২০২৪ সালে ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর জনআকাক্সক্ষা অনুযায়ী সংস্কার কার্যক্রম চলমান। অন্যদিকে ছাত্রজনতাকে হত্যাকারী ও বিগত ১৬ বছরে নানা অপরাধে জড়িতদের বিচারও অব্যাহত রয়েছে। কোন কোন মামলার রায় হয়েছে। জনআকাক্সক্ষা অনুযায়ী অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রস্তুতিও চলমান। দেশে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে আয়োজন করা হবে গণভোট। গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জনগণের অভিপ্রায় নেওয়া হবে। এর আগে জনআকাক্সক্ষা অনুযায়ী জুলাই জাতীয় সনদ প্রণীত ও স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ সনদ যাতে কার্যকারিতা না হারায় সে লক্ষ্যে একটি গণভোটেরও আয়োজন করছে অন্তর্বর্তী সরকার। নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তারা কিভাবে গণভোট করবে সে বিষয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়। প্রয়োজন দেখা দেয় সরকারি আদেশের। অবশেষে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়নে গণভোটের অধ্যাদেশ জারি করেছে সরকার। আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ থেকে গত ২৫ নভেম্বর রাতে গেজেটটি প্রকাশ করা হয়।
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে আয়োজন করা হবে গণভোট। যদিও বহু দল গণভোট আগেই অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে আসছে। গণভোটের অধ্যাদেশে বলা হয়, চব্বিশের ছাত্র-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রকাশিত জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের উদ্দেশ্যে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত কতিপয় প্রস্তাবের বিষয়ে জনগণের সম্মতি রহিয়াছে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য গণভোটে উপস্থাপন করতে সরকার জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ প্রণয়ন ও জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ অনুসারে সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত কতিপয় প্রস্তাবের বিষয়ে জনগণের সম্মতি রয়েছে কি না তা যাচাইয়ে গণভোটের বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত এ অধ্যাদেশ। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ অনুসারে গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য আইন প্রণয়নের নির্দেশনা রয়েছে।
সংসদ ভেঙে যাওয়া অবস্থায় রয়েছে এবং রাষ্ট্রপতির নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে যে, আশু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান রয়েছে, তাই সেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৩ (১) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি গণভোট অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করেন।
কী আছে এ অধ্যাদেশে? অধ্যাদেশের ১ ও ২ ক্রমিকে সংক্ষিপ্ত শিরোনাম ও প্রবর্তন এবং সংজ্ঞা উল্লেখ করা হয়েছে। অধ্যাদেশের ৩ ক্রমিকে গণভোটের প্রশ্ন বিষয়ে এ অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, গণভোটে একটি প্রশ্ন উপস্থাপন করা হইবে-”আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?”; (হ্যাঁ/ না):
অধ্যাদেশে আরও বলা হয়েছে, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে। আগামী জাতীয় সংসদ হবে দু’কক্ষ বিশিষ্ট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে। সভাপতি নির্বাচন, মৌলিক অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্থানীয় সরকার, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাসহ তফসিলে বর্ণিত যে ৩০টি বিষয়ে জুলাই জাতীয় সনদে ঐকমত্য হয়েছে- সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী রাজনৈতিক দলগুলো বাধ্য থাকবে।
অধ্যাদেশের ৪ নং ক্রমিকে ভোটকেন্দ্র বিষয়ে বলা হয়েছে। ক্রমিক ৫ এ রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ বিষয়ে বলা হয়েছে। ক্রমিক ৬ এ, প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার নিয়োগ বিষয়ে বলা হয়েছে। এসব বিষয় সাধারণ নির্বাচনের আইনের বা বিধানের মতোই। ৭ নং ক্রমিকে ভোটার তালিকা বিষয়ে বলা হয়েছে।
এখানে বলা হয়েছে, ১) ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতকৃত ভোটার তালিকা হবে গণভোটের ভোটার তালিকা। ৮ নং ক্রমিকে গণভোট গ্রহণের সময় বিষয়ে বলা হয়েছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণের সময় হইবে গণভোটের ভোট গ্রহণের সময়।
৯ নং ক্রমিকে মুলতবি ভোটগ্রহণ বলা হয়েছে। (১) যদি প্রিজাইডিং অফিসারের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কোনো কারণে ভোটগ্রহণ বাধাগ্রস্ত বা ব্যাহত হয়, তাহা হইলে তিনি ভোট গ্রহণ স্থগিত বা বন্ধ করে দিতে পারবেন এবং তৎসম্পর্কে রিটার্নিং অফিসার বা সহকারী রিটার্নিং অফিসারকে অনতিবিলম্বে অবহিত করবেন। (২) যে ক্ষেত্রে উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো ভোটকেন্দ্রে ভোট গ্রহণ বন্ধ করা হয়েছে সেইক্ষেত্রে রিটার্নিং অফিসার বা সহকারী রিটার্নিং অফিসার অনতিবিলম্বে তৎসংক্রান্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে কমিশনের নিকট প্রতিবেদন পেশ করবেন এবং কমিশন যদি এ মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে, অন্যান্য ভোটকেন্দ্রের ফলাফল দ্বারা গণভোটের ফলাফল নির্ধারণ করা সম্ভব নহে, তাহা হইলে কমিশন উক্ত ভোটকেন্দ্রে পুনরায় ভোট গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করবে। কমিশন কোনো ভোটকেন্দ্রে পুনরায় ভোট গ্রহণের নির্দেশ দিলে, রিটার্নিং অফিসার বা সহকারী রিটার্নিং অফিসার যথাশীঘ্র সম্ভব ভোট গ্রহণের তারিখ, স্থান ও সময় নির্ধারণ করে একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করবেন।
