প্রফেসর আর. কে. শাব্বীর আহমদ

সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিপেক্ষবাদের আক্ষরিক অর্থ যার যার ধর্ম পালনের স্বাধীনতা। কিন্তু ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বে সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ধর্মহীনতা, ধর্মীয় বিদ্বেষ, হানাহানি ও রক্তপাতের নাম। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ভারতের কয়েক শত বছরের বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও প্রতিবছর ধর্মীয় দাঙ্গায় হাজার হাজার মুসলমানকে সর্বস্বান্ত করা, হত্যা ও নিজ বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা হয়। যার বাস্তব নজির নিকট অতীতে আহমদাবাদে নির্বিবাদে মুসলিম গণহত্যা। সম্প্রতি ৩ রা মার্চ ’২৫ ভারতের মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী জেলায় গরুর গোশত খাওয়ার অভিযোগে উগ্র হিন্দুত্ববাদী পুলিশ সেলিম ও আকিব নামের দু’জন মুসলিমকে গ্রেফতার করে। জনতার সামনে তাদের মারতে মারতে থানায় নিয়ে যায়। পথে পথে তাদের জোরপূর্বক “গরু মেরা মা”, “পুলিশ মেরা বাপ” বলতে বাধ্য করে। ধর্মনিরপেক্ষতার কী নির্মমতা! যার ভিডিও ফুটেজ বিশ্বব্যাপী ভাইরাল হয়েছে।

এ ছাড়া সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে আরাকানের লাখো রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে অমানবিক নির্যাতন ও হাজার বছরের নিজ আবাসন থেকে উচ্ছেদ করে মানবেতর জীবনে নিপতিত করা হয়। ধর্মীয় বিদ্বেষ ও আধিপত্যবাদের অন্যায় মানসিকতায় কাশ্মীরকে পরাধীন রেখে মুসলিমদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। সেক্যুলার বা ধর্মীয় বিদ্বেষে মুসলমানদের প্রথম কেবলা মাসজিদুল আকসাকে যুগ যুগ ধরে ইহুদি ইসরাইলীরা অবরুদ্ধ করে রেখেছে। সেখানে মুসলমানদের ইবাদতের সুযোগ না দিয়ে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে আসছে। মুসলমানদের স্বাধীন ফিলিস্তিনকে অস্বীকার করে ফিলিস্তিনের গাজায় বোমা নিক্ষেপ করে মুসলমানদের আবাসস্থল ধ্বংস করছে এবং রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে তাদেরকে নির্মূল করা হচ্ছে।

পরিতাপের বিষয় আরববিশ্বসহ একশো ষাট কোটি মুসলমান ঐক্যবদ্ধ কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলছে না মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে। আরববিশ্ব জ্বালানি তেল বন্ধ করে দিলে ইসরাই লের বোমারু বিমান অচল হয়ে যাবে। মুসলমানদের নতজানু মনোভাবে সেক্যুলার, নাস্তিক, ধর্মবিদ্বেষী ইসরাইল নির্বিঘ্নে মুসলমানদের ওপর জঘন্য ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। একশো ষাট কোটি মুসলমানের বয়কটমূলক একটা হুংকারেই মাত্র এক কোটি ইসরাইল নিস্তব্ধ হয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ধুয়া তুলে অমুসলিম নির্যাতনের মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অপবাদ রটানো হচ্ছে। অথচ ইসলাম মানবিকতার বিধান। অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর আঘাত করার কোনো নজির বাংলাদেশসহ বিশ্বের কোনো মুসলিম দেশে নেই।

ধর্মহীনতা, অনৈতিকতা, ধোকা, প্রতারণা, লুণ্ঠন, ব্যভিচার কোনো ধর্মই সমর্থন করে না। পরমত সহিষ্ণুতা ও পরধর্ম পালনের সুযোগ দেওয়া ইসলামের মৌলিক মানবিক বৈশিষ্ট্য। ইসলাম তার মানবিক সৌন্দর্য তুলে ধরে। কেউ স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয়।

সব ধর্মেই সত্যবাদিতা, নৈতিকতা, মানবিকতাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। হানাহানি, সন্ত্রাস, গুম,খুন, ধর্ষণ, অবৈধ আত্মসাৎ ও জোরপূর্বক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকে কোনো ধর্মই সমর্থন করে না।

