বাংলাদেশে রক্তের আখরে লেখা একটি দিন ৫ আগস্ট বা ৩৬ জুলাই। ২০২৪-এর কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্রমান্বয়ে এক দফার আন্দোলনে পরিণত হয়ে সাড়ে ষোল বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটায়, সর্বসাধারণকে মুক্তি দেয় একটি বৃহৎ কারাগার থেকে। রক্তরঞ্জিত পথ বেয়ে দিনটি এনে দিয়েছিল স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের স্বাদ। এ আন্দোলন বাংলাদেশে সব ধরনের সরকারি চাকরিতে প্রচলিত কোটাভিত্তিক নিয়োগ ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে সংগঠিত একটি আন্দোলন। দীর্ঘ সাড়ে ষোল বছর ধরে মানুষের মনে জমে থাকা ক্ষোভ ছিল তা যেন প্রকাশ ঘটলো ৩৬ জুলাই। মানুষ এক দলীয় শাসনে নিষ্পেষিত ছিল, পরাস্ত ছিল। আওয়ামী দুঃশাসন চেপে বসেছিল জাতির ঘারে। এটা ছিল সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো। যাকে পরাস্ত করা যাচ্ছিল না। আওয়ামী লীগের শাসন আর শাসনের নামে নির্যাতন ছিল অসহনীয় এক ফ্যাসিবাদ। যে ফ্যাসিবাদকে অপসারণের জন্য হেন আন্দোলন ও কর্মসূচী পালিত হয়নি, কিন্তু সবই বিফলে গেছে।

২০২৪ সালের ৫ জুন আন্দোলনের সূত্রপাত। সে ঘটনা থেকে স্ফুলিঙ্গ হয়ে তা ছড়িয়ে পড়বে সারা বাংলাদেশে তা কেউ ধারণা করতে পারেনি। সে দিন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করে। এরপর কোটা পদ্ধতির সংস্কার আন্দোলন আবার নতুনভাবে আলোচনায় আসে। সে সময় কেউ ধারণাও করতে পারেনি আন্দোলনটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে। সফল হবে কি না। কিন্তু জনমানুষের ব্যাপক অংশ গ্রহণে ও বিপুল সংখ্যক ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগে তা সফলতার দুয়ারে পৌঁছে যায় ৫ আগস্ট। তা হয়ে ওঠে মুক্তি ও আনন্দের একটি দিন।

২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ৫ জুনের উক্ত পরিপত্র জারি করা হয়েছিল। ঐ পরিপত্রের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে নবম গ্রেড (পূর্বতন প্রথম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেডের (পূর্বতন দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সকল কোটা বাতিল করা হয়েছিল। এটা কিন্তু ছাত্ররা চায়নি। তারা চেয়েছিল সংস্কার। বাতিল চায়নি। বাতিল করে দিয়ে সংকটের বীজ রেখে দেয়া হয়েছিল। আর সেটারই প্রকাশ ঘটে কোর্টের আদেশের মধ্য দিয়ে। কোর্টের আদেশে বদলে যেতে পারে না তরুণদের চাওয়া পাওয়া। তাই তারা ফুঁসে ওঠে। ৫ জুন শুরু হয় প্রতিবাদ কর্মসূচী। ধাপে ধাপে তা পৌছে ১৬ জুলাইয়ে। আসে রক্তঝরা দিনটি। যে দিন আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে রংপুরে বুক পেতে দিয়ে গুলীর সামনে দাঁড়ান তরুণ ও অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ। ইস্পাত কঠিন ছিল তার দৃঢ়তা। তিনি গুলী খেয়েও ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন। বলতে চেয়েছেন তার দাবির কথা। তার পর আবার গুলী। এর পর তিনি শাহাদাতের অনন্ত পথে যাত্রা করেন।

সে দিন সারা দেশে গুলীতে নিহত হয় মোট ৬ জন। সে থেকে স্ফুলিঙ্গ ছড়ায় ছাত্রদের আন্দোলন। পরে তা হয়ে ওঠে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধ। শেষে তা সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় অভ্যুত্থান হয়ে। আর সে তারিখটা হচ্ছে ৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্ট। রক্তঝরা জুলাইকে প্রবম্বিত করে তরুণ ছাত্রছাত্রীরা ৫ আগস্টের নাম দেয় ৩৬ জুলাই। যা অভিনব বটে। আর এভাবে বিজয় ছিনিয়ে আনা হয়।

