তানের মধ্যে সুদৃঢ় ও ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরি করা প্রয়োজন, যাতে একে অপরের প্রতি টান থাকে এবং একে অপরের যতœ নেওয়া হয়।

পৃথিবীর সকল ধর্ম প্রবীণদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করাকে দায়িত্ব হিসেব নির্দেশ দিয়েছেন। নিম্নে এ বিষয়ে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্ট ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি অতি-সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো : ইসলাম ধর্মে প্রবীণ, বিশেষ করে বয়স্ক বাবা-মাকে সম্মান, ভালোবাসা ও সেবা করার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত না করার পাশাপাশি বাবা-মায়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন।

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘আর তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না এবং পিতামাতার সঙ্গে সদাচরণ করো। যদি তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার সাথে বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হয়, তবে তাদের ‘উফ’ বলো না এবং তাদের ধমক দিও না, বরং তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলো,’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ২৩)। কুরআন শুধু পিতামাতার জন্যই নয়, বরং আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথি, পথচারী এবং নিজেদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতিও সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছে, যা প্রবীণদের অন্তর্ভুক্ত করে। সহীহ বুখারি হাদিসে বলা হয়েছে, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে অন্ন দাও, রোগীর সেবা কর এবং কষ্টে পতিতকে উদ্ধার কর,’ (হাদিস: ৫৬৪৯)। এটি প্রবীণদের প্রতি যতœশীল হওয়ার গুরুত্ব বোঝায়, যেহেতু বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের সেবা করার প্রয়োজন হয়।

প্রবীণদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা মুসলমানদের ঐতিহ্য। হাদিসে প্রবীণদের শ্রদ্ধা করা এবং নবীনদের স্নেহ করাকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত বলা হয়েছে। প্রবীণদের সঙ্গে সম্মানজনক ও নম্রভাবে কথা বলতে হবে এবং তাদের প্রতি কঠোর হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রবীণদের শারীরিক ও মানসিক চাহিদাগুলো পূরণ করা, প্রয়োজনে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া এবং তাদের বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়ানো ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।

হিন্দু ধর্ম প্রবীণদের সেবা করাকে গুরুত্ব দিয়েছে। কারণ এটি ধর্মীয় কর্তব্য ও নৈতিকতার অংশ। হিন্দু ধর্ম অনুসারে, পরিবারের প্রবীণদের সম্মান করা, তাঁদের দেখাশোনা করা এবং তাঁদের প্রতি কর্তব্য পালন করা প্রত্যেক ব্যক্তির দায়িত্ব। এটি জীবনের পর্যায়ক্রমিকতার একটি অংশ এবং পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকও বটে, যাকে ‘শ্রাদ্ধ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্মান জানানো হয়। হিন্দু পরিবারগুলোতে প্রবীণদের সেবা করাকে একটি স্বাভাবিক ও পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে দেখা হয়। তাঁদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে সম্মান করা হয় এবং পরিবারের সদস্যদের কাছে তাঁদের সহায়তা চাওয়া হয়। হিন্দুধর্মে প্রবীণদের সেবা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রবীণদের সেবা করা পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর একটি পরোক্ষ উপায়। তাঁদের সেবা করার মাধ্যমে তাঁদের আশীর্বাদ পাওয়া যায় এবং এটি আত্মিক শান্তিও নিয়ে আসে।

বৌদ্ধ ধর্ম অনুযায়ী, প্রবীণ ব্যক্তির সেবা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক কর্তব্য এবং সুখ অর্জনের একটি পথ। গৌতম বুদ্ধ সকল জীবের প্রতি দয়াবান হওয়া, দুর্বলদের রক্ষা করা, এবং অসুস্থদের সেবা করার ওপর জোর দিয়েছিলেন। এ সেবা শুধু ব্যক্তিগত পুণ্য অর্জনই করে না, বরং একটি উন্নত সমাজ গঠনেও সহায়তা করে। বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা দেয় যে, দরিদ্র ও অরক্ষিতদের সেবা করা, বিশেষ করে প্রবীণদের সেবা করা, প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব। অসুস্থ ও দুর্বলদের প্রতি সেবা করা দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি পথ।

