ড. মোজাফফর হোসেন
আগস্ট বিপ্লবের পর বাংলাদেশ কী ফর্মে চলবে সে উদ্দেশ্যে প্রণীত হচ্ছে জুলাই সনদ। যেমন প্রণীত হয়েছিল মদিনাসনদ (৬২২ খ্রি.)। সম্ভবত মদিনাসনদই পৃথিবীর লিখিত প্রথম মানবাধিকারে সনদ। মদিনা সনদের আগে রাষ্ট্র পরিচালনা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লিখিত কোনো বন্দোবস্ত ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি গত ৫৩ বছর একটি লিখিত বিধিবিধানের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে এসেছে, যাকে সংবিধান বলা হচ্ছে। প্রশ্ন হতে পারে; তাহলে সংবিধান থকার পরও নতুন করে সনদ প্রয়োজন পড়ছে কেন?
আমরা জানি বাংলাদেশে পতিত সরকার প্রধান এবং দলীয় নেতাকর্মীরা ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠেছিল। তাদের ফ্যাসিস্ট হবার পেছনে সহায়ক উপাদান হিসাবে কাজ করেছে কাটাছেঁড়া সংবিধান। কারণ দলীয় স্বার্থে সংশোধিত সংবিধানের ধারাগুলো ছিল গণমানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার চেয়ে রাজনৈতিক ভাবাদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার বেশি উপযোগী। তাছাড়া ৭২ এর পর থেকে যে রাজনৈতিক দল সরকার গঠন কেরেছে সে দলই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের উপর ভর করে সংবিধানের কিছু বিধিবিধান পরিবর্তন করে এমন করে নিয়েছে, যাতে সংবিধান সরকার দলীয় প্রধানদের পারিবারিক গঠনতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। সেজন্য ২৪ বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশের জন্য জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী বর্তমান সংবিধান গুরুত্ব হারিয়েছে। কাজেই বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে ৭২ এর সংবিধান থাকা না থাকার বাধ্যবাধকতা থাকে না। অর্থাৎ ৭২ এর সংবিধান থাকবে কী থাকবে না তা বিপ্লবোত্তর জনমতামতের ভিত্তিতে গঠিত ব্যবস্থাপকদের মর্জির উপর নির্ভর করে। এখন বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশ কোন বিধিতে চলবে, তা ঠিক করতে নতুনভাবে একটি সংবিধান প্রণয়ন করা জরুরি হতে পারে অথবা বিগত সংবিধানের সংস্কারও হতে পারে। তবে যা-ই হবে তা যেন কার্যকর হয় নির্বাচিত সরকার গঠনের আগেই এবং নতুন বিধিবিধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান ও সরকার পরিচালিত হতে পারে। জুলাই সনদ কার্যকর অথবা সংবিধান প্রস্তুত কিংবা সংস্কারের ভার কোনোভাবেই পরবর্তী সরকারের জন্য তুলে রাখা সমীচীন হবে না।
বিপ্লবের ধর্মই হচ্ছে রাষ্ট্রের ভাবাদর্শকে পাল্টে দেওয়া। যা মদিনার সনদেও দেখা গেছে। মদিনাসনদ প্রণীত হবার আগে মদিনা শাসিত হতো প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী। মদিনাবাসী সে প্রথাকে ছুড়ে ফেলে সম্পূর্ণ নতুন মানবিক মদিনা তৈরি করতে মুহাম্মদ (সা.)-এর নেতৃত্বে তৈরি করে নিলেন কিছু সম্পূর্ণ নতুন বিধিবিধান। নাম দেওয়া হলো মদিনাসনদ। মদিনায় এ নতুন সনদের ভিত্তিতেই সুশাসন চলতে থাকল। বাংলাদেশে জন-আকাঙ্খার ভিত্তিতে যে জুলাই সনদ তৈরি হলো সেই সনদপরিপন্থী যে ধারাগুলো সংবিধানে রয়েছে সেগুলো ছেঁটে ফেলে জুলাই সনদকে তার স্থলাভিষিক্ত করে সংবিধান সংস্কার করা হলে সনদ ও সংবিধান উভয়ই সাংঘর্ষিকতার ত্রুটিমুক্ত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সংবিধান আগে না জুলাই সনদ আগে এমন অবান্তর প্রশ্ন উত্থাপিত হবার সুযোগ থাকে না। ইতিহাস থেকে জানা যায়, পাকিস্তানের সামরিক শাসক ও রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান র্কতৃক জারিকৃত ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার ১৯৭০’ এর নির্বাচনে জয়ী প্রতিনিধিগণকে নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল। সে গণপরিষদই (অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও) শেখ মুজিবুরের ইঙ্গিতে সংবিধান খসড়া করেন। অথচ এখন জুলাই সনদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাবাদর্শকে বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার এক অদ্ভূত ভাবাদর্শ ধারণ করেছিল সে সংবিধান। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিকরা বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে পারেনি। পারেনি বলেই ২৪ জুলাই বিপ্লর অবসম্ভাবী হয়ে ওঠেছিল।
জুলাই সনদের গুরুত্বপূর্ণ ১২/১৩টি বিধিতে কয়েকটি রাজনৈতিক দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। এ বিধিগুলোই রাজনৈতিক দলকে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠা থেকে প্রতিরোধ তৈরি করতে পারে। অথচ রাজনৈতিক দল কটি তাতেই নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। নোট অব ডিসেন্টের সরল উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাদের ইচ্ছা আছে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার। এটা দুঃখবহ। জনগণ তাদেরকে ইতিমধ্যেই মনে রাখতে শুরু করেছে। সেজন্য জুলাই সনদ কোনোভাবে কার্যকর করার জন্য পরবর্তী সরকারে জন্য রাখা যাবে না। যদি নির্বাচিত সরকারে জন্য রাখা হয়, তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, নোট অব ডিসেন্টে রাখা এই ৮/১০ বিধি কোনোক্রমেই সংবিধানে লিখিত হবে না।
জুলাই সনদ বাস্তবায়িত হবার আগে নির্বাচন হলে কী না সে বিষয়ে ছাত্রজনতার মতামতকে অগ্রাধীকার দেওয়া যেতে পারে। জন-আকাঙ্খা হচ্ছে জুলাই সনদ সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হওয়া। যারা আগে নির্বাচন চাচ্ছে তাদের মতলব আছে। জনগণের সাথে তাদের মতলবের মিল দেখা যচ্ছে না। বাংলাদেশে জনপ্রত্যাশা বাস্তবায়িত হবে এটাই ২৪ জুলাইয়ের মূল প্রেরণা। সেটা ভুললে শহীদ ও আহতদের সাথে হবে গাদ্দারি করা।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, হাকিমপুর ওমেন’স কলেজ, দিনাজপুর।