বাংলাদেশে সে থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত অল্প কয় দিনে যা ঘটে গিয়েছিল তা শুধু দেশ কাঁপানোই নয়, বিশ্ব ইতিহাসেও অনন্য ও নজিরবিহীন। স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীরা যে একটি রাষ্ট্রের ভিত কাঁপিয়ে দিতে পারে তা প্রথমবারের মত প্রত্যক্ষ করল দেশবাসীর সাথে বিশ্ববাসীও। শেষের নয়দিনে যারা রাস্তায় নেমে এসেছিল তাঁদের গড় বয়স ছিল ১৩ থেকে ১৮ এর মধ্যে। এমনকি ৮ থেকে ১০ বছরের ছেলে মেয়েদেরও রাস্তায় নেমে আসতে দেখা গেছে। তাঁরা শুধু সড়ক অব্যবস্থাপনা নয়, আমাদের সবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছে রাষ্ট্র এবং সরকারের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম আর দুর্নীতি। বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে সরকার, রাষ্ট্র এবং এর প্রশাসনের পচন গণমানুষের সামনে এমনভাবে উন্মুক্ত আর কখনো কেউ করে দেখাতে পারেনি।

২০২৪ এর কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষ বের হয়ে এল রাজপথে। আর সরকার চাইছিল মরীয়া হতে দেশ শাসন করতে, ছাত্রছাত্রীদের কঠোর হাতে দমন করতে। কিন্তু তারা ভুল প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হওয়ায় সাফল্য পাচ্ছিল না। আন্দোলন দিন দিন দানা বাঁধছিল। এক পর্যায়ে পুলিশ ও সরকারী দলের লোকেরা বিশেষ করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনে জড়িতদের নির্বিচারে এমনি পাখির মতো গুলী করে হত্যা করতে শুরু করে। একটি স্বাধীন দেশে কেন অধিকার আদায়ে মাঠে নামলে এভাবে শিশুদের হত্যা করা হবে তা ছিল জনগণের জ্জ্ঞিাস্য। তারা এটা মেনে নিতে পারেনি। প্রতিদিনই ছাত্র চাত্রী ও সাধারণ মানুষের রক্ত ঝরতে লাগল। প্রতিদিন ৫০/৬০ জন করে যখন মারা যেতে থাকলো তখন তা জেনে সকলেরই হৃদয় কম্পিত হতে শুরু করে। এই ভাবে কেঁপে ওঠে দেশ।

এভাবে গুলী করে মানুষ হত্যা শিশু হত্যা বহু বছর ধরে দেখেনি বাংলাদেশ। রংপুরের ছাত্র আবু সাঈদকে কাছ থেকে গুলী করে হত্যা করে পুলিশ। এ হত্যা মেনে নিতে পারেনি মানুষ। ফলে নিমেষেই তা স্ফুলিঙ্গে রূপ নেয়। আর শেষে যা হবার তাই হলো। আন্দোলন তুঙ্গে উঠলো। অনেক রক্তের বিনিময়ে সফলতাও এল। কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা আমাদের দেখিয়ে দিল দেশের ভেতরে কিভাবে পচন ধরেছিল। আর তা রোধে কি করণীয়। তারা বিষয়টি আমাদের সামনে শুধু উন্মোচনই নয় এর যে অবিলম্বে মেরামত করা দরকার তা বারবার নানা প্লাকার্ডে, ফেস্টুনে, গ্রাফিতিতে লিখে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র মেরামত করবার জন্য ৫৩ বছর দীর্ঘ সময়। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়েও এর পরিচালনার দায়িত্বে যারা ছিলেন তাঁরা এর মেরামত করতে পারাতো দুরের কথা বরং দিন এর দিন একে নানাভাবে বিনষ্ট করেছেন। এসব কারণেই ফুঁসে ওঠে জনতা।