খ্রিষ্টান ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, প্রবীণদের সম্মান ও সেবা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় দায়িত্ব। তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার জন্য তাদের মূল্যায়ন করা উচিত এবং তাদের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করা উচিত। যিশু খ্রিস্ট তাঁর অনুসারীদের একে অপরের প্রতি দয়া, মমতা এবং ভালোবাসা প্রদর্শনের জন্য শিক্ষা দিয়েছিলেন। প্রবীণদের প্রতি তাদের দুর্বলতা ও যতেœর প্রয়োজনীয়তার কারণে তাদের সেবা করা এ ভালোবাসার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। খ্রিষ্টধর্ম শেখায় যে, প্রত্যেক মানুষ ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং একে অপরের প্রতি যতœ নেওয়া ঈশ্বরেরই সেবা করার একটি উপায়। প্রবীণরা ঈশ্বরের সৃষ্টির একটি অংশ, তাই তাদের সেবা করাও ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসারই প্রকাশ।

কবি সাহিত্যিকরা জীবনের বিভিন্ন পর্যায় এবং অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন, যা প্রবীণদের নিয়ে তাদের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করে। যেমন, কাজী নজরুল ইসলাম নজরুল নবীনে-প্রবীণে মিলেই নৈরাশ্য বিসর্জনের উদ্যোগ নিতে বলেছেন। এটি তরুণ ও প্রবীণদের একসাথে কাজ করার এবং ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করার ওপর জোর দেয়। প্রবীণদের নিয়ে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি উক্তি করেছেন, তন্মধ্যে কিছু উক্তি হলো: ‘একজন বয়স্ক ব্যক্তির হাসি জীবনের অভিজ্ঞতার এক অমূল্য সম্পদ’, ‘বয়স্কদের প্রতি শ্রদ্ধা একটি সুস্থ সমাজের ভিত্তি’ এবং ‘বয়স বাড়ার সবচেয়ে ভালো দিক হলো, তুমি অন্যসব বয়সের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারো না’। এ উক্তিগুলো প্রবীণদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান এবং সমাজে তাদের অবদানের গুরুত্ব তুলে ধরে।

নবীনদের (তরুণ প্রজন্মের) প্রতি প্রবীণদের দায়িত্ব হলো তাদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও পরামর্শ দিয়ে ভবিষ্যৎ পথ দেখানো, সমাজে তাদের সম্মান ও মর্যাদা বজায় রাখতে সহায়তা করা এবং একটি উন্নত জাতি গঠনে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করা। এর মধ্যে রয়েছে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া, তরুণদের ভুল পথে চালিত হওয়া থেকে রক্ষা করা এবং তাদের প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসা প্রকাশ করা এবং তাদের ভুল থেকে শেখার সুযোগ দেওয়া, একই সাথে তাদের প্রতি ভালোবাসা বজায় রাখা। নবীনের সঙ্গে প্রবীণদের সব ধরনের দূরত্ব কমিয়ে এনে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও বোঝাপড়ার সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত। সমাজের সকল স্তরে নবীনের প্রতি প্রবীণদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। নবীনের প্রতি সঠিক ও দায়িত্বশীল আচরণ একটি উন্নত জাতি গঠনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রবীণরা তাঁদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের মাধ্যমে সমাজকে সমৃদ্ধ করতে পারেন এবং পরামর্শদাতা, শিক্ষক ও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন। তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, তাদের প্রতি যতœ ও সহানুভূতি দেখিয়ে সমাজে সংযোগ স্থাপন করা উচিত। তাদের আর্থিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং তাদের প্রতি বৈষম্য ও অবহেলা রোধ করা সমাজের সকলের দায়িত্ব।

পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি বৈষম্য, অবহেলা ও নির্যাতনের শিকার হওয়া থেকে প্রবীণদের সুরক্ষা দেওয়া উচিত। প্রবীণরা একটি সমাজের সম্পদ এবং তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

লেখক : প্রাবন্ধিক।