শিক্ষাব্যবস্থায় অনৈতিকতা, দেশবিরোধী ও মানবতাবিরোধী কোনো কারিক্যুলাম কোনো ধর্মেই স্বীকৃতি পায় না। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ধর্ম ও বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে সংবিধান ও শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা সমীচীন। পাশাপাশি অন্য ধর্মের শিক্ষা ও নৈতিকতাকে শিক্ষা কারিক্যুলামে অন্তর্ভুক্ত করাই কল্যাণকর। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ধর্মহীন শিক্ষানীতি চালু করে মানুষকে পশু ও গোলামির জাতিতে পরিণত করে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ায়।

ধর্ম মানুষকে নীতিবান ও শুদ্ধ মানুষে পরিণত করে। ভালো-মন্দ কাজের ফলাফলে বিশ্বাসী করে তোলে। আল্লাহ তা’আলা তাঁর রাসূল (সা.)কে পাঠিয়েছেন বিশ্বমানবতাকে পরিশুদ্ধ করার জন্য। আল্লাহ তা’আলার ঘোষণা : “তিনি সেই সত্তা যিনি অশিক্ষিত, বর্বর জাতির কাছে রাসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের সর্বজনীন বার্তা শোনান, তাদেরকে নৈতিকভাবে পরিশুদ্ধ করেন, প্রজ্ঞা, বিজ্ঞান ও বিচক্ষণতার জ্ঞানে সমৃদ্ধ করেন।” (সূরা আল জুমু’আ, আয়াত-২)

ইসলাম মানবতার বিধান। অন্যান্য ধর্মেও মানবতাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

ধর্মীয় আদর্শ গ্রহণকারী মানুষ অন্যের অধিকার হরণ করে না। সন্ত্রাস, লুটতরাজ ও স্বৈরাচারী কর্মে লিপ্ত হয় না। নৈতিকতার সাথে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করে। ধোঁকা, প্রতারণা ও জোরপূর্বক জনসমর্থন ছাড়াই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে না। দুর্বল মানুষদের ওপর অন্যায়, অমানবিক আচরণ করে না। অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে না। ধর্মভীরু মানুষেরা জবাবদিহিতার মানসিকতায় গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকে।

রাষ্ট্র পরিচালনায় জবাবদিহিতার মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা সর্বক্ষেত্রে ন্যায় ও ইনসাফকে প্রতিষ্ঠিত করে। মানুষকে শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্তি দেয়। অন্যায়কারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করে। বিচারবিভাগকে স্বাধীন রেখে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করে। গণমানুষের স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয়। বুদ্ধিবৃত্তিক, দেশপ্রেমিক, গণমানুষের সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে।

তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা নয়, ধর্ম পালনই মানুষকে সত্যবাদিতা, মানবিকতা শেখায়। মানুষকে ভোগবাদী, উচ্ছৃঙ্খল, বল্গাহীন ও নিষ্ঠুর করে না। ধর্মহীনতা রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্নশীল গোষ্ঠীকে স্বৈরাচারী করে তোলে। পরকালে অবিশ্বাসী স্বৈর শাসকেরা শ্রেষ্ঠবিচারক আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতায় বিশ্বাস করে না। পরাশক্তির গোলামী করে স্বদেশ স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়ে হলেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকে।

পরবর্তীতে শোষিত, বঞ্চিত, অধিকারহারা আপামর জনতার ব্যাপক জনরোষ ও গণঅভ্যুত্থানে অপমানিত হয়ে স্বদেশ স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে দেশদ্রোহীর মতো পেছন দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়। যার বাস্তব দৃষ্টান্ত হিসেবে বাংলাদেশে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ও গণবিপ্লবে স্বৈরশাসকের শোচনীয় পতন ঘটতে দেখা যায়।

একমাত্র ধর্মীয় অনুশাসন, সৎ, যোগ্যতা, নৈতিকতা, মানবপ্রেম, সুবিচার, গণমানুষের সার্বিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান ও পরকালে সর্বশক্তিমান, মহাবিচারকের কাছে জবাবদিহিতার মানসিকতাই ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মুক্তির একমাত্র গ্যারান্টি। মানবরচিত কোনো মতবাদ ও পরাশক্তির লেজুড়বৃত্তি মানুষের স্বাধীন সত্তাকে বিধ্বংস করে।

একমাত্র জীবনবিধানদাতা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও তাঁর নবীর দেখানো পথেই মানবসমাজ পরিচালিত হলে, কোনো পরাশক্তির কাছে মাথা নত না করলে একটি দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা পায় এবং সর্বশ্রেণির মানুষ তাদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা নিশ্চিত হয়। বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ মনোভাবে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে দেশকে নিরাপদ ও সমৃদ্ধ করা যায়। ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, আধিপত্যবাদ কোনো দেশের জন্য শুভকর নয়।

লেখক : শিক্ষাবিদ, কবি।