রিয়াদ হোসেন

প্রাকৃতিক দুর্যোগে বছরের পর বছর ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছে উপকূলীয় জনপদের মানুষ। একের পর এক আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে তারা। বার বার বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে লোকালয়। বছরের অর্ধেকের বেশি সময় ধরে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। এরমধ্যে রয়েছে খাবার পানির তীব্র সংকট, লবণাক্ততা বৃদ্ধিতে কমছে ফসলি জমির পরিমাণ। এভাবে প্রতিনিয়ত কোন না কোন সমস্যা আর সংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে তারা টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু কাজের অগ্রগতি নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকারের সাথে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সমন্বয়ের অভাবসহ নানা সমস্যায় বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে ধীরগতিতে। আড়াই হাজার কোটি টাকার দুটি মেগাপ্রকল্পসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্প চলমান থাকলেও বাস্তবায়নে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। ফলে বছরের এই সময় আসলে উপকূলীয় এই বেড়িবাঁধে কোথাও না কোথাও ভাঙন দেখা দিচ্ছে। আবার কখনও কখনও জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বেড়িবাঁধ উপচে পড়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। ফলে মানুষের বসতবাড়িসহ মৎস্য ঘের, স্কুল-কলেজ দীর্ঘসময় ধরে পানির নিচে তলিয়ে থাকছে। গত সরকারের আমলে এসব এলাকায় বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন আসেনি। এজন্য বেড়িবাঁধ ভাঙার এ গল্প শেষ করা দরকার। উপকূলীয় জনপদের পরবর্তী প্রজন্ম যেন বাঁধ ভাঙার এই গল্পের সাক্ষী না হয়; তাদের ভাগ্যের চাকা যেন বেড়িবাঁধ ভাঙা-গড়ার সাথে যুক্ত না থাকে তার জন্য এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। সকল সমস্যা আর প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে সরকারকে উপকূলে চলমান মেগাপ্রকল্পসহ সকল উন্নয়নমূলক কার্যক্রম দ্রুততার সাথে স্বচ্ছতার মধ্যে দিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের তিন জেলায় দুই হাজার ১৩৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে শতাধিক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। বছরের বর্ষা মৌসুম আসলেই বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ এই অংশে ভয়াবহ অবস্থা দেখা দেয়। আমরা দেখেছি, বেড়িবাঁধের কোন অংশে ফাঁটল দেখা দিলে স্থানীয় প্রশাসন বা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে খবর দেওয়া হয়। বাঁধ সংস্কারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাবি জানানো হয়। কিন্তু বেশিরভাগ সময় দেখা যায়, বাঁধ ভেঙে গিয়ে কয়েক গ্রাম প্লাবিত হওয়ার পর পানি উন্নয়ন বোর্ড বালির বস্তা বা অনান্য উপকরণ নিয়ে হাজির হয়। একটি পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েক দশকে উপকূলীয় জনপদে মহাসেন, রোয়ানু, আম্পান, ইয়াস ও সিত্রাংসহ প্রতিটি দুর্যোগের সময় যত বেড়িবাঁধ ভেঙেছে তার অধিকাংশ জায়গায় স্থানীয়রা নিজ উদ্যোগে সংস্কার করেছে। এজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে আরো বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা দেখেছি, উপকূলে যখন কোন বাঁধে ভাঙন দেখা দেয় তখন ওই অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে যায়। একটি বিপর্যয় দেখা দিলে তা পুরো বছরজুড়ে ওই অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা অর্থনৈতিক জীবন-যাপনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। কারণ একটি বাঁধ ভাঙার মধ্য দিয়ে বহু গ্রাম, বিস্তীর্ণ মাছের ঘের আর ফসলি জমি নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য সরকারকে এগুলো আমলে নেওয়া জরুরি। উপকূলের টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মান, সুপেয় পানির সংকট নিরসনসহ যাবতীয় সমস্যা থেকে তাদেরকে রক্ষা করতে স্থায়ী সমাধানের পথে হাঁটতে হবে। মনে রাখতে হবে, বার বার যদি উপকূলের মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়ে তাহলে এর প্রভাব আমাদের দেশের অর্থনীতির ওপর এসে পড়বে।

আমরা দেখেছি, উপকূলীয় জনপদে সরকার ইতোমধ্যে যতগুলো প্রকল্প হাতে নিয়েছে তার বেশিরভাগ জায়গায় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতার কারণে কাজের গতি কমে এসেছে। মাঠ পর্যায়ে কাজের প্রতি আন্তরিকতার ঘাটতিও এর পিছনে অন্যতমভাবে দায়ী। কখনও কখনও দেখা গেছে, কাজের ক্ষেত্র কাছাকাছি হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। যার ভোগান্তি পোহাতে হয় স্থানীয় ভুক্তভোগীদের। এজন্য উপকূলীয় সংকট নিরসনে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সমন্বয় করার বিকল্প নেই। অনেক সময় দেখা যায়, উপকূল রক্ষায় সরকার নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। কিন্তু যারা ভুক্তভোগী সেখানে তাদের কোন অংশগ্রহণ নেই। তাদের কোন মতামতকে প্রাধন্য দেওয়া হচ্ছে না। ফলে পরিকল্পনা নেওয়া হলেও; সংকট থেকে সহজে বেরিয়ে আসা যাচ্ছে না। অনেক ঠিকাদার নিম্নমানের কাজ করে ঘুষ দিয়ে টাকা উত্তোলন করে নিচ্ছে। ফলে বাঁধ মজবুত হচ্ছে না। পানির চাপ বৃদ্ধি পেলেই ভেঙে যাচ্ছে। এসব ঠিকাদারের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। আমরা আশা করবো, সরকার উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষায় ইতোমধ্যে যেসব প্রকল্প হাতে নিয়েছে তা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্যে দিয়ে দ্রুত শেষ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এসব প্রকল্পে যাতে দুর্নীতি না হয় বা প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করে কাজের গতি যাতে কমে না আসে সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখবে। বার বার সংস্কারের নামে অর্থের অপচয় না করে একবারে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা প্রকল্পগুলো দ্রুত মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করতে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আন্তরিক হবে। সর্বোপরি সরকার যদি স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্থদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মীদের সমন্বয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে পারে তাহলে নিশ্চয় সে পদক্ষেপ ফলপ্রসূ হবে। পাশাপাশি উপকূলীয় জনপদকে অসীম ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, সরকারি বিএল কলেজ, খুলনা।