কলাম
তত্ত্বের চশমায় বিভ্রান্তির কুয়াশা
বিষয় নিয়ে মানুষ জড়ায়, জড়িয়ে যায় মানবজাতি। তবে সব বিষয় এক রকম নয়। আবার বিষয় নিয়ে রকমফের ঘটাতে দেখা যায় মতলববাজদের। মানবসমাজে বিষয় যেমন আছে; তেমনি আছে বিষয়-বৈচিত্র্য এবং বিষয়-বিভ্রান্তিও।
Printed Edition
বিষয় নিয়ে মানুষ জড়ায়, জড়িয়ে যায় মানবজাতি। তবে সব বিষয় এক রকম নয়। আবার বিষয় নিয়ে রকমফের ঘটাতে দেখা যায় মতলববাজদের। মানবসমাজে বিষয় যেমন আছে; তেমনি আছে বিষয়-বৈচিত্র্য এবং বিষয়-বিভ্রান্তিও। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যাওয়াটা সহজ হলেও বিষয়-নিষ্পত্তির কাজটা কিন্তু বেশ কঠিন। সময়ের বিভিন্ন প্রহরের মতো বিষয়-নিষ্পত্তিরও প্রহর আছে। প্রহরের তারতম্যের কারণে কি বিষয়-নিষ্পত্তির কর্ম কঠিন হয়ে পড়ে? প্রসঙ্গত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের কথা উল্লেখ করা যায়। যে লক্ষ্যগুলো প্রথম প্রহরে বেশ সহজ মনে হয়েছিল, সে লক্ষ্যগুলো এ প্রহরে এত কঠিন মনে হচ্ছে কেন? আমরা কি আমাদের লক্ষ্যে স্থির নই? কিংবা নৈতিকতার ভুবনে কি ঘটে গেছে দূষণ? আর একটি বিষয় বিবেচনায় আনা যেতে পারে। রাজনীতি বা তত্ত্বেও যে চশমায় আমরা বিষয়গুলোকে দেখছি, সেখানে কি বিভ্রান্তির কুয়াশা আছে? সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নের সাথে কি আমাদের গরমিল ঘটে গেছে? এমনটি হলে তো তথাকথিত রাজনীতি ও তত্ত্বের চশমা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে খোলা চোখে মুক্তমনে চারদিকে তাকানো উচিত। প্রকৃতি থেকে স্বচ্ছ অক্সিজেন নিয়ে আমাদের দাঁড়ানো উচিত ঘামেভেজা ছাত্র-জনতার অকৃত্রিম পাটাতনে। এমন কথার কারণ আছে। কারণ আমরা অনেকদিন ধরেই কৃত্রিম পাটাতন দেখে আসছি। বর্ণিল সে পাটাতন থেকেও মানুষের মুক্তির কথা বলা হয়েছে, অথচ সে বয়ানে ভাটি বাংলার, খামার বাংলার গাণমানুষের বোধ-বিশ্বাস ও আশা-আকাক্সক্ষাকে যুক্ত করতে সমর্থ হয়নি তথাকথিত বিপ্লবীরা। তাদের রাজনীতির চশমা ও পরিবর্তনের বয়ান দেশের গণমানুষকে ধারণ করতে সমর্থ হয়নি। তাদের সে কৃত্রিমতা এখনো বহমান। বক্তৃতা-বিবৃতি ও টকশো’র চাতুর্যে তাদের বয়ান ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কেউ কেউ তো এমনও বলার চেষ্টা করছেন যে, হাসিনা সরকার ইউনূস সরকারের চাইতে কতটা খারাপ ছিলো? এরা আসলে কারা, এদের সাকিন কোথায়?
এ প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটি সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। গত সোমবার বৃটিশ দৈনিক দ্য গাড়িয়ানে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, হাসিনার শাসনে কোনো সরকার ছিল না। এটা ছিল এক ডাকাত পরিবারের শাসন। সরদারের কাছ থেকে শুধু আদেশ হতো, আর তা পালন হয়ে যেত। কেউ কোনো সমস্যা করলে তাকে গুম করে ফেলা হতো। নির্বাচন করা হলে জয় নিশ্চিত করা হতো। কেউ অর্থ চাইলে ব্যাংক থেকে লাখ লাখ ডলার ঋণের মাধ্যমে নিয়ে নেওয়া হতো এবং তা আর কখনোই দেওয়া লাগতো না।’ তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনা দেশের যে ক্ষতি করেছেন, তার কোনো তুলনা নেই। গাজার মতোই বাংলাদেশ এক বিধ্বস্ত দেশ ছিল। শুধু তফাৎ ছিল, এখানে কোনো ভবন ধ্বংস হয়নি বরং পুরো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, নীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ধ্বংস করা হয়েছে। সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জনগণের অর্থলুট করতে ব্যাংকগুলোকে সম্পূর্ণ লাইসেন্স দেওয়া ছিল। তারা তাদের কর্মকর্তাদের বন্দুক নিয়ে পাঠাতো সব লুটে নিতে। ড. ইউনূস বলেন, সরকার পতনের পরপরই শেখ হাসিনা পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। গার্ডিয়ানকে তিনি বলেন, শেখ হাসিনাকে দিল্লি আশ্রয় দিয়ে রেখেছে, তা সহনীয় হতে পারে। কিন্তু ভারতকে প্ল্যাটফরম হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশের পরিবর্তনকে হাসিনার উল্টে দেওয়ার চেষ্টা একটি ভয়াবহ বিষয়। এটি দশকে অস্থিতিশীল করবে।
কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিক দেশকে অস্থিতিশীল করার সুযোগ কাউকে দিতে পারে না। সেটা হোক ভিতর থেকে কিংবা বাইরে থেকে। ফ্যাসিবাদের দোসররা নানা ইস্যু সৃষ্টি করে দেশকে অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ভারতের বিজেপি মহল ‘সংখ্যালঘু কার্ড’ ব্যবহার করে বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করেছে। এমন অপতৎপরতায় হাওয়া দিয়েছে ভারতের মিডিয়া। তবে এমন মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডা হালে পানি পায়নি। পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসররা সুযোগের সন্ধানে আছে। ওত পেতে আছে। মিডিয়ায় উঁকি দিচ্ছে, টকশোতে কৌশলে বয়ান তৈরির চেষ্টা করছে। ড. ইউনূসের উদারনীতির কারণে মিডিয়ায় বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগও পেয়েছে তারা। তবে জনগণের রাডারে ধরা পড়ে যাচ্ছেন তারা। সম্প্রতি দেশে পরপর কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যায়। মাগুরায় ৮ বছরের শিশু ধর্ষণের নিষ্ঠুর ঘটনাটি জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার করে। ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে এসে ধর্ষকদের কঠোর শাস্তি দাবি করেছে। সরকারও সে পথেই হাঁটছে। তবে এরমধ্যে ভিন্ন বয়ান তৈরির একটা প্রচেষ্টাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, ড. ইউনূসের আমলে সবই গেল, নারীর সম্ভ্রমও গেল। চারদিকে মৌলবাদীদের উত্থান। আসলে এমন বয়ানের কোনো বাস্তবতা আছে কি? ৫ আগস্টের আগে কি বাংলাদেশে ধর্ষণের মতো অপতৎপরতা ছিলো না? তথ্য ভাণ্ডার বলছে, পতিত স্বৈরাচারের সময় ছাত্রাবাস থেকে শুরু করে রাজপথ, সর্বত্রই চলতো ধর্ষণের তান্ডব। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তো পালিত হয়েছে ধর্ষণের সেঞ্চুরী। পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের শেষ ছয় বছরেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭ হাজার শিশুসহ ৪৩ হাজারের বেশি নারী। এ সময়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১ লাখ ৩৭ হাজার নারী। অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৮ হাজার ৪৮ নারী ও শিশু। বিরোধী দলের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার কারণেও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন নারী। কিন্তু তখন এসবের বিরুদ্ধে কথা বলেননি তথাকথিত নারীবাদী ও প্রগতিশীল নারী সংগঠনের নেত্রীরা। বরং তারা ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনরত নারী শিক্ষার্থীদের ওপর সংঘটিত নির্যাতন নিয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি বাহিনী এবং ছাত্রলীগের কর্মীরা আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণে বাধা দিতে যৌন নিপীড়ন ও শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছে। কয়েকটি ঘটনায় নারী আন্দোলনকারীদের বেআইনীভাবে আটক করা হয়েছে এবং তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে জাতিসংঘ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক সমাজকে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। ফ্যাসিবাদের দোসরদের এবার কিছুটা বোধোদয় ঘটবে ুিক? নাকি তারা আবারও বলবেন, হাসিনা সরকার ইউনূস সরাকারের চাইতে কতটা খারাপ ছিল?
লেখার শুরুতে বলেছিলাম, একটি মহল দেশের বিভিন্ন সমস্যাকে নিজেদের বিশেষ চশমায় দেখে থাকেন। তাদের বিশেষ তত্ত্ব তাদেরকে এক ধরনের কুসংস্কারে আবদ্ধ করে রেখেছে। এই কৃত্রিম কারাগার থেকে তাদের বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। জনগণের বোধ-বিশ্বাস ও আশা-আকাক্সক্ষার সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা ওত পেতে থাকেন, কখন কোন্ সুযোগে ধর্মভাবনা ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের ওপর আঘাত হানা যায়। কোথায় মাগুরার এক বাড়িতে বিকৃত রুচির কিছু অমানুষ এক শিশুর ওপর যৌন নিপীড়ন চালালো, সেখানেও ধর্মকে যুক্ত করার চেষ্টা চালালেন আমাদের কিছু তথাকথিত পন্ডিত। আর মিডিয়ায় তো তাদের অন্ধ মুরিদের অভাব নেই। অতএব তারা প্রচারণা পেয়ে যান। তারা বলতে চাইছেন, ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়ে একটি গোষ্ঠী নারীদের ঘরে ঢোকাতে চাইছেন। আবার কেউ বলছেন, যারা ধর্মীয় শিক্ষা দেন, তারা নারীদের অবজ্ঞা করতে শেখান। এর তাৎপর্য কী?
ধর্ষণ কোনো সাম্প্রতিক বিষয় নয়। মানুষের ইতিহাসের মতো ধর্ষণও প্রাচীন বিষয়। বাংলাদেশের মাগুরায় যখন ধর্ষণের ঘটনা ঘটলো, তখন ঘটনা ঘটলো ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এলাকায়ও। সেখানে স্থানীয় তিন অপরাধী সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করেছে দুই নারীকে এবং হত্যা করেছে পুরুষ সঙ্গীকে। এখানে কোনো মুসলিম মৌলবাদী ছিল না, ইসলাম ধর্মও ছিল না। ছিল রিপুর তাড়নায় উন্মাদ ও অসংযত কিছু অমানুষ। তথাকথিত পন্ডিতদের তত্ত্ব এই অমানুষদের মানুষ করতে পারবে না। এদের মানুষ করতে প্রয়োজন হবে আইনের শাসন এবং নৈতিক মূল্যবোধ। ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ’ এখানে কোনো কাজে আসবে না। তবে কাজে আসতে পারে ধর্মদর্শনজাত নৈতিক মূল্যবোধ। আর অবিশ্বাস নয়, স্রষ্টায় বিশ্বাস হবে এখানে অপরিহার্য বিষয়।