১০ নং ক্রমিকে বলা হয়েছে, গোপন ব্যালটের মাধ্যমে গণভোট গ্রহণ। (১) গোপন ব্যালটের মাধ্যমে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে এবং উল্লিখিত প্রশ্নটিতে জনমত যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত একক ব্যালটের মাধ্যমে প্রত্যেক ভোটার ভোটদান করবেন। (২) গণভোটের ব্যালট ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যালট হতে পৃথক ও ভিন্ন রঙের হবে।
ব্যালট বাক্স বিষয়ে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত, নির্ধারিত এবং সরবরাহকৃত ব্যালট বাক্স ভোট গ্রহণের জন্য ব্যবহার করতে হবে। তবে শর্ত থাকে যে, কমিশন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সরবরাহকৃত একই ব্যালট বাক্স গণভোটের ব্যালট বাক্স হিসাবে ব্যবহার করার অনুমতি প্রদান করতে পারবে।
বলছিলাম জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনে বেশ কিছু দলের দাবির কথা। তাদের দাবি ন্যয়সঙ্গত তাতে সন্দেহ নেই। তবে অন্তর্বর্তী সরকার আরো কিছু দলের দাবির প্রেক্ষিতে একই দিনে উভয় ভোট আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অবশ্য সংসদ নির্বাচনের আগে বা নির্বাচনের দিনে গণভোটের দুটো অপশনই দিয়েছিল। যাই হোক সরকার এর মধ্য থেকে একটা বেছে নিয়েছেন। তবে একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের আয়োজন করা নিয়ে খোদ নির্বাচন কমিশন চ্যালেঞ্জে রয়েছে বলে খবরে জানা যাচ্ছে।
ইসি কী বলছে? ইসি বলছে, ইসি কখনো এভাবে বড় ধরনের দু’টি ভোটের আয়োজন করেনি। এটি তাদের জন্য নতুন এবং প্রথম। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজনের মতোই আরেকটি আয়োজন করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রস্তুতি ও জনবলও প্রায় দ্বিগুণ লাগবে। গণভোটের বিষয়ে ইতোমধ্যে একটি আইনের অধ্যাদেশ উপদেষ্টা পরিষদ অনুমোদন দিয়েছে। শিগগিরই তা গেজেট আকারে জারি হবে। আইনের বিধান কী ধরনের হবে তার ওপর নির্ভর করে প্রস্তুতি গ্রহণ করবে ইসি। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আলাদা দিনে করলে ভালো হবে এবং সুশৃংখল হবে। অন্যথায় বিশৃংখলা হওয়ার আশঙ্কা করছে বিশেষজ্ঞগণ। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামীসহ অধিকাংশ দল ভোটের আগেই গণভোট আয়োজনের জন্য দাবি জানিয়ে আসছে।
সূত্রমতে, ইতোমধ্যে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে একসঙ্গে আয়োজনের জন্য সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন কমিশন-ইসিকে চিঠি দিয়েছে। সে সাথে গত মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত একটি আইন উপদেষ্টা পরিষদ অনুমোদন দিয়েছে। আইনে জাতীয় নির্বাচনের ব্যালট থেকে পৃথক ব্যালট তৈরী করা, একই ধরনের সিল ব্যবহার করাসহ বেশকিছু বিশেষ বিধান করা হয়েছে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, আইনের গেজেট প্রকাশ হওয়ার পর ইসি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোটের আয়োজনের বিষয়ে বড় ধরনের প্রস্তুতির বিষয় রয়েছে। ইসি এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে। এই চ্যালেঞ্জ উত্তীর্ণ হতে না পারলে বড় ধরনের বিশৃংখলা সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
সূত্রমতে, নির্বাচনের দিনে গণভোট করতে হলে ইসিকে ভোটদানের সময় বাড়াতে হবে। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোটের যে সাধারণ সময়সীমা, সে সময়ের মধ্যে কি ভোট শেষ করা যাবে কী না তা ভেবে দেখতে হবে। ভোট গণনায় কত সময় লাগবে। অতীতে যেমন ভোটগ্রহণের পরদিন সকালের মধ্যেই চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে, এবার একই দিনে গণভোট হওয়ায় সেই সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের ভোটের ফলাফল ঘোষণা করা যাবে কি না ? এ বিষয়টি নিয়েও আলোচনা করতে হবে।
সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার-সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন করা চ্যালেঞ্জিং বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন করতে হবে, একই রিসোর্স ব্যবহার করে। এটা আগে ছিল না। আগের কোন কমিশনকে এ চ্যালেঞ্জ দিতে হয়নি। এটার জন্য অনেকগুলো অতিরিক্ত কাজ করতে হবে। কিন্তু গণভোটটা আমাদের আয়োজন করতে হবে। আমরা একইদিনে নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন করব, কারণ আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ। আইনি ক্ষমতা পেলেই গণভোট আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু করবেন বলে তিনি জানান।
জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়নে গণভোটের অধ্যাদেশ জারির পর ইসি তার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। বলা যেতে পারে অধ্যাদেশ জারির পর ইসির প্রস্তুতিতে আর বাধা নেই। তাদের বর্ণিত শংকার দিকটি কাটিয়ে উঠে কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাই এখন দেখার বিষয়।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।