স্বাধীনতার পর ৫৪ বছর কেটে গেছে। এ সময়টা কিন্তু অনেক লম্বা সময় একটি দেশকে ঠিক করবার জন্য বা সুশাসন দেবার জন্য। এদেশের মানুষ যতবার আশায় বুক বেঁধেছে, ততবারই তাঁদের আশা ভঙ্গ হয়েছে। এ দেশের মানুষ শেষ আশান্বিত হয়ে উঠছিল ২০০৮ সালে। নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগ যখন দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে বলেছিল, মানুষ বিশ্বাস করেছিল। মানুষ যে দল হিসাবে আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করে বিশ্বাস করেছিল তা নয়। জনগণ ভেবেছিল ১/১১ এর তিক্ত অভিজ্ঞতার পর রাজনৈতিক দলগুলি শিখবে, আর হয়ত ভুল পথে পা বাড়াবে না। এবার হয়ত দেশটা ক্রমান্বয়ে সঠিক পথে ফিরে আসবে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠল আওয়ামী লীগ ভুল পথেই হাঁটছে। একটানা সাড়ে ষোল বছর তারা ভুল পথে হেঁটেছে। সকলের চাওয়া ও দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনের চমৎকার ব্যবস্থা সম্বলিত তত্তাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল, এক দলীয়ভাবে দেশ পরিচালনা ও পরবর্তী তিনটি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে করার ফলে যা হবার তাই হয়েছে। গড়ে ওঠেনি সুশাসনের কোন ব্যবস্থা, মানুষের মতের প্রতিফলন না ঘটায় সরকার বিরোধী কোন দলকে রাখা হয়নি, দেয়া হয়নি অবাধ রাজনীতি করার সুযোগ। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের অন্যতম বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে দমন-পীড়ন, জেল জুলুমের মুখোমুখি করা, তাদের বহু নেতাকর্মীকে হত্যা করা, তাদের কার্যালয় বন্ধ করে দেয়ার মতো ঘৃণ্য সকল কার্যক্রম চালানো হয়েছে । রাজনীতি থেকে বঞ্চিত থেকেছে দেশের অন্য অনেক দল। এভাবে ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম, অনাচার, সন্ত্রাস আর দেশ থেকে সম্পদ পাচারের অবাধ সুযোগ করে দিয়ে আওয়ামী লীগ দেশটিকে সর্বস্বান্ত করে দিয়ে যায়। দেশে চাপিয়ে দেয়া হয় পরিবারতন্ত্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন অত্যন্ত ক্ষমতাধর একজন হিসেবে। তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী না হয়ে দলের নেতা হিসেবেই কাজ করেছেন। ফলে রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। ষোল বছরের মাথায় শেষ পর্যন্ত তা ভেঙে পড়ে। ৫ আগস্ট প্রাণ বাঁচাতে তিনি ভারতে পালিয়ে যান। দেশের ইতিহাসে রচিত হয় আরেক কলঙ্কজনক অধ্যায়

২০০৮ সালে অনেকের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল দেশ হয়তো এবার ক্রমান্বয়ে উদার, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে এগোবে। বাংলাদেশের মত পৃথিবীর আর কোন দেশ একটি অন্তর্ভুক্তমূলক উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এত লড়াই, সংগ্রাম, আন্দোলন আর রক্তপাতের মধ্যে দিয়ে যায়নি। রাজনৈতিক দলগুলির সাথে এর সহযোগী অঙ্গ ছাত্র সংগঠনগুলির উপরেও ছাত্র সমাজ আর আস্থা রাখতে পারছে না। ফলে, কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সবই হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত নেতৃত্বে। এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন সংযোজন। ছাত্র-যুব সমাজ রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে না তাকিয়ে না থেকে নিজেরাই নিজেদের দাবি পূরণের আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছে। তবে সহযোগী হিসেবে অনেকেই পাশে দাঁিড়িয়েছে যুগিয়েছে শক্তি ও সাহস।

জুলাই গণহত্যা বাংলাদেশের ২০২৪ সালের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের তথা মহা বিজয়ের দিনটির পূর্বে সংঘটিত একটি কালো অধ্যায়। অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনরত ছাত্র জনতার বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় এ গণহত্যা। প্রায় দু’হাজার ছাত্র-জনতা এ আন্দোলনে শহিদ হয়েছে। আহত হয়েছে হাজার। এখনো সে ক্ষত তারা বয়ে বেড়াচ্ছে। একটি স্বাধীন দেশে সাধারণ একটি চাওয়াকে বাধাগ্রস্ত করে রক্তস্নাত পথে সমাধান করতে গিয়ে একনায়কতান্ত্রিক সরকার বেছে নেয় পৈশাচিক পথ। গণহত্যার পথ। এ গণহত্যার মুখে দাঁড়িয়ে করে তারা সাহসী ভ’মিকা পালন করে এনে দেয় গণতন্ত্র , স্বাধীনতা। এই গণহত্যার পথ মাড়িয়েই আসে বিজয়ের ৩৬ জুলাই।

ছাত্রছাত্রীরা যেটা করে দেখিয়েছে সেটা হলো স্বৈরাচার হটানো, সুশাসনের দিকে নিয়ে যাওয়া, আর রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কার । নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে, কোটা ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে, সর্বোপরি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করতে, স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হলে সবার আগে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়টাই দেশ কাঁপিয়ে নতুন প্রজন্ম আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়ে গেছে। রাষ্ট্র সংস্কার, সব হত্যার বিচার ও সবশেষে একটি অবাধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেই সার্থক হবে ছাত্র-জনতার এই আত্মত্যাগ। ৩৬ জুলাই আমাদের সে কথাই বলে যায়। বিগত বছরে এই দিনটিতে মানুষের মধ্যে যে ঐক্যের যায়গাটি তৈরি হয়েছে তা ধরে রাখতে হবে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।